ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের প্রেক্ষিতে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সাংবাদিক সম্মেলন

নির্মূল কমিটি

প্রানতোষ তালুকদার

নির্মূল কমিটি

রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটি মিলনায়তনে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত “রামু ও নাসির নগর থেকে ঠাকুরপাড়া সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের জন্য দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই” বিষয় নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করেছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।

উপস্থিত ছিলেন, নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক-সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির, সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুল, কমিটির উপদেষ্টা বিচারপতি সামসুল হুদা, বরেণ্য ইতিহাসবিদ, বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের বঙ্গবন্ধু চেয়ার-এর সম্মানিত অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আলী আকবর টাবি, আইন সম্পাদক ব্যারিষ্টার নাদিয়া চৌধুরী প্রমুখ।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে সাংবাদিক সম্মেলনে লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির গভীর ক্ষোভ ও উদ্বেগের সঙ্গে লিখিত বক্তব্যে বলেছেন যে রামু ও নাসির নগর থেকে ঠাকুরপাড়া সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের জন্য দায়ী জামায়াত-মৌলবাদীরা। স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক এ অপশক্তি সংখ্যালঘুদের উপর অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে হামলা চালাচ্ছে।

তিনি বলেছেন, গত ১০ নবেম্বর (২০১৭) রংপুরের ঠাকুরবাড়ি গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর বর্বরোচিত হামলা, গৃহে অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনের ঘটনা ঘটেছে। অভিযুক্ত টিটু রায় আদৌ ফেসবুকে ধর্ম অবমাননাকর কিছু পোস্ট করেছে কিনা, এ অভিযোগের তদন্ত হওয়ার আগেই এলাকায় সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা সৃষ্টি করা হয়েছে। এর প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে, বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐহিত্য ও ভাবমূর্তি কলঙ্কিত করা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সরকারকে বিব্রত করা এবং বাংলাদেশ মোল্লা উমরের আফগানিস্তান আর জিয়াউল হকের পাকিস্তানের মতো সন্ত্রাসী ও ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করা।

তিনি বলেন, ২০১২ সালে কক্সবাজারের বৌদ্ধদের ওপর এবং ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হিন্দুদের ওপর হামলার জন্য যেভাবে ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অজুহাত তৈরি করা হয়েছিল একই পদ্ধতিতে রংপুরের ঠাকুরবাড়ি গ্রামে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী হামলা সংঘটিত হয়েছে। অতীতের একই ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনাসমূহের মতো দুর্বত্তরা বিভিন্ন সমাবেশে, এমনকি মসজিদেও টিটু রায়কে উপলক্ষ্য করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষমূলক, উত্তেজনাকর বক্তব্য প্রদান করেছে; এলাকায় এক ধরনের সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা সৃষ্টি করে পূর্বঘোষিত তারিখে মানববন্ধনের নামে নিরীহ হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর বর্বরোচিত হামলা চালিয়েছে।

হামলার পর প্রশাসন ও সরকারের গুরত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন, ক্ষতিগ্রস্তদের কিছু ত্রাণসামগ্রী ও নগদ অর্থ দেয়া হয়েছে পুনবার্সনের জন্য, যেমনটি করা হয়েছিল রামু ও নাসিরনগরে। কয়েক হাজার হামলাকারীর ভেতর কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। সেই সঙ্গে মামলার তথাকথিত আসামী টিটু রায়কে গ্রেফতার করে সঙ্গে সঙ্গে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে, যেমনটি এর আগেহ ঘটেছিল জকিগঞ্জের রাকেশ রায় ও নাসিরনগরের রসরাজ দাসের ক্ষেত্রে। রামুর উত্তম বড়ুয়াকে গ্রেফতার করা যায়নি। পুলিশের ভাষায় আসামী পলাতক, তাকে খোঁজার চেষ্টা চলছে। পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে আমরা জানি না উত্তম কোথায়, বেঁচে আছে না মারা গেছে।

এক অর্থে রসরাজ ও রাকেশ গ্রেফতার হয়ে বেঁচে গিয়েছে, অন্তত উত্তমের মতো গুম হয়ে যায়নি। কিন্তু কী কারণে উত্তম, রসরাজ, রাকেশ আর টিটুরা আসামী? উত্তম ও রসরাজের ক্ষেত্রে তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে তাদের ফেসবুকে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে জামায়তা-শিবিরের সন্ত্রাসীরা জালিয়াতির মাধ্যমে ইসলাম অবমাননার ছবি সেঁটে দিয়েছে। যারা এ অপরাধ করেছে তারা বহাল তবিয়তে আছে। অন্যদিকে রসরাজ ও রাকেশরা আসামীর কলঙ্ক বহন করে মামলার ঘানি টানছে। উত্তম গুম না হলে তাকেও তাই করতে হত।

