Headlines

ধর্মাবমাননার গুজব রটানোর সেই পুরনো ছক: উদ্দেশ্য সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা এবং তাদের বাড়িঘরে লুটপাট

বোরহানউদ্দিন, ভোলা

রামু, নাসিরনগরের পর এবার ভোলার বোরহানউদ্দিন, একই পদ্ধতিতে ধর্মাবমাননার গুজব রটিয়ে দাঙ্গা এবং হামলার পরিবেশ সৃষ্টি করা। সংখ্যালঘুদের পাশাপাশি এবার তাদের লক্ষ্য ছিল পুলিশ বাহিনীকেও নাজেহাল করা।

বিপ্লব চন্দ্র শুভ (বিপ্লব চন্দ্র বৈদ্য) নামের ফেসবুক আইডি থেকে ইসলামের নবীকে কটুক্তি করার খবর ছড়ানোর দুদিন পরে ভোলায় সৃষ্টি হয়েছিল সহিংস পরিস্থিতি, যাতে প্রাণ যায় চারজনের, শতাধিক সাধারণ লোকের পাশাপাশি আহত হয় দুজন পুলিশ সদস্যও। হামলা, লুটপাট এবং ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে বোরহানউদ্দিন পৌরসভার ৫নং ওয়ার্ডে, রবীন্দ্রপল্লীখ্যাত ভাওয়াল বাড়িতে। ২০ অক্টোবর বোরহানউদ্দিন ঈদগাহ্ মাঠে বিক্ষোভ করে ফেরার পথে ‘তৌহিদী জনতা’ হিন্দু পাড়ায় ১টি মন্দির এবং ১২টি বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট এবং মারধরের ঘটনা ঘটায়। ভুক্তভোগীদের ভাষ্য অনুযায়ী এতে তাদের সম্মান এবং সম্ভ্রমহানীর পাশাপাশি পঞ্চাশ লক্ষাধিক টাকার আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়।

https://youtu.be/f9DB9BopRwo?t=51

বিপ্লবের গ্রামবাসীরা জানে বিপ্লব নির্দোষ

বিপ্লবের বাড়ি ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের খাড়াকান্দি গ্রামে। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে আমরা কথা বলেছি গ্রামবাসীর সাথে। গ্রামে ঢুকতে নন্দলাল বৈদ্যের চায়ের দোকানে কথা হয় পেশাশ্রমিক আব্দুল মোতালেব মালের সাথে।

তিনি বলেন, “এগুলো ষড়যন্ত্র, আমাদের মতো কাম করে খাওয়া মানুষ এসবের মধ্যে যায় না। বিপ্লবরে আমি চিনি, বিপ্লব এ কাম করতে পারত না। মোবাইল ফেসবুক আমি বুঝি না, তবে এইডা বুঝি যে একজনের খাতায় আরেকজনে কিছু লেখতে পারে।”

তিনি আরো বলেন, “এই গ্রামে এক সময় হিন্দুই বেশি ছিল। ৯২ এবং ২০০১-এর দাঙ্গার পর চলে গ্যাছে। অহন উর্দ্ধে বিশ ঘর হিন্দু থাকবার পারে। তাও এবার চলে যাইব। হিন্দু থাকলে সমস্যাডা কী এইডা আমি বুঝবার পারি না। তাগো ধর্ম তারা করব আমগো ধর্ম আমরা করব, এতে সমস্যা তো কিছু নেই। এই যে হিন্দু বাড়িতে কীর্তন গান হয় আমি তো সহযোগিতা করি। গিয়ে খাড়ায়ে থাহি, যাতে পোলামান আইসে কোনো সমস্যা করতে না পারে।  

আর একটু এগিয়ে বিপ্লদের বাড়ি ঢোকার মুখে চোখে পড়ল আর্মড পুলিশ ব্যাটেলিয়নের ছয়জন পুলিশ সদস্য। তাদের সাথে কথা বলে আমরা প্রবেশ করলাম বিপ্লবদের বাড়িতে। গ্রামের সাধারণ বাড়ি, এদিক ওদিক তাকালে বোঝা যায় বাড়িতে কেবল একটু স্বচ্ছলতার ছোয়া লেগেছে। বাড়িতে এক ধরনের থমথমে পরিবেশ, কেউই ঘর থেকে বেরিয়ে এসে কথা বলতে সাহস করছে না। আমাদের সাথে থাকা পুলিশ সদস্য অভয় দিলে বেরিয়ে আসে বিপ্লবের কাকি মৃদুলা রাণী।  

