স্বয়ং একজন সংসদ সদস্যের এ ধরনের মন্তব্য প্রমাণ করে সাধারণ জনগণ বিষয়টি তাহলে জানেই না।
দৈনিক প্রথম আলোর প্রতিবেদন বলছে—
জনগণের প্রশ্ন— ভূমি মন্ত্রণালয়ে এত দুর্নীতি তাহলে কীভাবে হয়ে থাকে, যেখানে জেলা উপজেলায় তাদের কোনো অফিসই নেই।
তৃণমূলের আমজনতার কাছে ক্ষমতার ‘চূড়ায়’ অবস্থান করেন এ কর্মকর্তা। অথচ ভূমি ব্যবস্থাপনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ কর্মকর্তা ভূমি মন্ত্রণালয়ের কেউ নন। এসিল্যান্ডের বেতন-ভাতা হয় ভূমি সংস্কার বোর্ড থেকে। কিন্তু বোর্ডে তার জবাবদিহি নেই। তিনি জবাবদিহি করেন জেলা প্রশাসকের (ডিসি) কাছে।
ভূমি সংক্রান্ত কাজের পাশাপাশি এসিল্যান্ড উপজেলায় এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
শুধু এসিল্যান্ডই নন, ভূমি ব্যবস্থাপনার সাব-রেজিস্ট্রার, জেলা রেজিস্ট্রারও ভূমি মন্ত্রণালয়ের কেউ নন। দপ্তর দুটি আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের। ভূমি সেবাসংশ্লিষ্ট অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বা এডিসি (রাজস্ব), রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর (আরডিসি), রেকর্ড রুমের ডেপুটি কালেক্টর (আরআরডিসি) পদগুলোও ভূমি মন্ত্রণালয় বা অধীনস্থ কোনো দপ্তরের পদ নয়।
এই কর্মকর্তারা অতিথির মতো এ মন্ত্রণালয়ের কাজের সঙ্গে যুক্ত হন, যারা প্রায়ই নতুন কিছু সমস্যা সৃষ্টি করে বদলি হয়ে যান। তাদের জায়গা পূরণ হয় নতুন কর্মকর্তা দিয়ে। এভাবে সমস্যার পাহাড় তৈরি হয়ে যায়। বেড়ে যায় জনভোগান্তি। প্রায় শতাব্দী প্রাচীন এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় পুরোপুরি ধার করা জনবলের ওপর নির্ভরশীল। যেটুকু নিজস্ব জনবল আছে, তাদের পদোন্নতি নেই বললেই চলে।
বিভিন্ন স্তরে প্রশাসন ক্যাডারের লোক প্রেষণে নিয়ে তাদের দিয়ে ভূমি প্রশাসন চালানো হয়। তাদের বদলি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বা বিভাগীয় কমিশনার। প্রয়োজনে শাস্তির এখতিয়ার নেই ভূমি মন্ত্রণালয়ের। শাস্তি দেওয়ার জন্য বড়জোর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিতে পারে, যা বেশিরভাগ সময়ই গুরুত্ব পায় না। অথচ খুব সহজেই নিজস্ব মানবসম্পদ ও দপ্তরের ওপর আস্থা রেখে ভূমিসেবা নিশ্চিত করা যায় বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন।
ভূমির তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর রয়েছে। ভূমি সংস্কার বোর্ড ও ভূমি আপিল বোর্ড এগুলোর অন্যতম। দু’টি সংস্থারই প্রধান হন সরকারের সচিবরা। তারা সচিব হলেও এগুলো প্রশাসনে ডাম্পিং পোস্ট হিসেবে পরিচিত। তাই এসব পদে যেতে সচিবরা আগ্রহী হন না। যোগ দিতে বাধ্য হলেও দ্রুত তারা বদলি হয়ে যান। দুটি সংস্থায়ই জনবল শুধু প্রশাসন ক্যাডারের থেকে প্রেষণে নিয়োগ করা হয়। এ ছাড়া আছে ভূমি জরিপ ও রেকর্ড অধিদপ্তর। এই দপ্তর খুব পুরনো হলেও বর্তমানে এর জনবল ৩০ ভাগেরও কম। কারণ বিধিমালা না থাকায় শূন্য পদ পূরণ করতে পারছে না। এর মহাপরিচালক, পরিচালক ও উপপরিচালক এবং সহকারী পরিচালকসহ অধিকাংশ পদ প্রেষণে প্রশাসন ক্যাডারের সদস্য দিয়ে পূরণ করা হয়। প্রেষণবহির্ভূত অন্যান্য পদে লোক নিয়োগ আটকে আছে নতুন বিধিমালায়।
