খুলনাঞ্চল মাছ চাষের পাশাপাশি ধান চাষের জন্যও বিখ্যাত। কার্যত খুলনায় চালের সামন্য ঘাটতি থাকলেও সেটি খুব বেশি নয়, এছাড়া বেনাপোল স্থলবন্দর কাছে হওয়ায় সুযোগ থাকলে চালের আমদানিও কিছুটা সহজ, যদিও বাশমতি ছাড়া অন্য কোনো চাল ভারত এখন রপ্তানি করছে না। কিন্তু তুলনা করে দেখা গেছে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় খুলনায় চালের দাম বেশী, যদিও ব্যবসায়ীদের দাবী— ঢাকার তুলনায় খুলনায় চালের দাম যথেষ্ট কম। অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গিয়েছে— দশ থেকে বারো জন ব্যবসায়ী নিয়ন্ত্রণ করছে খুলনার চালের বাজার।
১. পলি এন্টারপ্রাইজ, প্রোপ্রাইটর: হাজী হায়দার
২. দিনাজপুর রাইস, ফারুক আহমেদ
৩. মেসার্স কুণ্ডু ট্রেডার্স, বাসুদেব কুণ্ডু
৪. কামাল ট্রেডার্স, কামাল
৫. সোবাহান অটোমেটিক রাইস মিলের মালিক কাজী নিজাম উদ্দিন
৬. মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন, মেসার্স বয়রা অটোমেটিক রাইস মিল
৭. আলহাজ্ব মোহাম্মদ মনির আহমেদ
৮. নিউ দিনাজপুর, শংকর
৯. লক্ষ্মী ভাণ্ডার,
১০. কুণ্ডু ট্রেডার্স, শংকর কুণ্ডু
খুলনার প্রভাবশালী অটোরাইস মিলগুলোর মধ্যে নিচের মিলগুলো অন্যতম। তবে অনেক মিলই ঠিকমতো চালাতে পারছেন না বলে জানান এসব মিলের মালিকেরা। খুলনার চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে এখন মূলত দু’টি রাইস মিল এবং তিন জন পাইকাড়। এর মধ্যে বাসুদেব কুণ্ডুর নামটি সচারচর এসে থাকে।
এছাড়া আরো কয়েকটি আতপ অটো রাইস মিল রয়েছে। মোহাম্মদ নাসির উদ্দিনের বয়রা আতপ অটো রাইস মিল রয়েছে, কাজী সোবাহানের আতপ অটো রাইস মিল রয়েছে জাবুসাতে। বটিয়াঘাটায় রয়েছে খান অটো রাইস মিল, মুজিবর অটো রাইস মিল, শিরোমনি খুলনাতে মাহাবুব ব্রাদার্স অটো রাইস মিল, ডুমুরিয়াতে জামান অটো রাইস মিল, নূর অটো রাইস মিল, ভাইয়া অটো রাইস মিল, কয়রাতে গাজী অটো রাইস মিল, সালেহা অটো রাইস মিল, একতা অটো রাইস মিল, সততা অটো রাইস মিল, সততা অটো রাইস মিল, ভাই ভাই অটো রাইস মিল। পাশাপাশি খুলনা জেয়ার দুই শতাধিক লাইসেন্সধারি হাস্কিং মিল রয়েছে।
জানা গেছে, খুলনায় চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে মাঝে মাঝে মিল মালিক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় করে প্রশাসন। চালের গুদামে অভিযান চালানো হয়, দেওয়া হয় লাইসেন্স বাতিলের হুঁশিয়ারি। তারপরও চালের দাম নিয়ন্ত্রণে আসছে না। আড়ৎ এবং দোকানগুলোতে মজুদ এবং বোর্ডে দাম উল্লেখ রাখার কথা থাকলেও বেশিরভাগ দোকানে তা নেই। বড় বাজারের পাইকাড়দের দাবী কয়েকটি বড় মিল মালিক এখন খুলনার চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। তবে কুণ্ডু ট্রেডার্সের বাসুদেব কুণ্ডুর মতো পাইকাড়দেরও দায়ী করলেন অনেক খুচরো ব্যবসায়ী।
বড় বাজারে মেসার্স উত্তরবঙ্গ খাদ্য ভাণ্ডারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়— তাদের চালের বর্তমান মজুদ ১২০০ বস্তা, যদিও অনুমোদন রয়েছে ৩০০০ বস্তার। পলি এন্টারপ্রাইজ বলছে তাদের মজুদ ৩০০০ বস্তা। কিন্তু ফলোআপ নিউজ খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছে পলি এন্টারপ্রাইজ এবং এ ধরনের বড় আড়ৎগুলোর মজুদ আসলে আরো কয়েক গুণ বেশি।
