সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু গত ২৮ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির এক অনুষ্ঠানে অভিযোগ করে বলেন, ‘আদালতের আঠারো ঘাটে পয়সা গুনতে হয় বিচারপ্রার্থীদের। উকিল, মুহুরি, পিয়ন, পেশকার ও পুলিশ সবাইকে টাকা দিতে হয়। একজন বিচারপ্রার্থী আসে সেবা নিতে, কিন্তু টাকা গুনতে গুনতে তাকে হয়রানির মধ্যে পড়তে হয়। ’
বিচারপ্রার্থীদের আদালতে ঘাটে ঘাটে নিয়মবহির্ভূত যে অর্থ গুনতে হয় কর্মচারীরা তাকে বলেন ‘বকশিশ’ বা ‘খরচাপাতি’। আদালতে এই বকশিশ আদান-প্রদান নতুন নয়। তবে আগে এই বকশিশের নির্ধারিত হার ছিল না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নির্ধারিত হারে বকশিশ দেওয়াটা বিচারপ্রার্থীদের জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে পড়েছে। মামলার নথি দেখা, হাজিরা দেওয়া, ওকালতনামায় সই করা, জামিননামা দেওয়া, জামিনের শুনানি করা, মামলার নকল তোলাসহ মামলাসংক্রান্ত যেকোনো সেবায় এ বকশিশ বা খরচাপাতি ছাড়া এখন চলেই না। এসব বকশিশ বা খরচাপাতি বিচারপ্রার্থীদের কাছ থেকে নেওয়া হয় আইনজীবী অথবা আইনজীবী সহকারীদের মাধ্যমে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে বিচারপ্রার্থীদের হয়রানি বা ভোগান্তিতে পড়তে হয়। আদালতে এসব বকশিশ বা খরচাপাতির ব্যবস্থা চরম দুর্নীতির বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করেন আইনজীবীরা। কিন্তু এই দুর্নীতি ঠেকানোর কোনো উদ্যোগ নেই। এ বিষয়ে নেই কোনো নজরদারিও। আদালতসংশ্লিষ্ট সবার সামনেই ঘটছে এসব। কিন্তু সবাই নীরব। এ নীরবতার সুযোগ নিয়ে উত্সাহিত হয় আদালতের এক শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী।
কয়েকজন প্রবীণ আইনজীবী জানান, আগেও এসব ছিল; কিন্তু বকশিশ কত দিতে হবে তা ধরাবাঁধা ছিল না। এখন প্রতিটি ধাপে একটি নির্ধারিত সীমা বেঁধে দিয়েছেন কর্মচারী ও আদালত-পুলিশ। ওই সীমার নিচে বকশিশ দেওয়া যায় না। নির্ধারিত হারে না দিলে কী হয় জানতে চাইলে ঢাকার প্রবীণ আইনজীবী শাহজাহান খান কালের কণ্ঠকে বলেন, পরবর্তী সময়ে ওই আইনজীবী অন্য কোনো মামলা নিয়ে গেলে তাঁকে সংশ্লিষ্ট কর্মচারী বা পুলিশ সহযোগিতা করে না। আদালত-পুলিশ ও কর্মচারীদের হাতে অনেকটা জিম্মি আইনজীবীরা। তিনি আরো বলেন, ‘এসব খরচাপাতি বা বকশিশ বিচারপ্রার্থীর কাছ থেকেই নেওয়া হয়। সব চাপ তাদের ওপর। আর্থিক সমস্যা থাকলে মামলার টাকা ভূতে জোগায়—এমন কথার প্রচলন আছে। টাকা কোনোমতে জোগাড় করে মামলায় খরচ করে ঠিকই, কিন্তু অনেক বিচারপ্রার্থী এতে নিঃস্ব হয়ে যায়। এ জন্য সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া উচিত। এটা বন্ধ হওয়া উচিত। না হলে ভবিষ্যতে চাল-আটার দামের মতো এই খরচাপাতি ও বকশিশও বেড়ে যাবে। ’