তিনি বলেন, “বিপ্লব দায়ী না। এটা একটি ষড়যন্ত্রমূলক ঘটনা। বিপ্লব ছোটোবেলা থেবেই সরল সোজা, ওর মধ্যে কোনো কপটতা নেই। আমার বিয়ে হইছে পঁচিশ ছাব্বিশ বছর, ছোটোবেলা থেকেই ওকে দেখছি, ও কোনোভাবেই এরকম না।”

ঘটনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “ঐদিন বারে বারে ফোন আসতে থাকে। তারা বলে, ‘বিপ্লব তুমি এসব কী লিখছো!’ বিপ্লব তো কোনো হদিস পায় না, এরপর তারা বলে, ‘আপনি আপনার মোবাইলটা চেক করেন। তাড়াতাড়ি থানায় গিয়ে জিডি করেন।’ এরপর বিপ্লব থানায় যায়।”

নিরাপত্তা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, “আইন শৃঙ্খলা বাহিনী নিরাপত্তা দিচ্ছে, আমরা নিরাপদ বোধ করছি।

তবে এ সময় বিপ্লবের কাকা অসীম বৈদ্য, পিতা প্রাণ কুমার বৈদ্য বলেন, “আমরা আসলে নিরাপদ বোধ করছি না। বাইরে যেতে পারছি না। অনেকে অনেক কিছু সমালোচনা করে। লোকজনে বলাবলি করছে, ‘কতদিন পুলিশ পাহারা দিবে, এরপর আমরা দেখব।’

মূলত কাহিনী টা হচ্ছে, বিপ্লব সকাল দশটা পর্যন্ত ফেসবুকে ছিল। এরপর ফোন ঘরে রেখে বিপ্লব মাঠে যায় কাজ করতে। আমি আবার গ্রামে সুপারী তুলেছি কালি পূজার জন্য। বিপ্লব আসে বেলা ১টার দিকে। খাওয়া দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়ে। এ পর্যন্ত বিপ্লব ফোন হাতে নেয়নি। আমিও ঘুম ছিলাম। এরপর বেলা চারটার দিকে কাতার থেকে একটা ফোন আসে। বলে, ‘বিপ্লব, তুমি ফেসবুকে এসব কী ছাড়তেছো।’ বিপ্লব তখন বলে, ‘না, আমি তো কিছুই ছাড়তেছি না, আমার ফোনে নেট নেই, ফোন তো ঘরে পড়ে আছে।’ বিপ্লব আমাকে ডাক দেয়। একসাথে বের হয়ে আমরা বাজারের দিকে রওনা হই। পথে একটা ছেলের সাথে দেখা হয়, তার নাম মীজান, মিজান বলে, ‘বিপ্লব, তুমি এসব কী লিখতাছো।’ মীজানের সাথে যে সময় আমাদের দেখা তখন মীজান বিপ্লবের আইডির সাথে কথা বলতেছে। হঠাত মীজান মিপ্লবের হাত থেকে মোবাইল নিয়ে নেয়। দেখে তখনও বিপ্লবের আইডিতে কথা চলতেছে। তখন মিজানও বুঝতে পারে যে বিপ্লবের আইডি হ্যাকড্ হয়েছে। মিজান তখন বলে, ‘আপনার কারো সহযোগিতা নিয়ে থানায় একটা জিডি করার ব্যবস্থা করেন, না হলে সমস্যায় পড়ে যাবেন।’