ভূমি জরিপ ও রেকর্ড অধিদপ্তরের জেলা ভূমি অফিস নেই। সবকিছু জেলা প্রশাসকের ওপর ন্যস্ত। জেলা প্রশাসকের অধীনে এডিসি (রাজস্ব), আরডিসি, আরআরডিসি, ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তারা কাজ করেন। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সাংগঠনিক কাঠামোতে থাকা এসব পদ ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন না হলেও ভূমি মন্ত্রণালয়ের কাজ করে। ফলে এরা কেউই ভূমি মন্ত্রণালয়ের কাছে সরাসরি দায়বদ্ধ নন।
শুধু জনবলের দিক দিয়েই ভূমি মন্ত্রণালয় পরনির্ভরশীল না। সংস্কার তালিকায়ও তলানিতে। এর বিধিবিধান পুরনো, জটিল, অস্পষ্ট এবং জোড়াতালি দেওয়া। হাল আমলের ডিজিটালের মতো স্বচ্ছ না। সংস্কার তো হয়ইনি বরং কিছু সংস্কারের নামে তালগোল পাকানো হয়েছে।
দেশ রূপান্তর পত্রিকার তথ্য মতে ভূমি ব্যবস্থাপনা সংস্কারের কাজে হাত দিয়েছিলেন সাবেক ভূমি সচিব মোস্তাফিজুর রহমান। ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইনের খসড়া করতে গিয়ে কিছু জেলা প্রশাসকের বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন তিনি। ভূমি সংস্কার বোর্ড ও ভূমি আপিল বোর্ড এই দুই সংস্থাকে একত্র করে ভূমি ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। যার বিস্তৃতি থাকবে পুরো ভূমি ব্যবস্থাপনার ওপর। মোস্তাফিজুর রহমান একের পর এক সভা করেছেন। ড্রাফট করেছেন। কিন্তু অকস্মাৎ সরিয়ে দেওয়া হয়েছিলো তাকে। আরো গুরুত্বপূর্ণ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে পাঠানো হয়েছিলো। মোস্তাফিজুর রহমানের আগে তার পূর্বসূরি মাকছুদুর রহমান পাটোয়ারি ছিলেন ভূমি সচিব। তিনি বিধিগত কাজের চেয়ে ভূমির দুর্নীতি দূর করার মিশনে নেমেছিলেন। চাকরিজীবনের শেষ প্রান্তে চলে আসায় তাকে আর সরানোর চেষ্টা করা হয়নি। দু’দিন পর তো এমনিতেই যাচ্ছেন এই ভাবনা কাজ করেছিলো হয়ত তখন। পাটোয়ারির আগে জোরালোভাবে সংস্কার চেয়েছিলেন মোহাম্মদ শফিউল আলম। তিনি দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা মামলা নিষ্পত্তি করে ভূমি ব্যবস্থাপনাকে গতিশীল করতে চেয়েছিলেন এবং ভূমি রাজস্ব আদায় বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু তাকেও সরিয়ে দেওয়া হয়েছিলো মন্ত্রিপরিষদ সচিব করে। আরো বড় দায়িত্বে ডুবে গিয়েছিলেন তিনি। বড় দায়িত্বের অংশ যে ছিলো সুষ্ঠু ভূমি ব্যবস্থাপনা, তা তিনি অবশেষে বেমালুম ভুলে গেলেন। সেখান থেকে চলে গেলেন বিশ্বব্যাংকে।
জনগণকে আইনের শাসন ও সুন্দর প্রশাসনিক ব্যবস্থা উপহার দেওয়ার অঙ্গীকার করে জনগণের ভোটে সরকার ক্ষমতায় আসে। ফলে সব মন্ত্রীই ভূমি নিয়ে কিছু একটা করতে চান। তারা বোঝেন, এভাবে ভূমি চলতে পারে না। কিন্তু অবশেষে তাদের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির পাহাড় জমে।