আইনজীবী, আইনজীবী সহকারী ও বিচারপ্রার্থী বা তাদের তদবিরকারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মামলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চলে অবৈধ বকশিশ বাণিজ্য, যার সবটাই বহন করতে হয় বিচারপ্রার্থীকে। দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক পিপি অ্যাডভোকেট কবির হোসেন বলেন, ‘আদালতে ঘাটে ঘাটে পয়সা দিতে হয়। পুলিশ, পেশকার, পিয়ন, আরদালি, উমেদার—এরা অবৈধভাবে এসব পয়সা বিচারপ্রার্থীদের কাছ থেকে নিয়ে থাকে। এটা চরম দুর্নীতি। আর এই দুর্নীতির অর্থ শুধু যে কর্মচারীরা নেয় তা নয়, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও ভাগ দিতে হয়। আবার এসব স্থানে বদলি হয়ে আসেও মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে। অনেক ক্ষেত্রে আদালতের কর্মচারীরাও ঘুষ দিয়ে চাকরি নেয়। পুরো ব্যবস্থা পাল্টে ফেলতে না পারলে এগুলো বন্ধ হবে না। ’
মামলা থানায় দায়ের হওয়ার পরই এজাহার পাঠিয়ে দেওয়া হয় আদালতে। আসামি গ্রেপ্তার হলেও পুলিশ প্রতিবেদনসহ আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়। শুরু হয় আসামির আইনি লড়াই। ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করতে হলে গ্রেপ্তারের কারণ তাকে জানাতে হবে। আসামি যদি তার বিরুদ্ধে থাকা লিখিত অভিযোগ পড়তে চায় তবে তাকে তা পড়তে দিতে হবে। কিন্তু এ দেশে পুলিশ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আসামিকে গ্রেপ্তারের কারণ জানায় না। সে ক্ষেত্রে আদালতে পাঠানোর পরই আইনজীবীকে মামলার এজাহার ও গ্রেপ্তারসংক্রান্ত প্রতিবেদন খুঁজতে হয়। থানায় করা মামলার এজাহার আদালত থেকে ফটোকপি দেওয়ার একটি প্রথা চালু হয়েছে। যদিও আইনে ফটোকপি দেওয়া বা অনুলিপি তাত্ক্ষণিকভাবে দেওয়ার বিধান নেই। তবু আসামিপক্ষ তা সংগ্রহ করে। আইনজীবীরা জানান, এই এজাহার আদালতের পুলিশ প্রসিকিউশন বিভাগের জিআর (সাধারণ নিবন্ধন) শাখায় থাকে। সংশ্লিষ্ট আদালতের জিআর শাখায় পুলিশকে কমপক্ষে ২০০ টাকা দিয়ে মামলার এসব কাগজপত্র তুলতে হয়। মামলার গুরুত্ব অনুযায়ী অনেক ক্ষেত্রে ৫০০ বা হাজার টাকাও দিতে হয় পুলিশকে।
ওকালতনামায় সই করতেও টাকা : আইন অনুযায়ী আইনি লড়াই শুরু করতে সংশ্লিষ্ট আইনজীবী সমিতির কোনো আইনজীবীকে আসামির ক্ষমতাপত্র দিতে হয়। এই ক্ষমতাপত্রই হচ্ছে ওকালতনামা। আইনজীবী সমিতির ছাপানো নির্ধারিত ওকালতনামায় আসামির সই নিতে হয়। আসামি আদালতের হাজতখানা বা কারাগারে থাকলে সেখান থেকে ওকালতনামায় আসামির সই আনতে হয়। এর জন্য আসামিপক্ষ থেকে ৫০-৫০০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়।
ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে ওকালতনামায় সই নিতে একটি সেল রয়েছে। ওই সেলে সিএমএম আদালতের কর্মচারীরা কাজ করেন। জানা গেছে, সেখানে ওকালতনামা পূরণ করে জমা দেওয়া হয়। আইনজীবীরা জানান, আদালতের হাজতখানা থেকে ওকালতনামায় সই নিতে ৪০ থেকে ১০০ টাকা, আর কারাগার থেকে ওকালতনামায় সই নিতে ১০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়।
ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সিজেএম) আদালতে এ ধরনের কোনো সেল নেই। গত ১৮ মার্চ ওই আদালতের হাজতখানায় গিয়ে দেখা যায়, আইনজীবীরা হাজতখানার পুলিশের মাধ্যমে আসামির সই নিচ্ছেন। এ জন্য আসামি প্রতি কেউ ১০০, কেউ ২০০ টাকা করে দিচ্ছেন। প্রকাশ্যে এসব টাকা নেওয়া হয়। সারা দেশের আদালতের হাজতখানায়ই এমন দৃশ্য দেখা যায়।