এরপর আমরা বোরহানগঞ্জ বাজারের দিকে যাই। ওখানে আমাদের অনেক সিনিয়র ভাই আছে। তাদের সাথে কথা বলার পর আমরা থানায় গিয়ে জিডি করি। থানায় যখন দোতলা থেকে নিচে নামি তখন একটা ফোন আসে। পরিচয় দেয় গাজিপুর থানার ওসি। বলে, ‘বিপ্লব, তোমার আইডি কি হ্যাকড্ হয়েছে?’ বিপ্লব বলে, ‘হঁ্যা, আমরা আইডি হ্যাকড্ হয়েছে, নবিজির নামে খারাপ খারাপ কথা নাকি ছড়ানো হচ্ছে।’ এরপর ঐ ব্যক্তি বলে, ‘তুমি কি তোমার আইডি ফিরিয়ে নিতে চাও?’ বিপ্লব বলে, ‘না, আমি আমার আইডি ফিরিয়ে নিতে চাই না, আপনি আইডিটা রিমুভ করে দেন।’ এরপর ঐ ব্যক্তি একটা বিকাশ নম্বর দিয়ে বলে টাকা পাঠিয়ে দাও।”

আমাদের কথা বলতে দেখে এগিয়ে আসেন বিপ্লবদের প্রতিবেশী আনিসুল হক। স্বতস্ফুর্তভাবে তিনি কথা বলতে চান আমাদের সাথে। তিনি বলেন, “ঘটনা যেই ঘটাক তার শাস্তি হওয়া দরকার। বিপ্লব ঘটনা ঘটায়নি। আমরা কেউ সেরকম কিছু জানি না। রামু, নাসির নগরের ঘটনা আমরা জানি, এটাও সেরকম একটি ঘটনা। ”

আমরা বিপ্লবের বাবা-মা কে খোঁজ করি। অনেক ডাকাডাকির পর বিপ্লবের মা বেরিয়ে আসেন। তিনি তখন একেবারেই অপ্রকৃতিস্থ। কথা বলার মতো অবস্থাতে নেই। তিনি একটু স্বাভাবিক হওয়ার পর ঘরে গিয়ে তার সাথে কথা বলি।  

বিপ্লবের মায়ের সাথে কথা বলে জানা যায় তাদের পরিবারটি আগে থেকেই আক্রান্ত। বিপ্লবের বড় দুই ভাই ওমান থাকেন। দুই ছেলে বিদেশ থাকার কারণে যেহেতু পরিবারটি একটু স্বচ্ছল হয়েছে, ফলে তারা অনেকের চক্ষুশুল হয়েছে। সম্প্রতি (কয়েক মাস আগে) জমিজমা সংক্রান্ত একটি ঝামেলায় বিপ্লবের মা এবং বৌদিকে মেরে আহত করে গিয়াস উদ্দিন গং রা।

পরবর্তী প্রশাসন এবং থানা-পুলিশের হস্তক্ষেপে ক্রয়কৃত জমি ফিরে পান তারা।  বিপ্লবের মা মনে করেন- এই ঘটনার সাথে বর্তমান ঘটনার যোগসূত্র রয়েছে। স্থানীয় মেম্বার আব্দুর রাজ্জাক ও সে কথা বললেন, ষড়যন্ত্রের শুরুটা এখান থেকে হয়ে থাকতে পারে বলে তিনি মত দেন। ঘটনার শুরু থেকেই স্থানীয় (২ নং ওয়ার্ড) মেম্বার আব্দুর রাজ্জাক বিপ্লবদের পাশে দাঁড়িয়েছে।

বিপ্লবের স্বজন এবং প্রতিবেশীর অভিযোগ রয়েছে যে কাচিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শান্তি বজায় রাখতে দৃশ্যত কোনো ভূমিকা রাখেননি, এমনকি তিনি বিপ্লবদের বাড়িতে গিয়ে বিপ্লবের বাবা-মা কে শান্তনা দেওয়ার কাজটিও করেননি। যদিও চেয়ারম্যান এ অভিযোগ স্বীকার করছেন না। চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আ: রব কাজী বলছেন, “আমি ১৮ অক্টোবর তারিখ বিপ্লবদের বাড়ি গিয়েছিলাম, তবে কাউকে পাইনি। আইডি হ্যাকড্ হওয়ার ঘটনা জানার পর থেকেই আমি পরিবেশ শান্ত রাখার চেষ্টা করেছি, এখনও চেষ্টা করে যাচ্ছি।”

