খুলনা থেকে পরিচালিত ২০ টি নৌপথের এখন অবশিষ্ট আছে মাত্র ৪/৫টি

খুলনা থেকে এক সময়ে ২০টিরও বেশি নৌপথে যাত্রীবাহী লঞ্চ, পণ্যবাহী জাহাজ ও কার্গোসহ বিভিন্ন ধরনের নৌযান চলাচল করত। জলবায়ু পরিবর্তন, নাব্যতা কমে যাওয়া, নদীর তীর অবৈধ দখলসহ বিভিন্ন কারণে অনেক নদী এখন মৃতপ্রায়। একের পর এক নদীতে পানি কমতে থাকায় গত এক যুগে নৌ পথের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪-৫টি। এতে খুলনা অঞ্চলের নদীকেন্দ্রিক অর্থনীতি অনেকটা থমকে গেছে। অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অতিরিক্ত খরচ দিয়ে সড়কপথে পণ্য পরিবহন করতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের।

সরেজমিন দেখা যায়, খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার শোলমারি নদীতে চর পড়ে এখন মৃতপ্রায়। অথচ বছর পাঁচ-ছয় আগেও এই নদী দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থান বড় নৌযানে পাট, সার, সবজিসহ বিভিন্ন পণ্য খুলনায় আসতো। আবার খুলনা থেকেও বিভিন্ন স্থানে যেত। শুধু এই নদী নয়, নাব্যতা হারিয়ে অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়েছে খুলনার অধিকাংশ নদ-নদী।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) সূত্র জানায়, চলাচলের উপযোগী না হওয়ায় খুলনা থেকে এমন অন্তত ১৫টি রুটে চলছে না বাণিজ্যিক নৌ-যান। খুলনা বিভাগের ৭৮টি নদীর মধ্যে খুলনার হাড়িয়া, ময়ূর, হামকুড়া, কচা, শেলা ও বাগেরহাটের ভোলা, হাওড়া, সড়া, যমুনা, রামসাগর, সাতক্ষীরার সোনাই, কুষ্টিয়ার টেকাসহ ২৫টি নদী এরই মধ্যে মরে গেছে। এ ছাড়াও ১০টি নদী শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
এর মধ্যে কুষ্টিয়া, যশোর, বরিশালের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পণ্যবাহী ভারী নৌযান চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ফলে নদীর আশেপাশে গড়া ওঠা বিভিন্ন বাণিজ্য কেন্দ্রও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। খুলনা অঞ্চল থেকে বর্তমানে গড়ে প্রতিবছর নদী পথে পণ্য আনা নেয়া হয় ৩০০ কোটি টাকার মতো, যেটি সাত বছর আগের থেকে অন্তত ১৫০ কোটি টাকার কম। এতে করে খুলনা অঞ্চল থেকে নদী কেন্দ্রিক বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল মানুষের আয়ও কমেছে।
খুলনা নৌ-বন্দর এলাকায় প্রায় ২৫ বছর ধরে শ্রমিকের কাজ করেন সুরুজ আলী। তিনি জানান, ১২ বছর আগেও এই নদীর অর্ধেকটা জুড়ে বিভিন্ন জাহাজ দাঁড়িয়ে থাকতো। আমরা কাজ করে শেষ করতে পারতাম না। একটার পর একটা পণ্যবাহী লঞ্চ জাহাজ প্রবেশ করতো। তবে এখন তাকিয়ে দেখেন মাত্র কয়টা জাহাজ। আমাদের এই এলাকায় ৪ হাজারের বেশী শ্রমিক কাজ করতো। এখন কাজ না থাকায় তাদের অনেকেই অন্য পেশায় চলে গেছে।

খুলনা নদী বন্দর এলাকায় ব্যবসা করেন জাহিদ হাসান। ‍তিনি বলেন, কুষ্টিয়া থেকে বালি আনতাম নদী পথে। তবে গত পাঁচ বছরেরও বেশী সময় ধরে এই পথে আমি বালু আনতে পারি না। ফলে সড়ক পথে বেশী টাকা খরচ করে আমাদের পণ্য আনতে হয়। এতে একদিকে যেমন খরচ বেশী হয়, তেমনি সড়ক পথে ঝুঁকিও বেশী। আর তাতে পণ্যের দামও বেড়ে যায়।

সড়কপথে পণ্য পরিবহনে বাড়তি খরচ হয় জানিয়ে ব্যবসায়ীরা বলছেন, নৌ-রুটগুলো চালু করতে পারলে এ অঞ্চলে নদী কেন্দ্রিক অর্থনীতির চাকা আবার সচল হবে।

খুলনা বিভাগীয় আভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন মালিক সমিতির কোষাধ্যক্ষ চৌধুরী মিনহাজ উজ জামান সজল জানান, নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। নদী না থাকলে আমাদের ব্যবসাই তো থাকবে না। আমরা নদীপথ ব্যবহার করেই বেঁচে আছি। মোংলায় এখন অনেক বেশী জাহাজ ভেড়ে দেশের বাইরে থেকে। সেই পণ্যগুলো আমরা নদীপথে খুলনা পর্যন্ত আনতে পারলেও দেশের অন্যান্য প্রান্তে পাঠাতে পারি না। নদীগুলো ড্রেজিং করে নৌরুটগুলো চালু করা খুবই প্রয়োজন। আমরা বারবার নদীপথগুলো সংস্কারের জন্য আবেদন করেও কোন সাড়া পাইনি।

এদিকে নদী বন্দর কর্তৃপক্ষ ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদী পুনরুদ্ধার করে বন্ধ হওয়া নৌ রুটগুলো পুনরায় চালুর উদ্যোগের কথা বললেও তা পরিকল্পনাতেই সীমাবদ্ধ। খুলনা নদী বন্দর কর্তৃপক্ষের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ মাসুদ পারভেজ বছর দুই আগে বলেছিলেন, আমরা অন্তত ২০টি পয়েন্টে নদী খননের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত জানিয়েছি। এটি এখন প্রক্রিয়াধীন। আশা করি দ্রুত ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে নদীপথগুলো সচল করতে পারবো।

বর্তমানে মোংলা বন্দর থেকে নৌপথে পণ্য আসছে খুলনায়। এ ছাড়া কাউখালি থেকে খুলনা হয়ে নওয়াপাড়া, খুলনা থেকে আংটিহারা ও চালনা রুটে পণ্য আনা নেয়া হয়। আর খুলনা থেকে কয়রা পর্যন্ত একমাত্র রুটে যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল করে।