এইচআরডব্লিউ বলছে, পুলিশের হাতে নির্বিচারে গ্রেফতারের ঘটনা প্রতিদিনই বাড়ছে। ১০ ফেব্রুয়ারি শ্রমিক ইউনিয়নের আরও নয়জন সংগঠককে গ্রেফতার করা হয়। জ্ঞাতসারে গ্রেফতারকৃতদের এ সংখ্যা ৩৪। এখনও যারা অন্তরীণ অবস্থায় আছেন কর্তৃপক্ষের উচিত শিগগিরই তাদের মুক্তি দেওয়া এবং রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সব অভিযোগ তুলে নেওয়া। গ্রেফতারকৃতদের ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। এ ব্যাপারে অধিকার সংগঠন, আইনজীবী এবং গার্মেন্টকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেছে সংস্থাটি। নজর রেখেছে পুলিশ রেকর্ডের ওপরও। এসবের ভিত্তিতে গ্রেফতারকৃতদের সম্পর্কে উঠে এসেছে এক ভিন্ন চিত্র। আর তা হচ্ছে, অপরাধের বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগের চেয়ে শ্রমিক সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতেই অধিক আগ্রহী পুলিশ। আশুলিয়ার ধর্মঘট পয়েন্ট থেকে গ্রেফতারকৃতদের অনেকেই রাজনৈতিক উদ্দেশে পুলিশকে দেওয়া ক্ষমতার অপব্যবহারের শিকার হচ্ছেন।
শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা এবং সংগঠকদের এখনও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। পুরনো মামলার ভিত্তিতে তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। ইউনিয়নগুলো গ্রেফতারকৃত ৩৪ জনের ব্যাপারে সজাগ; যাদের বেশিরভাগই ইউনিয়নগুলোর নেতা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের একটি টেলিভিশন চ্যানেল একুশে টিভি-র এক সাংবাদিককে গ্রেফতার। গার্মেন্টকর্মীদের ধর্মঘটের ওপর প্রতিবেদন তৈরির কারণে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
জানুয়ারির গোড়ার দিকে ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গার্মেন্ট ধর্মঘটে গ্রেফতারের সংখ্যা প্রকৃতপক্ষে আরও বেশি। পত্রিকাটি বলছে, পুলিশ অন্তত ৪৪ জনকে গ্রেফতার করেছে। এছাড়া আরও সন্দেহভাজন আরও ১৫৯ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে গ্রেফতারকৃতদের কোনও পূর্ণ তালিকা দেওয়া হয়নি। তাদের কোথায় অন্তরীণ রাখা হয়েছে সে ব্যাপারেও কিছু জানানো হয়নি।
অধিকারকর্মীদের হাতে থাকা তথ্য বলছে, ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে প্রায় ১০টি ফৌজদারি অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। এসব অভিযোগে প্রায় ১৫০ জন কর্মী এবং এক হাজার ৬০০-এর অধিক ‘অজ্ঞাত’ ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ধর্মঘট চলাকালে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিগুলোর সম্পদ ধ্বংসের মতো নানা অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ আনা হয়েছে।
এইচআরডব্লিউর প্রতিবেদনে বলা হয়, বেতন ইস্যুতে ১১ থেকে ১৯ ডিসেম্বর ধর্মঘটে অংশ নেন রাজধানী ঢাকার বাইরের কয়েক হাজার গার্মেন্টসকর্মী। তারা এসেছিলেন আনুমানিক ২০টি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি থেকে। আশুলিয়া শিল্প এলাকার এ গার্মেন্টসগুলো আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোর কাছে তাদের উৎপাদিত পণ্য সরবরাহ করে। স্থানীয় সংগঠন ও কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ওই ধর্মঘটে যোগ দেওয়া শ্রমিকদের একটা বড় অংশ এসেছিল সেসব ফ্যাক্টরি থেকে যেখানে কোনও শ্রমিক ইউনিয়ন নেই। ওই ধর্মঘট সম্পর্কে আগে থেকে জানা কিংবা এ ব্যাপারে নিজেদের কোনও ভূমিকা থাকার বিষয়টি নাকচ করে দিয়েছে ইউনিয়ন ফেডারেশনগুলো। অথচ বাংলাদেশ সরকার ন্যাশনাল ইউনিয়ন ফেডারেশনের নেতা এবং শ্রম অধিকার কর্মীদের গ্রেফতারে আত্মপক্ষ সমর্থনে ওই ধর্মঘটকে জাহির করছে। তাদের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের ধর্মঘটে ‘নেতৃত্ব প্রদান’ এবং ‘পরিকল্পনা’র অভিযোগ করা হচ্ছে।
গার্মেন্ট সেক্টরের কর্মীরা বলছেন, প্রায়ই এ ধরনের যে ধর্মঘট হয়; সেটার মূলে রয়েছে শ্রমিকদের মধ্যকার ক্ষোভ বা অসন্তোষ। এর কারণ হচ্ছে, শ্রমিক ইউনিয়নের সংগঠক বা শ্রমিকদের সংগঠিত করার চেষ্টা করেন; এমন ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সরকার এবং স্থানীয় নিয়োগদাতাদের প্রতিশোধমূলক আচরণ। এর ফলে কর্মীরা নিয়োগদাতাদের কাছে সম্মিলিতভাবে দরকষাকষিতে অসমর্থ হয়ে পড়েন। এতে নিজেদের ক্ষোভ বা অসন্তোষ জানানোর জন্য তাদের আনুষ্ঠানিক চ্যানেল ব্যবহার করতে হচ্ছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর ডেপুটি এশিয়া ডিরেক্টর ফিল রবার্টসন। তিনি বলেন,“বেতন নিয়ে শ্রমিকদের ক্ষোভের দিকে নজর দেওয়ার বদলে বরং শ্রম অধিকারকর্মীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা এবং শ্রমিকদের আতঙ্কিত করে তোলা হলে তা বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুণ্ণ করবে। এটা সরকারের একটা উপহাস হিসেবে গণ্য হবে। ইন্ডাস্ট্রিগুলো দাবি করছে, শ্রমিকদের অধিকারের সুরক্ষায় তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশ থেকে পণ্য সংগ্রহকারী আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড এবং দাতাদের উচিত কর্মী এবং শ্রম অধিকারকর্মীদের ওপর নিপীড়ন বন্ধে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা।”
গার্মেন্টকর্মীরা যে দাবিতে জড়ো হয়েছিলেন সেটা ছিল তাদের বেতন সংক্রান্ত। আন্দোলনকারীদের দাবি ছিল, তাদের মাসিক বেতন যেন পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৫ হাজার বা ১৬ হাজার টাকা করা হয়। ২০১৬ সালে লেবার অ্যাসোসিয়েশনের অনুসন্ধানে বাংলাদেশের গার্মেন্ট শ্রমিকদের ক্রয়ক্ষমতা সংক্রান্ত কিছু তথ্য উঠে আসে। এতে দেখা যায়, একজন গার্মেন্টকর্মীর গড়পড়তা ক্রয়ক্ষমতা বিশ্বব্যাংক নির্ধারিত দারিদ্রসীমার চেয়েও নিচে।
বাংলাদেশ সরকার এবং দেশের গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) উভয়েই কর্মীদের বেতন পর্যালোচনার দাবি প্রত্যাখ্যান করে। কিছুদিনের জন্য আশুলিয়ার প্রায় ৬০টি ফ্যাক্টরি বন্ধ রাখে বিজিএমইএ। ফলে সাময়িকভাবে কর্মহীন হয়ে পড়েন হাজার হাজার গার্মেন্টকর্মী। এক পর্যায়ে ওই ধর্মঘটের অবসান ঘটে।