সংঘর্ষের একদিন আগেও সব ঠিকঠাক ছিল, বলা হচ্ছে, পুলিশকে অন্ধকারে রেখে ঘটনা ঘটিয়েছে কতিথ আলেম সমাজ

কথিত ধর্মাবমাননাকর স্টাটাস নিয়ে কোনো ধরনের সহিংসতার সম্ভাবনা ছিল না বলে দাবি করেছেন ভোলার পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সার।

সংঘর্ষের আগের দুদিন ধরেই বিপ্লবকে নিয়ে পুলিশ প্রশাসন, অভিযুক্ত হ্যাকার এবং আলেম সমাজে চলে নানামুখী তৎপরতা।

১৮ অক্টোবর বিপ্লব বোরহানউদ্দিন থানায় করা জিডিতে উল্লেখ করে, ‘তার ফেইসবুক আইডি হ্যাক করে অন্য কেউ ইসলামের নবীকে কটুক্তি করে পোস্ট এবং মেসেজ পাঠাচ্ছে।’ জিডি করতে বিপ্লবের সঙ্গে গিয়েছিলেন তার চাচা অসীম কুমার বৈদ্য। ফেসবুক আইডি হ্যাকড্ হওয়া এবং জিডির বিষয়টি বিপ্লবের গ্রামবাসীও অবগত।

পুলিশ সুপার বলেন, “আলেম সমাজ আমাকে বিভ্রান্ত করেছে। তারা বলেছিল, কিছু কথা বলে তারা চলে যাবে। কিন্তু তারা কালক্ষেপণ করে এবং ক্রমান্বয়ে লোক বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। অথচ এলাকাবাসী এবং আলেম সমাজ বিপ্লবের ফেসবুক আইডি হ্যাকড্ হওয়ার বিষয়টি মেনে নিয়েছিল। তারা যে এমন করতে পারে এটা আমি ভাবতেই পারছি না।”

ভোলার পুলিশ সুপার ২০ তারিখে, অর্থাত সংঘর্ষের ঘটনার দিন বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলেছিলেন, “বোরহানউদ্দিন উপজেলার বিপ্লব চন্দ্র শুভ নামের এক যুবকের ফেসবুক আইডি হ্যাক হয়েছে। আমরা হ্যাকের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের আটক করেছি। আমরা এ নিয়ে গত রাতে স্থানীয় আলেমদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বলেছে আজকের প্রোগ্রাম হবে না।

কিন্তু সকাল থেকে আমাদের কাছে খবর আসে সেখানে মাইকিং হচ্ছে এবং স্টেজ বানানো হচ্ছে। সেখানে গিয়ে আমরা উপস্থিত মুসল্লীদের সঙ্গে কথা বলি এবং আমি নিজে সেখানে বক্তব্য দিয়েছি। তারা সবাই আমার বক্তব্য শুনেছে। যখন আমি স্টেজ থেকে নেমে আসি তখন এক দল উত্তেজিত জনতা আমাদের ওপর হামলা চালায়।

অতর্কিত হামলায় আত্মরক্ষার্থে একটি রুমে গিয়ে আশ্রয় নিই। যখন তারা আমাদের রুমের জানালা ভেঙ্গে ফেলছে তখন আমরা প্রথমে শর্টগানের ফাঁকা গুলি ছুড়ি। সাধারণত শর্টগানের গুলি ছুড়লে জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু এতে কাজ না হওয়ায় ওপরের দিকে গুলি চালায় পুলিশ।”

সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী ঐদিন দুজন পুলিশ সদস্যসহ আহত হয় দেড় শতাধিক লোক, নিহত হন চারজন। আহতরা বোরহানউদ্দিন হাসপাতাল, ভোলা সদর হাসপাতাল, এবং গুরুতর আহত কয়েকজন বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিতসা নেয়।