২০০৯-১৩ মেয়াদে রেজাউল করিম হীরা জামালপুর থেকে এসেও বুঝতে পেরেছিলেন ভূমির সংস্কার দরকার। কিন্তু কী দরকার তা চিহ্নিত করতে করতেই পাঁচ বছর পার করে দিলেন। এরপর এলেন পাবনার শামসুর রহমান শরীফ ডিলু। তিনি শুরুতেই বুঝতে পেরেছিলেন ধার করা কর্মকর্তা দিয়ে চলবে না। প্রস্তাব তৈরি করে দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। তার সঙ্গে প্রতিমন্ত্রী ছিলেন সাইফুজ্জামান চৌধুরী। ডিলু পর্ব শেষে হলে সাইফুজ্জামান পূর্ণমন্ত্রী হন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ভূমিতে সংস্কার কঠিন। তবুও সংস্কারের চেষ্টা চালিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি তিনি ডিজিটাইজেশনে মন দিয়েছিলেন। চমক দেখিয়েছিলেন। কিন্তু সেই চমকের পরতে পরতে হয়রানি বেড়েছে সাধারণ মানুষের। সাব-রেজিস্ট্রার ভূমি সম্পর্কিত দলিল রেজিস্ট্রি করে দিলেও তারা আইন ও বিচার বিভাগের অধীন। তাদের ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে আনতে নানাভাবে চেষ্টা করেছিলেন সাইফুজ্জামান চৌধুরী। আসলে তিনি কী করেছেন সে অভিযোগ শুরুতেই লিপিবদ্ধ হয়েছে।
এরপর ভূমি মন্ত্রণালয় চালিয়েছেন পরীক্ষিত রাজনীতিক নারায়ণ চন্দ্র চন্দ আর ভূমি সচিব মো. খলিলুর রহমান। এই নেতৃত্বও চেয়েছিলেন ভূমি ব্যবস্থাপনাকে যুগোপযোগী ও চাঙ্গা করতে। জনবল না থাকলে কারা কাজ করবে? এ কারণে শুরুতেই তারা গুরুত্ব দিয়েছিলেম শূন্যপদ পূরণে। ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের আওতাধীন জোনাল সেটেলমেন্ট ও উপজেলা সেটেলমেন্ট অফিসের জনবল নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছিলো। প্রতিষ্ঠানটি ১৫ ক্যাটাগরিতে ৩ হাজার ১৭ জনকে নিয়োগ দেবে। এসব পদের মধ্যে সার্ভেয়ারের পদ ছিলো ২৮২টি।
ভূমি সচিব মো. খলিলুর রহমান বলেছিলেন ‘জনবল নিয়োগ করতে হবে এটাই স্বাভাবিক। এ বিষয়ে অনেক মামলা-মোকদ্দমা আছে। সেগুলো নিষ্পত্তির চেষ্টা করছি। সব পক্ষকে বোঝাতে চাইছি মামলায় নয়, মিলে-মিশে কাজ করলে সবকিছুই সমাধান সম্ভব। তারা আস্থা রাখছেন। দেখা যাক কতটুকু করা যায়।’
দেশের মোট জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ এখনো ভূমিহীন। সাবেক সরকার ভূমিহীনদের খাসজমি দিয়েছেন। খাসজমিতে ঘর করে তা ভূমিহীনদের মধ্যে বিতরণ করছেন। কিন্তু এক শ্রেণির কর্মকর্তাদের কারণে এ দেশে এখনো ভূমি ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আসেনি। প্রশাসনের মতো দক্ষ ও চৌকস ক্যাডার সদস্যদের ওপর ভূমি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব থাকলেও ঘুষ, দুর্নীতি, একজনের জমি অন্যের নামে লিখে দেওয়া, খাসজমি বন্দোবস্ত বা ইজারায় অনিয়ম, ভূমি অধিগ্রহণে জনগণের ভোগান্তি ও হয়রানির ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে।
