কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে প্রায় ১০ কোটি টাকা মূল্যের সরকারি খাস জমি দখল করে প্রভাবশালী একটি মহল নির্মাণ করেছে অবৈধ মার্কেট। এই মার্কেটে শতাধিক দোকানঘর ভাগবাটোয়ারা করে প্রভাবশালী এই সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল টাকা। অবৈধ দখলদারদের মধ্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাকর্মী এবং সরকারি কর্মচারী রয়েছেন।
সৈকতের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা সুগন্ধা পয়েন্টে খাস খতিয়ানের প্রায় ৪০ শতক জমি দখল করে প্রভাবশালী এই সিন্ডিকেট ঈদের আগে মার্কেট নির্মাণকাজ শুরু করে। স্থানীয় ভূমি অফিস শুরুতে নির্মাণকাজ বন্ধ করার জন্য লোকদেখানো অভিযান চালায়। পরে তারা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। সূত্র জানায়, এই মার্কেট নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে কোনো অনুমোদন নেওয়া হয়নি।
সৈকতের সী-ইন পয়েন্টে একাধিক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, সরকারি এই জমি দখলে নেতৃত্ব দিয়েছেন স্থানীয় বিএনপি নেতা ও ডিভাইন ইকো রিসোর্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা মোয়াজ্জেম হোসাইন শাওন। দখল করা জমিতে টিনের ছাউনি দিয়ে
গড়ে তোলা দুটি আধাপাকা বিশাল স্থাপনায় তৈরি হয়েছে শতাধিক দোকানঘর। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এই মার্কেট নির্মাণে জড়িত রয়েছেন শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক উজ্জ্বল কর, শহর স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আবদুর রহমান, জসিম উদ্দিন, আলমসহ অনেক নেতা ও প্রভাবশালী ব্যক্তি। দুটি স্থাপনায় চার সারিতে তৈরি মার্কেটে দখলদাররা প্রতিটি দোকান বিক্রি করছে ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকায়। অভিযোগ রয়েছে, ভূমি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গোপনে দোকানের ভাগ নিয়েছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, মার্কেট নির্মাণকাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এখন গ্রিল ও দরজা তৈরির কাজ চলছে। স্থানীয় লোকজন জানান, মার্কেট নির্মাণে সরকারি কোনো অনুমোদন না থাকলেও জমির ভুয়া কাগজপত্র দাখিল করে বিদ্যুৎ সংযোগ নেওয়া হয়েছে।
যোগাযোগ করা হলে শহর স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি আবদুর রহমান জানান, এই মার্কেট নির্মাণকাজে তিনি জড়িত নন। তবে তার দলের কয়েকজন নির্মাণকাজে জড়িত। তাদের মধ্যে মো. আলমের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি। স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আলম জানান, দলীয় নেতাদের নির্দেশে তিনি মার্কেট নির্মাণকাজ তদারক করছেন। মার্কেটে শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক উজ্জ্বল কর ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আবদুর রহমানের দোকান রয়েছে বলে তিনি জানান।
এ ব্যাপারে উজ্জ্বল কর জানিয়েছেন, দলীয় পরিচয়ে নয়, একান্ত ব্যক্তিগতভাবে কয়েকজন অংশীদারের সঙ্গে তিনি এই মার্কেট নির্মাণকাজে জড়িত হয়েছেন। এই জমি সরকারি নয় দাবি করেন তিনি। তবে এই মার্কেট নির্মাণে কোনো অনুমোদন রয়েছে কি-না, তা জানাতে পারেননি তিনি।
এই মার্কেট নির্মাণকাজে নেতৃত্বদানকারী বিএনপি নেতা মোয়াজ্জেম হোসাইন শাওনের বিরুদ্ধে রয়েছে সরকারি আরও জমি দখলের অভিযোগ। এই জমির দক্ষিণ পাশে সৈকত তীরে সরকারি আরও জমি দখল করে গড়ে তুলেছেন ডিভাইন ইকো রিসোর্ট নামে পর্যটন স্পট। রোববার জেলা প্রশাসন অভিযান চালিয়ে দখল করা জমিতে অবৈধ স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিয়েছে। তবে নতুন করে নির্মিত অবৈধ মার্কেটে কোনো অভিযান চালানো হয়নি। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, এই মার্কেটে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতারা জড়িত থাকায় প্রশাসন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।
এ ব্যাপারে মোয়াজ্জেম হোসাইন বলেন, সরকারি ভুল সিদ্ধান্তে ওই জমি বিএস রেকর্ডে খাস খতিয়ানভুক্ত হয়েছে। মূলত এটি ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি, তাদের কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র রয়েছে। মার্কেট নির্মাণে সরকারি অনুমোদন নেওয়া হয়েছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।
এদিকে, সরকারি জমি দখল করে অবৈধ মার্কেট নির্মাণের বিষয় নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন জেলা আওয়ামী লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীরা। কতিপয় নেতাকর্মীর এ ধরনের কর্মকাণ্ডে দলীয় ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলে তারা মনে করছেন।
এ বিষয়ে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক কায়সারুল হক জুয়েল জানান, সরকারি জমি দখলে দলের কোনো সম্পর্ক নেই। দখলবাজ যে-ই হোক তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তিনি প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানান। তিনি জানান, আগামী সভায় দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কক্সবাজার জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আবদুর রহিম জানান, নানা বিতর্কিত কাজ করে কিছু নেতাকর্মী দলের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করছে। বিষয়টি কেন্দ্রকে অবহিত করা হয়েছে।
কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বিচ ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট সিরাজুল মোস্তফা জানান, সমুদ্রসৈকতের সব অবৈধ স্থাপনা নির্মাণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক আলী হোসেন জানান, ওই মার্কেট নির্মাণে সরকারি কোনো অনুমোদন নেওয়া হয়নি। এটি খাস জমিতে তৈরি হয়েছে কি-না, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তিনি বলেন, অনেক স্থানে সৈকতের খাস জমি দখল করে অবৈধভাবে স্থাপনা তৈরি করছে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। শনি ও রোববার উচ্ছেদ অভিযানে কিছু স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে প্রভাবশালীদের চাপে কাজ করার উপায় নেই। কোনো কোনো স্থানে তৈরি হয়েছে বড় বড় স্থাপনা। এসব স্থাপনা ভাঙতে গেলে প্রয়োজন প্রায় ৪০ লাখ টাকা। এর জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে অর্থ বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।
নিউজটি দৈনিক সমকালে ২০ জুলাই ২০১৬ প্রকাশিত হয়।