নিহতরা হলেন- বোরহানউদ্দিন উপজেলার মহিউদ্দিন পাটওয়ারীর মাদ্রাসা পড়ুয়া ছেলে মাহবুব (১৪), উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের দেলওয়ার হোসেনের কলেজ পড়ুয়া ছেলে শাহিন (২৩), বোরহানউদ্দিন পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা মাহফুজ (৪৫), মনপুরা হাজিরহাট এলাকার বাসিন্দা মিজান (৪০)।

https://youtu.be/JmucMtGWxFA?t=585

উপজেলা সদরের হিন্দু পাড়া ভাওয়াল বাড়িতে হামলা লুটপাটের ঘটনা থেকে গেছে আড়ালে

বোরহান উদ্দিনে হ্যাকড্ হওয়া ‘বিপ্লব চন্দ্র শুভ’ নামক ফেসবুক আইডি থেকে কথিত ধর্মাবমাননাকর স্টাটাসের জেরে পুলিশ এবং কথিত ‘তৌহিদি জনতা’র সংঘর্ষে চারজন নিহত হওয়ার পর উপজেলা সদরের হিন্দুপাড়া রবীন্দ্রপল্লী খ্যাত ভাওয়াল বাড়িতে হামলা এবং লুটপাটের ঘটনা ঘটে। প্রথমেই  মন্দিরে ভাংচুর করা হয়। প্রতিটি মূর্তির মাথা ভেঙ্গে ফেলা হয়। এরপর পাড়ার প্রতিটি বাড়িতে চালানো হয় হামলা লুটপাট। কয়েকজন নারী পুরুষকে করা হয় নির্যাতন।

পাড়ার একটি মন্দির এবং এগারোটি বাড়িতে হামলা ও লুটপাট চালানো হয়। যেসব বাড়িতে হামলা চালানো হয়-

১। রাজীব রতন দে; ২। সত্য প্রসাদ দাস; ৩। কাজল চন্দ্র দে; ৪। নারায়ণ চন্দ্র দে; ৫। সূজন চন্দ্র দে; ৬। ভবেষ চন্দ্র মণ্ডল; ৭। সমর চন্দ্র দাস; ৮। পিয়াস চৌধুরী; ৯। শন্তি রঞ্জন দে; ১০। রঘুনাথ দাস; ১১। সুধাংশু; ১২। সুভাষ চন্দ্র দাস।

হামলা ও লুটপাটের ঘটনা কীভাবে শুরু হয় জানতে চাইলে ভুক্তভোগী সুবল দেবনাথ বলেন, “উপজেলা ঈদগাহ মাঠে ২০ তারিখ (২০ অক্টোবর) রোববার ‘আলেম সমাজের’ সভা হচ্ছিল। সভার এক পর্যায়ে দলবেঁধে তারা পুলিশের ওপর আক্রমণ করে বলে শুনেছি, এরপর পুলিশের গুলিতে কয়েকজন মারা গেলে বিক্ষোভকারীদের একটি দল মিছিল করে এদিকে চলে আসে। কিছু লোক দেঁৗড়ে এসে হাসপাতালের সামনে (হিন্দুপাড়ার সামনেই বোরহানউদ্দিন সদর হাসপাতালটি অবস্থিত) জড়ো হয়। হাসপাতালের মসজিদের মাইকে তখন বলতেছে, ‘আমরা মুসলমান, আমরা একবার মরি, আপনারা কেউ যাবেন না।’ ওদিকে বাজারের মসজিদে বলতেছে, ‘আপনারা সবাই চলে যান।’ এক পর্যায়ে হাসপাতালের সামনে থেকে লোক ঢুকে প্রথমে ইটপাটকেল মারতে শুরু করে। কোনো বাসায় তখন কোনো পুরুষ লোক নেই, যে যার কাজে গিয়েছে। তারা প্রতিরোধহীনভাবে হামলা লুটপাট চালায়। প্রথমে এই মন্দিরটি ভাঙলো, এরপর এই পাড়ার প্রত্যেকটি হিন্দু বাড়িতে ভাঙচুর এবং লুটপাট চালায়।