সংস্কারের মামলায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসিল্যান্ডের নিচের দিকের নন-ক্যাডার কর্মচারীদের শাস্তির কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর অভিযোগ রয়েছে। অথচ ভূমির কাজ পুরোপুরি চেইনবদ্ধ অর্থাৎ নিচ থেকে শুরু করে জেলা প্রশাসকের দপ্তর এবং মন্ত্রণালয় পর্যন্ত বিস্তৃত। কাজের ভুলের কারণে নিম্নস্তরের কর্মচারীদের শাস্তি ভূমি ব্যবস্থাপনার বড় দুর্বলতা। ভূমিতে সুশাসনের জন্য যা অন্তরায় বলে মনে করা হয়।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ বিধিমালার তফসিলে রয়েছে ‘জেলা রাজস্ব শাখা’। অথচ জেলায় এ শাখার অস্তিত্ব নেই। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সাংগঠনিক কাঠামোভুক্ত রাজস্ব শাখাকেই মূলত এখানে নির্দেশ করা হয়েছে। কিন্তু এই দপ্তর ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন কোনো দপ্তর নয়। তফসিলে উল্লিখিত আরো কিছু পদ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের কাঠামোভুক্ত। এভাবেই বিধিগত অব্যবস্থাপনা সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করা হয়। উপজেলা ভূমি অফিস নামে একটি বিধি আছে। সেখানে উপজেলা ভূমি অফিস নামে একটি অফিস আছে। যে অফিসের প্রধান পদ উপজেলা ভূমি কর্মকর্তা। কানুনগোরা দীর্ঘদিন এই বিধির অধীনে পদোন্নতি নিয়ে উপজেলা ভূমি কর্মকর্তা পদে আসীন হওয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন। এটি বাস্তবায়ন না করে বা উপজেলা ভূমি কর্মকর্তা পদে প্রেষণেও কাউকে নিয়োগ না করে সহকারী কমিশনারকে পদায়ন করা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাবেক এক ভূমি সচিব বলেন, ‘ভূমি ব্যবস্থাপনা কোথায়? ভূমি ব্যবস্থাপনা গৌণ হয়ে গেছে। টাকা কামানোই মুখ্য। ভূমি নিয়ে নানা অনিয়মের খবর কাগজে বের হয়। এসব অনিয়ম থেকে আসা অর্থ কোথায় যায়? ভূমি অব্যবস্থাপনা মানেই অর্থ আদায়ের দারুণ উৎস?’
সার্ভেয়ার্স ম্যানেজমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সামীউল ইসলাম বলেন, ‘চাকরি জীবনে ১০ বছর পার হলেই আমাদের পদোন্নতি হওয়ার কথা। কিন্তু একই পদে ৩০ বছর চাকরি করে আমরা অবসরে যাচ্ছি। আর আইনের সরল বিশ্বাসের ধারাটি সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য প্রযোজ্য। কর্মকর্তার জন্য প্রযোজ্য আর অধীনস্থ কর্মচারীর জন্য প্রযোজ্য নয় বিষয়টি এমন নয়। কিন্তু নিচের দিকের কর্মীরা এর কোনো সুবিধা পাচ্ছেন না বরং একতরফা মামলা ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন।’
দলিল লেখক কোনো সরকারি চাকরি নয়, কিংবা দলিল লেখকগণ সরকারি চাকুরীজীবি নন। দলিল লেখার সাধারণ নিয়ম কানুন জানার পর সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা রেজিস্ট্রার কর্তৃক সনদপত্র গ্রহণ করে জনগনের প্রয়োজনে এবং তাদের নিকট থেকে গৃহীত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে দলিল লেখকগণ দলিল লেখাসহ বিভিন্ন কাজ করে থাকেন।
…