তিনি আরো বলেন, যে বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের জামানায় সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের প্রতিবাদ করার জন্য অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ও শাহরিয়ার কবিরকে দীর্ঘ আট নয় বছর মামলার শাস্তি পোহাতে হয়েছে, অপরাধী না হয়েও নির্দিষ্ট তারিখে আদালতে হাজিরা দিতে হয়েছে আসামী হয়ে।

কোনও সাম্প্রদায়িক দুর্বত্ত থানায় গিয়ে নিরাপরাধ কোনও অমুসলিম ব্যক্তির নামে মামলা করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে আসামী বানিয়ে হাতকড়া পরিয়ে, কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে গারদে ঢুকিয়ে দিতে পারে। গ্রেফতারে গড়িমসি করলে সাম্প্রদায়িক দুর্বত্তরা ইসলামকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে তথাকথিত অভিযুক্তকে হত্যা করতে পারে, গোটা সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, যাবতীয় সম্পদ, উপাসনাস্থল ধ্বংস করতে পারে, নির্বিচারে লুটতরাজ করতে পারে, নারীদের ধর্ষণ করতে পারে, হুমকি দিয়ে দেশছাড়াও করতে পারে। এত সব করার পর এই দুর্বত্তরা থানা, পুলিশ, প্রশাসন ও আদালতের নাকের ডগায় বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়ায়, তাদের কিছুই হয় না।

২০০১ থেকে ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোটের জমানায় সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ও মানবাধিকার লংঘনের প্রায় দশ হাজার ঘটনা ঘটেছিল এমনটি বলা হয়েছে বর্তমান সরকারের আমলে গঠিত বিচারপতি শাহাবুদ্দিন কমিশনের প্রতিবেদনে। এই দশ হাজার ঘটনার ক্ষেত্রে শতকরা এক ভাগ অপরাধীরও বিচার বা শাস্তি হয়নি। এ কথা সত্য বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলে আগের মতো বিপুল সংখ্যক সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি। তবে ২০১২ সালে রামুর ঘটনা থেকে আরম্ভ করে নাসিরনগর পর্যন্ত একজন সাম্প্রদায়িক দুর্বত্তেরও শাস্তি হয়েছে এমন তথ্য আমাদের জানা নেই।

জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে সরকার যথেষ্ট সাফল্য প্রদর্শন করলেও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার ও শাস্তির ক্ষেত্রে কোনও সাফল্য দৃশ্যমান নয়। এক্ষেত্রে সমাজ ও রাজনীতির মৌলবাদীকরণ ও সাম্প্রদায়িকীকরণ ছাড়াও একটি বড় বাধা হচ্ছে আমাদের দেড়শ বছরের পুরনো ফৌজদারী দণ্ডবিধি। সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ক্ষেত্রে অপরাধীরা পার পেয়ে যায় মূলত সাক্ষীর অভাবে। আমাদের আইনে যে কোন অপরাধ প্রমাণ করতে হলে সাক্ষ্য প্রয়োজন। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের যত ঘটনা ঘটে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী থানায় অভিযোগ করে না, মামলা করে না তারা অধিকতর নির্যাতনের আশঙ্কায়। কখনও অর্থাভাবেও তারা মামলা করতে পারে না।

তারপরও কেউ যদি সাহস করে মামলা করে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীদের হুমকির কারণে কেউ সাক্ষী হতে চায় না। জোর করে সাক্ষী বানালেও মামলার তারিখে সাক্ষী আদালতে হাজির হয় না। ফলে এসব মামলা বছরের পর বছর গড়াতে থাকে। ভিকটিমরা যেমন ন্যায়বিচার পায় না, অপরাধীরাও তেমনি শাস্তি পায় না। বিচার ও শাস্তি থেকে অব্যাহতি সাম্প্রদায়িক দুর্বত্তদের অধিকতর অপরাধে প্রেরণা জোগায়।

গতকাল (১৮ নবেম্বর) ছিল চট্টগ্রামের বাঁশখালীর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ১৪তম বার্ষিকী। বিএনপি-জামায়াত জোটের জমানায় সাম্প্রদায়িক দুর্বত্তরা বাঁশখালীর হিন্দু ধর্মাবলম্বী শীল পরিবারের ১১ জন সদস্যকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মেরেছে। নারী, শিশু, বৃদ্ধ কেউ এই ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ড থেকে রেহাই পায়নি। পরিবারের একমাত্র জীবিত সদস্য বিমল শীল আজও স্বজনহত্যার বিচার পাননি, অথচ খুনীরা বহাল তবিয়তে বেড়াচ্ছে।

গতকাল ‘প্রথম আলোয়’ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “থানা-পুলিশ, আইনজীবী, রাজনৈতিক নেতাদের কাছে ধন্না দেওয়া আর আদালত প্রাঙ্গণে ছুটতে ছুটতে বিমল শীল এখন ক্লান্ত এবং অসহায়। বিচার পেতে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি নানান জনের কাছে গেছেন। সবাই তাকে শুধু আশ্বাসই দিয়েয়ে। কিন্তু মা-বাবা, ভাইসহ পরিবারের সবাইকে হারানো এ মানুষটি ১৪ বছরেও বিচার পাননি। এ নিয়ে এখন আর তাঁর কোনো আফসোস নেই। কারণ বিচারের আশাই ছেড়ে দিয়েছেন তিনি।

এই মামলার তদন্ত শেষ করে আদালতে অভিযোগপত্র দিতেই নয় বছর লেগে যায় পুলিশের। এরপর সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হলেও এক আসামী উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে আসায় দুই বছর বিচারকাজ বন্ধ ছিল। পরে আবার সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। কিন্তু গত দেড় বছরে একজন সাক্ষীকেও আদালতে হাজির করতে পারেনি পুলিশ। এ পর্যন্ত ৫৭ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ১২ জনের সাক্ষ্য হয়েছে। সাক্ষীদের ১৭ জন পুলিশের সদস্য। তাঁদের একজনও সাক্ষ্য দেননি। মামলার এই বিবরণ তুলে ধরে পল্লি চিকিৎসক বিমল শীল বলেন, “এরপর বিচারের আশা কীভাবে করি।”

তিনি বলেন, সামাজিক প্রযুক্তির অপব্যবহার ছাড়াও আরও বহুভাবে বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা প্রতিনিয়ত নির্যাতন, বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। গত বছর গোবিন্দপুরে সাঁওতাল পল্লীতে ভয়াবহ হামলার কারণ ছিল জমিজমা সংক্রান্ত। বাঁশখালীর হত্যাকাণ্ডও জমি সংক্রান্ত। আবার যাদের কোনও জমিজমা বা সম্পদ নেই তারাও বিশেষভাবে আক্রান্ত হয় নির্বাচনের সময়ে। বাংলাদেশে জামায়ত-বিএনপির জোট ধরেই নিয়েছে সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সদস্যরা সবাই আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়।

এ কারণে ২০০১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বিশেষভাবে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায় নজিরবিহীন হামলার শিকার হয়েছিল, যাতে তারা ভোট দিতে না পারে। বাগেরহাটের একজন হিন্দু নারী তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, তিনি যেন ভোটার তালিকা থেকে সব হিন্দুর নাম কেটে বাদ দেন। হিন্দুরা কখনও ভোট দিতে যাবে না, তারা শুধু নিজ দেশে থাকতে চায়। এরকম বহু হৃদয়বিদারক আকুতি তখন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

তিনি বলেন, পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রদায়িকীকরণ নিয়ে অনেক লিখেছেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অনেক ঘটনা ঘটে যা জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় না। ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল বাগেরহাটের হিজলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান শিক্ষক অশোক কুমার ঘোষালকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, তিনি বিজ্ঞান ক্লাসে ছাত্রদের ডারউইনের বিবর্তনবাদ সম্পর্কে বলেছিলেন। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কৃষ্ণপদ মহলী হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়ার কারণে তাকেও গ্রেফতার করা হয়েছিল। ২৩ দিন আসামী হয়ে কারাগারে আটক থেকে তারা জামিনে বেরিয়ে এসেছিলেন বটে, তবে মামলা থেকে অব্যাহতি পাননি।

তিনি বলেন ২০১৬ সালে ১৬ নবেম্বর বিচারে অশোক ঘোষালের জেলসহ ৫ হাজার টাকা জরিমানা হয়েছে। তবে ম্যাজিস্ট্রেট দয়া করে প্রধান শিক্ষককে শাস্তি থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন।

এক্ষেত্রে আমাদের প্রশ্ন

(১) বাংলাদেশে ডারউইনের বিবর্তনবাদ পড়ানো নিষিদ্ধ কিনা। যদি না হয় তার জন্য যে ম্যাজিস্ট্রেট একজন নিরাপরাধ ব্যক্তিকে সম্পূর্ণ সাম্প্রদায়িক কারণে শাস্তি দিয়েছেন তার কেন বিচার হবে না?

(২) প্রধান শিক্ষক নিরাপরাধী হওয়া সত্ত্বেও তাকে ২৩ দিন আসামী হিসেবে জেল খাটতে হয়েছে। এতে সুনামহানী সহ যে শারীরিক ও মানসিক যাতনা তাকে সইতে হয়েছে তার ক্ষতিপূরণ কে দেবে ?

(৩) এ ঘটনার ভেতর দিয়ে এলাকায় মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিজয়ের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যেভাবে লাঞ্ছিত হয়েছে তার দায় কে বহন করবে?

আমরা ভিকটিমদের উচ্চতর আদালতে ন্যায়বিচারের জন্য আপিল করতে বলেছিলাম। চাকুরি হারানোর পাশাপাশি অধিকতর নির্যাতনের আশঙ্কায় তারা এ নিয়ে আর উচ্চবাচ্য করতে সম্মত হননি। একই ঘটনা ঘটেছে ২০১৪ সালে যশোরের মালোপাড়ার দুই ধর্ষিতা নারীর মামলার ক্ষেত্রে। আমরা তাদের মামলার যাবতীয় দায়িত্ব গ্রহণ করার পরও আসামীদের হুমকির কারণে তারা মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। ২০০৩ সালে খুলনার কালীগঞ্জে ধর্ষিতা রাধারাণীর মামলার ক্ষেত্রেও একই পরিণতি ঘটেছে।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভূতপূর্ব সভাপতি বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী ২০১০ সালে বলেছিলেন, এসব মামলার ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের সুরক্ষার পাশাপাশি সাক্ষীদের নিরাপত্তার দায়িত্বও রাষ্ট্রকে নিতে হবে। ধর্ষনের অভিযোগের ক্ষেত্রে বিচারপতি রাব্বানী বলেছিলেন, ভুক্তভোগী যদি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বলেন ‘ক’, ‘খ’ ব্যক্তি তার উপর নির্যাতন করেছে তাহলে সেই অভিযোগের ভিত্তিতে চার্জশীট করতে হবে এবং আসামীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।। সাক্ষীর অভাবে ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হবে এবং সন্ত্রাসী, ধর্ষক, ঘাতকরা সমাজে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াবে কোন সভ্য সমাজে এ ধরনের বিচারহীনতা কাম্য হতে পারে না।

তিনি বলেন, সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের জন্য ব্যক্তির শাস্তির পাশাপাশি ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য আমরা ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের আইনমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দিয়ে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলাম- অবিলম্বে ‘সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন’, ও ‘সাক্ষী নিরাপত্তা আইন’ প্রণয়ন সহ ‘জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন’ এবং পৃথক সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয়’ গঠন করবার জন্য। আইনমন্ত্রী আমাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন, যা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি।

শাহরিয়ার কবির আরও বলেন, আমরা সরকারের প্রতি আবারও আহ্বান জানাচ্ছি সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস দমনের জন্য এবং সাম্প্রদায়ক বৈষম্য ও নিপীড়ন বন্ধের জন্য আমাদের চার দফা দাবি দ্রুত বাস্তবায়ন করুন।

একই সঙ্গে আমরা দাবি জানাই যে উত্তম, রসরাজ ও রাকেশকে আসামী হিসেবে চিহ্নিত না করে প্রকৃত ভিকটিম হিসেবে বিবেচনা করে আইনি সহযোগিতা সহ প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা প্রদানের জন্য। ঠাকুরবাড়ির টিটু রায়কে গ্রেফতার করে যেদিন আদালতে হাজির করা হয় সাম্প্রদায়িক দুর্বত্তদের ভয়ে কেউ তার জামিনের জন্য দাঁড়ায়নি। নির্মূল কমিটি টিটু রায়ের মামলার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে।

শাহরিয়ার কবির জানান, নির্মূল কমিটির রংপুর জেলা শাখা ইতোমধ্যে সাতজন আইনজীবী নিযুক্ত করেছে টিটুর মামলা লড়বার জন্য। এরা হলেন (১) এডভোকেট ইন্দ্রজিৎ রায়, (২) এডভোকেট মাশরাফি মোঃ শিবলী (৩) এডভোকেট নরেশ চন্দ্র সরকার (৪) এডভোকেট রিয়াজুল আবেদীন লিটন (৫) এডভোকেট বিনয়ভূষণ রায় (৬) এডভোকেট কমল মজুমদার (৭) এডভোকেট জাকির হোসেন।

এই মামলার ভিকটিম টিটু রায়কে গ্রেফতারের পর বার বার রিমান্ডে নেয়া হলেও হামলাকারীদের কাউকে রিমান্ডে নেয়া হয়নি। নির্মূল কমিটি স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের এই সাম্প্রদায়িক আচরণের তীব্র নিন্দা করেছে।

টিটু রায়ের মুক্তির দাবির পাশাপাশি যারা তার নামে ফেসবুক জালিয়াতি করেছে, যারা ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে হামলার উস্কানি দিয়েছে, যারা নেপথ্যে থেকে অর্থ ও রসদের জোগান দিয়েছে এবং যারা হামলা করেছে তাদের সকলকে দ্রুত গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। হামলার প্রস্তুতি সম্পর্কে জানা সত্ত্বেও হামলার আগে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রশাসনের ব্যর্থতার জন্য যারা দায়ী যথাযথ তদন্ত করে তাদেরও বিচারের আওতায় আনার জন্য আমরা দাবি জানাচ্ছি।