হামলা ও লুটপাটের ঘটনা কীভাবে শুরু হয় জানতে চাইলে ভুক্তভোগী সুবল দেবনাথ বলেন, “উপজেলা ঈদগাহ মাঠে ২০ তারিখ (২০ অক্টোবর) রোববার ‘আলেম সমাজের’ সভা হচ্ছিল। সভার এক পর্যায়ে দলবেঁধে তারা পুলিশের ওপর আক্রমণ করে বলে শুনেছি, এরপর পুলিশের গুলিতে কয়েকজন মারা গেলে বিক্ষোভকারীদের একটি দল মিছিল করে এদিকে চলে আসে। কিছু লোক দেঁৗড়ে এসে হাসপাতালের সামনে (হিন্দুপাড়ার সামনেই বোরহানউদ্দিন সদর হাসপাতালটি অবস্থিত) জড়ো হয়। হাসপাতালের মসজিদের মাইকে তখন বলতেছে, ‘আমরা মুসলমান, আমরা একবার মরি, আপনারা কেউ যাবেন না।’ ওদিকে বাজারের মসজিদে বলতেছে, ‘আপনারা সবাই চলে যান।’ এক পর্যায়ে হাসপাতালের সামনে থেকে লোক ঢুকে প্রথমে ইটপাটকেল মারতে শুরু করে। কোনো বাসায় তখন কোনো পুরুষ লোক নেই, যে যার কাজে গিয়েছে। তারা প্রতিরোধহীনভাবে হামলা লুটপাট চালায়। প্রথমে এই মন্দিরটি ভাঙলো, এরপর এই পাড়ার প্রত্যেকটি হিন্দু বাড়িতে ভাঙচুর এবং লুটপাট চালায়।”

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে সরোজমিনে গিয়ে আমরা দেখতে পাই, ভাঙচুর এবং লুটপাটের আলামত, আগুন লাগানোর ফলে পোড়া দাগ রয়েছে ঘরে, মটর সাইকেল পোড়ানোর ফলে মাটি কালো হয়ে রয়েছে। মন্দিরে প্রতিটি মূর্তির মাথা ভাঙা, ভাঙচুর করা হয়েছে মন্দিরের অন্যান্য সকল জিনিসপত্র।

ঘটনার পরে পনেরোদিন পেরিয়ে গেলেও তখনও হামলার ক্ষত এবং ভয় বিরাজ করছে ভুক্তভোগীদের মধ্যে। সরকারি বা বেসরকারি কোনো পক্ষ থেকে তাদের অভয় দিয়ে এবং বিচার কাজে সহযোগিতা করতে যায়নি কোনো গোষ্ঠী। পনেরোদিন পেরিয়ে গেলেও এমনকি পুলিশী তদন্ত পর্যন্ত হয়নি।   

এ বিষয়ে আমরা কথা বলি বোরহানউদ্দিনের স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং প্রশাসনের সাথে। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালাম বলেন, “ঘটনাস্থলে আমার যাওয়ার সুযোগ হয়নি, তবে ঘটনা সম্পর্কে আমি ওয়াকিবহাল।”

ঘটনাস্থলে সরোজমিন তদন্তে পুলিশের পক্ষ থেকে কেউ গিয়েছিল কিনা এ বিষয়ে জানতে চাইলে বোরহানউদ্দিন থানার ওসি মো. এনামুল হক জানান, “মামলা হয়েছে, পুলিশের পক্ষ থেকে তদন্ত চলছে। পুলিশ ইতোমধ্যে চারজনকে গ্রেফতার করেছে।”  যদিও ভুক্তভোগীরা কোনো ধরনের গ্রেফতার বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে।                                                                                                                                                                                                 

হামলাকারীরা জানালা ভেঙে ঘরে ঢুকে ভাঙচুরের এক পর্যায়ে মারধর করে বৃদ্ধ দম্পতি অঞ্জু রাণী দাস এবং সত্য প্রসাদ দাস কে

ভাওয়াল বাড়ি মন্দির কমিটি- শ্রী শ্রী গৌর নিতাই আশ্রমের সভাপতি সত্য প্রসাদ দাস। তার ঘরে দুস্কৃতিকারীরা ঢোকে জানালা ভেঙে। ঢুকেই প্রথমে ঘরের ঠাকুর ঘরটি ভাঙচুর করে। এরপর পিতলের মঙ্গল প্রদীপ দিয়ে স্টিলের আলমারি ভেঙে লুটপাট চালায়। সত্য প্রসাদ দাস হাতজোড় করে হামলাকারীদের কাছে করুণা ভিক্ষা করেও রক্ষা পায়নি, মারধর করা সত্য প্রসাদ দাস এবং অঞ্জু রাণ দাসকে। এক পর্যায়ে হামলাকারীরা আবার ঐ জানালা দিয়েই পালিয়ে যায়।   