জামিন আবেদন : সারা দেশের আদালতগুলোতে প্রতিদিন কারাবন্দি আসামিদের জামিন আবেদন করা হয়। জামিন আবেদনটি শুনানির জন্য আদালতের অনুমতি নিতে হয়। আদালতের ভাষায় একে বলে ‘পুটআপ’ নেওয়া, অর্থৎ জামিন শুনানির জন্য নথি উপস্থাপন করার নির্দেশ। এই পুটআপ নিতে সংশ্লিষ্ট আদালতের কর্মচারী, পিয়ন, উমেদারদের ৫০ থেকে ১০০ টাকা বখশিশ দিতে হয়।
জামিন হলে তো কথাই নেই : কোনো আসামির জামিন হলে কয়েকটি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর আসামির রিলিজ অর্ডার বা মুক্তিনামা কারাগারে পাঠানো হয়। এর মধ্যে পুলিশের জিআর শাখায় জামিননামা দাখিল করলে সংশ্লিষ্ট জিআরও জামিননামা যাচাই করেন। এটিকে বলে ‘সিএফ’। এই সিএফ করা হয় একটি স্বাক্ষরের মাধ্যমে। এ জন্য জিআরওকে ২০০ থেকে হাজার হাজার টাকাও দিতে হয়। ঢাকার সিএমএম আদালতে প্রতিদিনই এমন ঘটনা দেখা যায়। মামলার গুরুত্ব অনুযায়ী জিআরওকে টাকা দিতে হয়। প্রতিটি থানার মামলা তদারকির জন্য এরকম জিআরও থাকেন। জামিনে আপত্তি না করলে এক রকম, আপত্তি করলে এক রকম টাকা লাগে। এর আগে জামিননামা পিআর বা সম্পত্তি নিবন্ধন করতে হয়। পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর মর্যাদার একজন কর্মকর্তা পিআরও হিসেবে নিয়োজিত থাকেন। যিনি আসামির জামিনদার তিনি উপযুক্ত কি না তা যাচাই করেন পিআরও। এ জন্য ৪০-৫০ টাকা দিতে হয় পিআরওকে। পরে জামিননামা দাখিল করা হয়েছে তা লেখা এবং রিলিজ অর্ডার কারাগারে পাঠানোর জন্য ডেচপাস শাখায় পাঠাতে হয়। এ ক্ষেত্রেও ১০০ থেকে ২০০ বা তার বেশি টাকা জিআর শাখার মুন্সীকে (সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্য) দিতে হয়।
বিশেষ ব্যবস্থায় রিলিজ অর্ডার পাঠানো : দিনে দু-তিনবার ডাকযোগে আসামির রিলিজ অর্ডার কারাগারে পাঠানো হয়। তবে জরুরি ভিত্তিতে আসামিকে কারাগার থেকে মুক্ত করতে হাজারের বেশি টাকা গুনতে হয় আসামির স্বজনদের।
হাজিরায় টাকা : আসামির জামিন হওয়ার পর প্রতি মাসে দু-একবার বা আদালতের নির্ধারিত তারিখে আসামিকে হাজির হতে হয়। জিআর শাখার মাধ্যমে তদন্তাধীন মামলায় আদালতে হাজিরা দিতে হয়। আর বিচারাধীন মামলায় বিচারিক আদালতে হাজিরা দিতে হয়। আইনজীবীরা জানান, প্রতি আসামিকে হাজিরা দিতে জিআর শাখায় সংশ্লিষ্ট থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশকে ৫০ থেকে ১০০ টাকা বা তারও বেশি করে দিতে হয়। আবার বিচারাধীন মামলায়ও একই হারে টাকা দিতে হয় পেশকার ও পিয়নদের। আসামি খালাস পেলে, অব্যাহতি পেলে তো টাকা গুনতেই হয়।
জরিমানার অতিরিক্ত জরিমানা : মহানগর পুলিশ অধ্যাদেশ বা ছোটখাটো মামলার ক্ষেত্রে আসামিরা দোষ স্বীকার করলে জরিমানার বিধান রয়েছে। আদালত জরিমানা করেন। সংশ্লিষ্ট আদালতের পেশকার ও পিয়নরা জরিমানার ওপর আরো কিছু ‘জরিমানা’ ধার্য করেন। গত ১৮ মার্চ ঢাকার সিএমএম আদালতের ৬ নম্বর আদালতে গিয়ে দেখা যায় আদালত যে আসামির যে পরিমাণ জরিমানা করেছেন তার চেয়ে ৫০-১০০ টাকা করে বেশি নিচ্ছেন পেশকার ও পিয়ন। আবার জরিমানার স্লিপ নিয়ে ওই আদালতের হাজতখানায় গেলে সেখানকার পুলিশ ১০০ টাকা নিয়ে আসামি ছাড়ছে।
ঢাকার সিজেএম আদালতে এসব মামলার ক্ষেত্রে আদালতের পেশকার, পিয়ন আরো বেশি টাকা নেন বলে আইনজীবীরা জানান। আর ওই আদালতের হাজতখানার দায়িত্বরত পুলিশদের ২০০ থেকে হাজার টাকাও দিতে হয়।
সংবাদ : কালের কণ্ঠ