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ তারিখে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ঢাকা অ্যাপারেল সামিট। এইচআরডব্লিউর ওই প্রতিবেদনে এ প্রসঙ্গ টেনে আনা হয়। বলা হয় এ সামিটে অংশ নিচ্ছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ব্র্যান্ড ও দাতাগোষ্ঠীগুলো। এ সম্মেলনের আয়োজন করছে বাংলাদেশে গার্মেন্ট সামগ্রী রফতানিকারকদের সংস্থা। এইচআরডব্লিউ’র প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড ও দাতাদের উচিত শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে সব ধরনের নিপীড়ন বন্ধ করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো। একইসঙ্গে কর্মীদের সংগঠন করার যে স্বাধীনতা রয়েছে তার সুরক্ষার জন্য আওয়াজ তুলতে হবে।
বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি করে এমন প্রায় ২০টি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের পক্ষ থেকে ২০১৭ সালের জানুয়ারির গোড়ার দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটি চিঠি লেখা হয়। ওই চিঠিতে গার্মেন্টকর্মীদের বেতন পর্যালোচনার কথা বলা হয়। এছাড়া, শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা এবং কর্মীদের সমর্থন দেওয়া ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। যে প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে ওই চিঠি পাঠানো হয়েছিল সেগুলোর মধ্যে এইচঅ্যান্ডএম, ইন্ডিটেক্স, জেএপি, সিঅ্যান্ডএ, নেক্সট, প্রিমার্ক-এর মতো প্রতিষ্ঠানও রয়েছে।
আশুলিয়ায় ধর্মঘটের ঘটনায় পুলিশের কিছু নির্যাতনের এমন কিছু কৌশল দেখা গেছে যা কর্তৃপক্ষের তরফে ইতোপূর্বেও প্রয়োগের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার মধ্যে রয়েছে:
• ১৯৭৪ সালের কুখ্যাত কঠোর ক্ষমতা আইনে অস্পষ্ট বা রহিত অপরাধের ভিত্তিতে কাউকে গ্রেফতার করা।
• বিপুল সংখ্যক ‘অজ্ঞাত’ ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ ব্যবহার। এর মাধ্যমে কার্যত পুলিশকে যে কাউকে গ্রেফতারের হুমকি দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। এর ফলে পুলিশের পক্ষে ওই মামলায় নাম না থাকা সত্ত্বেও গ্রেফতার এবং জামিন পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধতা তৈরির হুমকি প্রদানের পথ সুযোগ তৈরি হয়।
• ‘বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার’-এর ক্ষমতার অপব্যবহার। এটা বাংলাদেশ হাইকোর্টের নির্দেশনার লঙ্ঘন। কার্যত এটা একটা প্রাক-বিচার সাজা।
• জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায়ের লক্ষ্যে পদ্ধতিগত সুরক্ষার লঙ্ঘন। এক্ষেত্রে নির্যাতন, নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতা এবং অন্যান্য অবমাননাকর আচরণ করা হয়।
• পুলিশের পক্ষ থেকে আটককৃত দুই ব্যক্তিকে ‘ক্রসফায়ারে’ খুনের হুমকি। বাংলাদেশ ইন্ডিপেনডেন্ট গার্মেন্টস ইউনিয়ন ফেডারেশনের একজন কর্মকর্তাকে হত্যার হুমকি।
• ‘তদন্তের’ নামে শ্রম অধিকার কর্মী ও শ্রমিকদের হয়রানি এবং ভয়ভীতি প্রদর্শন।
• তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইন, ২০১৫-এর ৫৭ ধারায় একজন সাংবাদিককে গ্রেফতার।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের উচিত এসব ফৌজদারি মামলা বন্ধ করা এবং আশুলিয়ায় ধর্মঘটের পর গুম, নির্যাতন, খুনের হুমকি ও অন্যান্য অবমাননাকর চর্চার সঙ্গে জড়িত পুলিশ কর্মকর্তাদের আটক করা।
সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন