ক্ষোভে আত্মহত্যা করেছেন ‘সিডরম্যান’ খ্যাত জয়দেব দত্ত

জয়দেব দত্ত

জয়দেব দত্ত

এলাকায় ‘সিডরম্যান’খ্যাত বরগুনার তালতলী উপজেলার জয়দেব দত্তর আত্মহত্যার ঘটনার সঙ্গে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগের সভাপতি মনিরুজ্জামান ওরফে মিন্টুর নামও এখন উচ্চারিত হচ্ছে। সদ্যোমৃত জয়দেবের পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, গতকাল রবিবারও চেয়ারম্যান খবর পাঠিয়েছেন ভিটে হস্তান্তর ও দলিল নিয়ে কথা বলার জন্য। প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডর আঘাত হানার পূর্বাভাস দিয়ে অন্তত পাঁচ হাজার অধিবাসীর জীবন বাঁচানোর ঘটনায় নায়কের মর্যাদা পেয়েছিলেন জয়দেব। উপজেলার বড়বগী ইউনিয়নের সিপিপির (ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি) ইউনিট প্রধান ও ওয়্যারলেস অপারেটর ছিলেন তিনি। গত ৫ আগস্ট স্থানীয় সিপিপির কক্ষ থেকেই তাঁর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। লাশের সঙ্গে পাওয়া সুইসাইড নোটে জয়দেব লিখেছেন, উপজেলা চেয়ারম্যান বাড়ি ছাড়ার জন্য অব্যাহতভাবে চাপ দেওয়ার কারণে তিনি বিপর্যস্ত ছিলেন।

জয়দেব লিখেছেন, ‘প্রত্যেক সংসারে জ্বালা-যন্ত্রণা থাকে, অভাব-অনটন থাকে মেনে নিয়েছি। অভাবে পড়ে মিন্টু চেয়ারম্যানের কাছে পৈতৃক ভিটি বিক্রি করেছি ২৮ লাখ টাকায়। আট লাখ টাকা বায়না নিয়েছি। বলেছি তাড়াতাড়ি দলিল করে নিন। এক বছর ধরে বলে (মিন্টু) টাকা দেব দেব, আমি বলছি মে-১৭ (২০১৭) মাসে ঘর ছেড়ে দেব।
বর্ষা আসলে মালামাল টানতে সমস্যা হবে। এখন বর্ষাকাল গতকাল্য ১-৮-১৭ তাং চেয়ারম্যান সাহেব বলেন, আগামী সোমবার (৬ আগস্ট) দলিল করব—ঘর ছেড়ে দিতে হবে। এত দিন টালবাহনা করলেন কেন? অভাবে পড়েছি বলে ভিটি বিক্রি করেছি। এখন বর্ষার মধ্যে কিভাবে যাব? আপনি ধনাঢ্য ব্যক্তি, দলিলের কাজ আগেই সমাধান করা উচিত ছিল। আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। ’ চার পাতার সুইসাইড নোটের পাশে লিখেছিলেন, ‘আমার পোস্টমোর্টেম করবেন না। ক্ষোভে আত্মহত্যার পথ বেছে নিলাম। ’

দুই ছেলের উদ্দেশে জয়দেব লিখেছেন, ‘প্রসেনজিত্-দেবজিত্, তোর মাকে দেখিস। খারাপ কাজ করিস না। মৃত্যু সবারই অবধারিত। আর জ্বালা সহ্য করতে পারি না। মিন্টু চেয়ারম্যান যদি দলিল নেয়—প্রসেন-দেবজিত্ তোরা দিয়ে দিস, আর যদি আট (লাখ টাকা) ফেরত নেয় সঞ্জীব দাস (শ্যালক), অ্যাডভোকেট জগদীশ, সঞ্জয় (ছোট ভাই)— তোরা আমার গ্রামের বাড়ি বিক্রি করে ব্যবস্থা নিস। ’ তিনি আরো লিখেছেন, ‘মানুষ মরণশীল। জীবনে অনেক ভালো কাজ করেছি। সমাজও আমাকে ভালো কাজের স্বীকৃতি দিয়েছে। সমাজের কাছে কৃতজ্ঞ। ’

এ ব্যাপারে জানতে গতকাল যোগাযোগ করা হলে তালতলী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান ওরফে মিন্টু মোবাইল ফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, জয়দেব শুধু তালতলীর নয়, গোটা উপকূলবাসীর সম্পদ ছিল। পারিবারিকভাবে সে সমস্যায় ছিল। আয়ের কোনো পথ ছিল না। তাই জয়দেব বাজারের ভিটি বিক্রির জন্য টাকা নিয়েছিল। তার ছোট ভাই সঞ্জয় দত্ত আমার কাছে ২৫ লাখ টাকায় ভিটি বিক্রি করেছে। চুক্তি অনুযায়ী মে মাসে দলিল দেওয়ার কথা ছিল। তখন আমার কাছে টাকা ছিল না। চলতি বছরের ৭ আগস্ট জমির দলিল দেওয়ার জন্য বলেছি। বৃষ্টির কারণে দলিল দেওয়ার এক মাস পর্যন্ত ওই ভিটিতে থাকার জন্য জয়দেব বলেছিল। আমি জয়দেবকে বলেছি, এক মাস কেন, যত দিন তোমার গ্রামের বাড়ি ঠিক না হবে, তত দিন ভিটা ছাড়ার প্রয়োজন নেই। ’

জয়দেব দত্তের বড় ছেলে প্রসেনজিত্ দত্ত কালের কণ্ঠ’র কাছে অভিযোগ করে বলেন, ‘মিন্টু চেয়ারম্যানের ভাই তারেকুজ্জামান তারেক আজ রবিবার সকালে আমাকে ডেকে নিয়ে জমির দলিলের ব্যাপারে চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করার জন্য বলেছেন। যে জমি নিয়ে বাবা চলে গেল, সেই জমির কারণেই আমার পরিবার এখন নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। ’ তিনি আরো বলেন, পৈতৃক ভিটা হাত ছাড়ার কারণে বাবা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। বাব-দাদার ভিটা হাত ছাড়া হতে দিব না। চেয়ারম্যান যদি ভিটা থেকে আমাদের তাড়িয়ে দেন, তা হলে আমাদের পরিবারের মাথা গোঁজার ঠাঁই থাকল না। এমনটি হলে এ দেশে থেকে লাভ কী?’

এ প্রসঙ্গে উপজেলা চেয়ারম্যান কালের কণ্ঠকে বলেছেন, ‘জয়দেব নেই, ওর পরিবার ভিটা ছাড়তে না চাইলে আমার আপত্তি নেই। ’ তালতলী থানার ওসি কমলেশ চন্দ্র হালদার বলেন, ‘চার পাতার সুইসাইড নোটটি সিজার লিস্টে রাখা হয়েছে। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট এখনো হাতে পাইনি। ’

এলাকাবাসী বলছে, তালতলী বাজারে জয়দেবের ভিটি লাগোয়া তাঁর ছোট ভাই সঞ্জয়ের সমপরিমাণের ভিটি ছিল। সেটি চেয়ারম্যান অনেকটা জোর করেই নামমাত্র মূল্যে কিনে নেন। পাঁচ শতাংশ জমিতে মার্কেট হবে না। তার জন্য চাই সমপরিমাণ আরো জমি। সে জন্যই জয়দেবের জমিটা নিতে আট লাখ টাকা বায়না করেন চেয়ারম্যান। স্থানীয় সূত্রমতে, পৈতৃক ভিটা বিক্রির অগ্রিম টাকা নেওয়ার পর থেকেই এক বছর ধরেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন জয়দেব।


সংবাদটি কালের কণ্ঠ পত্রিকা থেকে সংগৃহীত