হামলাকারীরা রেহাই দেয়নি প্যারালাইসিস রোগী সুভাষ চন্দ্র দাসকেও

বছর খানেক আগে স্ট্রোক করে সুভাষ চন্দ্র দাস এখন শয্যাশায়ী। প্রায় অচল, বাড়িতেই সময় কাটে। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, “হঠাত করে অনেক লোক চলে আসলো। আমি দরজা বন্ধ করে রাখি। ওরা দরজায় বড় বড় ইট মারতে থাকে। তারপর দরজা ভেঙ্গে ঘরে প্রবেশ করে আমাকে মারধর করে। আমি বললাম, ‘আমি অসুস্থ মানুষ আমাকে কিছু বলবেন না। একথা বলার পরও বাঁশের লাঠি দিয়ে চার পাঁচটা বাড়ি দেয়।’” জামা খুলে এই প্রতিবেদককে তিনি কালসিটে পড়া শরীরের বিভিন্ন স্থান দেখান। রবীন্দ্র পল্লী-ভাওয়াল বাড়ির প্রতিটি বাড়ির মতো  দরজা জানালা ভাঙ্গা এ বাড়িটি দেখলেও হামলার ভয়বহতা বুঝতে পারা যায়।

হামলাকারীরা ছিল জিন্সের প্যান্ট ও পাঞ্জাবি পরা

ভুক্তভোগী এবং প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, হামলাকারী এবং লুটপাটকারীদের পোশাক ছিল জিন্সের প্যান্ট এবং পাঞ্জাবি। তাদের মাথায় টুপি ছিল না। সাধারণত মাদ্রাসার ছাত্ররা যেরকম পোশাক পরে ঠিক সে ধরনের পোশাক তারা পরা ছিল না। তাদের দেখে বোঝা যাচ্ছিল, হামলাটি ছিল পরিকল্পিত, কারণ, তারা খুব স্বাভাবিকভাবেই হামলা এবং লুটপাট চালিয়েছে। 

মামলা হলেও বিচার পাবেন বলে মনে করেন না ভুক্তভোগীরা

অজ্ঞাতনামা আসামীদের নাম উল্লেখ করে বোরহানউদ্দিন থানায় মামলা করেছেন মন্দির কমিটির (শ্রী শ্রী গৌর নিতাই আশ্রম) সভাপতি সত্য প্রসাদ দাস বাদী হয়ে। পেনাল কোড ১৪৩/৪৪৭/৪৪৮/৩২৩/২৯৫/৪৩৫/৪৩৬/৩৭৯/৪২৭/৫০৬ ধারায় মামলা হয়েছে। মামলার এজাহারে লেখা রয়েছে, “বেআইনিভাবে মন্দির, দোকান এবং বসতঘরে প্রবেশ, ধর্মের প্রতি অবমাননা, প্রতিমা ভাঙচুর, আসবাবপত্র ভাঙচুর, লুণ্ঠন, চুরি, অগ্নিসংযোগ, মারধর এবং জীবননাশের হুমকি। এজাহারে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ লেখা হয়েছে ৫,৬৭,০০০/- টাকা। তবে বাদী তার অভিযোগে যে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখ করেছেন সেটি অনেক বেশি। তিনি মন্দির এবং ১২ টি বসত ঘরে ভাঙচুর এবং লুটপাটের ঘটনায় পঞ্চাশ লক্ষাধিক টাকার ক্ষয়ক্ষতির কথা উল্লেখ করেন।  

তবে ভুক্তভোগীরা বিচার পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী নয়। ’৯২ সাল এবং ২০০১ সালের দাঙ্গার কথা উল্লেখ করে তারা বলেন, পূর্বেও বিচার হয়নি, এবারও বিচার হবে আমরা সেটি বিশ্বাস করতে পারছি না। তারা এ ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলা এবং লুটপাটের বিচার যাতে দ্রুতগতিতে হয় এজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করেছেন।