চালের নাম এবং দামের ক্ষেত্রে রয়েছে বড় ধরনের গড়মিল। টেবিলে সাজিয়ে রাখা চালের ঠিকমতো নাম নেই, নেই দাম লেখা। একই চাল বিভিন্ন মানের রয়েছে, ফলে ক্রেতাদের দিক থেকে বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। তবে উত্তরবঙ্গ খাদ্য ভাণ্ডারের পরিচালক কার্তিক সরকার জানালেন, আগে প্রতিদিন দাম লেখার বাধ্যবাধকতা থাকলেও এখন নেই। তবে ভোক্তা অধিকারের কর্মকর্তা জানিয়েছেন— দাম লেখা বাধ্যতামূলক এবং এটি না করলে শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। বড় বাজারের চালের পাইকাড়রা কে কোথা থেকে চাল নেন সেটি স্পষ্ট করে বলতে নারাজ। কিন্তু ভোক্তা অধিকারের আইন বলছে ক্রয় রশিদ সংরক্ষণ করতে হবে এবং বিক্রয়মূল্য প্রতিদিন দোকানে প্রদর্শন করতে হবে। খুলনা ভোক্তা অধিকারের কর্মকর্তা ওয়ালিদ বিন হাবিব বলছেন, প্রতিদিন তো লিখতেই হবে, এমনকি সকাল বিকাল মূল্য পরিবর্তন হলে সেটিও ঠিক করে নিতে হবে।
খুলনার চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, খুলনায় ধানের উৎপাদন কম। নওগা, দিনাজপুর ও কুষ্টিয়াসহ দেশের বড় বড় মোকাম থেকে চাল খুলনায় এনে ব্যবসায়ীরা বিক্রি করেন। বৃহৎ মিল মালিক ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলো সিন্ডিকেট করে চালের দাম বাড়াচ্ছে। এখানে খুলনার ব্যবসায়ীদের কিছু করার নেই।
বড় বড় কোম্পানিগুলো এখন চাল বস্তাজাত করে বের করছে একথা সত্য। যেমন, ফ্রেস, আকিজ, প্রাণ, এসিআই —এরা সবাই এখন চাল বের করছে। কিন্তু এ ধরনের কোম্পানিগুলো স্থানীয় মিলের সাথে দামে পেরে ওঠার কথা নয়, তারপরও কেন প্রতিযোগিতায় স্থানীয় মিলগুলো টিকতে পারছে না। বাজার ঘিরে দামের পার্থক্যের এ প্রমাণও পাওয়া গেলো। যেমন, ফ্রেস ২৮ চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৮ টাকা কেজি, যেখানে স্থানীয়ভাবে সেটি ৫৩/৫৪ টাকা। ফ্রেস ২৮ চালের দাম কামাল ট্রেডার্স জানালো ৫৮ টাকা কেজি। দোকানভেদে এতটা পার্থক্য বিস্ময়কর। খুচরা বিক্রেতারা জানালেন ব্রান্ড এবং চকচকে হওয়ার কারণে ক্রেতারা এ চালগুলো কিনতে চায়, আসলে এগুলো মানে ভালো নয়। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বয়রা অটোমেটিক রাইস মিলের স্বত্তাধিকারী মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন বলেন, মানুষের ব্রান্ডের প্রতি আগ্রহ বেশি, ফলে বেশি দাম দিয়ে হলেও তারা এই চাল কিনছে, যদিও মানের দিক থেকে এসব কর্পোরেট কোম্পানি পিছিয়ে রয়েছে। তিনি দাবী করেন— চালের দাম গত চার পাঁচ বছরে অন্যান্য পণ্যের তুলনায় খুব কমই বেড়েছে। অন্যদিকে উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণের খরচ বেড়েছে অনেক। তিনি বলেন, আমরা লাভ করছি চাল বিক্রি করে নয়, মিল থেকে যে বাইপ্রোডাক্ট আসে, সেটিই মূলত আমাদের লাভ।
কয়েকজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, মিল মালিকরা একই ধান দিয়ে বিভিন্ন ধরনের চাল বানান এবং বিভিন্ন দামে বিক্রি করেন। ফলোআপ নিউজ খোঁজ নিয়ে গোপন কিছু গুদামের কথা জানতে পেরেছে যেখানে বড় অংকের চাল মজুদ করা হয়। এ পর্যন্ত খুলনার তিনটি প্রতিষ্ঠানের এরকম মজুদের তথ্য মিলেছে।
খুলনার অন্যতম বড় চালের মোকাম বড় বাজারের চাল ব্যবসায়ী কুন্ডু ট্রেডার্সের মালিক শংকর কুন্ডু বলেন, কুষ্টিয়া, যশোর ও দিনাজপুর অঞ্চল থেকে চাল আসে এখানে। মিল মালিকরা দাম বাড়ালে তবেই দাম বাড়ে। খুচরা বিক্রেতারা সরাসরি এখন মিল থেকে মাল নেয়, ফলে দাম বৃদ্ধিতে আমাদের কোনো করণীয় নেই। মজুদ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে তিনি জানান— মিল মালিকরাই মজুদ করছে। তবে বয়রা অটো রাইস মিলের স্বত্তাধিকারী নাসির উদ্দিন জানান— সিন্ডিকেট এবং মজুদের বিষয়টি সত্য নয়, এভাবে চালের ব্যবসা হয় না। ধানের দাম, লেবার কস্ট, মিলের অন্যান্য খরচ, সব মিলিয়ে দাম আসে। সবাইই বিক্রির জন্য মরিয়া, এখানে সিন্ডিকেট করার কোনো সুযোগ নেই।