উপকূলীয় এলাকা সহ বেশ কয়েকটি জেলায় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের অধীনে পানি সংরক্ষণের ট্যাংক ও অন্যান্য সরঞ্জাম দেওয়া হচ্ছে গত বেশ কয়েক বছর ধরে। ‘সমগ্র দেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্প’ ও ‘উপকূলীয় জেলাসমূহে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে পানি সরবরাহ’ নামে দুটি প্রকল্পের আওতায় এই কাজ হচ্ছে।

বাড়িতে তিন হাজার লিটার বৃষ্টির পানি ধারণক্ষমতার পানির ট্যাংক ও অন্যান্য সরঞ্জাম স্থাপনের জন্য উপকারভোগীদের ১ হাজার ৫০০ টাকা হারে সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হয়। কিন্তু বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে ফলোআপ নিউজ জানতে পেরেছে— এর চেয়ে অনেক বেশি টাকা নেওয়ার নজির রয়েছে। সাতক্ষীরা জেলার একটি সূত্র বলছে শ্যামনগরে এজন্য গুনতে হচ্ছে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত, যা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ ঠিকাদার ও তার লোকজন নিচ্ছেন বলে অভিযোগ।
অভিযোগের প্রথম তীর অবশ্য আওয়ামী লীগ আমলের দুই সংসদ সদস্যে দিকে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের অনেকগুলো উপায়ের মধ্যে পৃথিবীতে সবচেয়ে কম জনপ্রিয় উপায়টিই জনপ্রিয় করে তোলা হয়েছে বাংলাদেশে। প্লাস্টিকের ট্যাকে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের এই পলিসি বিগত সরকার কোন সংস্থার প্রেসক্রিপশনে নিয়েছিলো সেটি জানা না গেলেও জানা যাচ্ছে আওয়ামী লীগের দু’জন সংসদ সদস্য গাজী গোলাম দস্তগীর এবং হাজী সেলিমের কোম্পানির পানির ট্যাংক গাজী ট্যাংক এবং মদিনা ট্যাংকই এ যাবত সরকার সরবরাহ করেছে। কী দামে সরকার এই ট্যাংকগুলো কিনেছে জানতে চায় সচেতন নাগরিক সমাজ। ঠিক কত বাজেটে (সরকারি খরচে) বাড়িতে ট্যাংক বসানোর কাজটি হয়েছে? সূত্রমতে প্রতিটি ইউনিটের জন্য খরচ ধরা হয়েছিলো ৪৫,০০০ টাকা। প্রতিটি পানি সংরক্ষণ ইউনিট নির্মাণে ৪৫ হাজার টাকা এবং ক্যাচমেন্ট এরিয়া নির্মাণে ৬ হাজার ৯৮০ টাকা ব্যয় হবে।
বৃষ্টির পানি ধরে রাখার অনেকগুলো প্রচলিত পদ্ধতি আছে। আগে যেমন মানুষ বড় বড় মাটির পাত্রে বৃষ্টির পানি ধরে রাখতো, যেগুলোকে মাইট বলা হত। এ ধরনের একটি মাটির মাইট এক হাজার লিটারও ধারণ করতে পারতো। পুকুরে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার পদ্ধতি আরো প্রাচীন। এখনো আফ্রিকা এবং এশিয়ার অনেক দেশে পুকুরে বৃষ্টির পানি ধরে রেখে ফিল্টার করে বা না করে পান করা হয়। ফিল্টার করার জন্য প্রাকৃতিক এবং প্রাচীন পদ্ধতিগুলোই আসলে টেকসই হয়। কিন্তু বাণিজ্যিক স্বার্থ ঢুকে পড়ে বলে সরকার একেক সময় একেক ধরনের সমাধান নিয়ে আসে।

বাংলাদেশে উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে তো বটেই, প্রকৃতপক্ষে সারা দেশেই গ্রামাঞ্চলে বৃষ্টির পানির তীব্র সংকট রয়েছে। একসময়ে বাংলাদেশে সুপেয় পানির সমস্যার সমাধান করা হয়েছিলো টিউবওয়েল বসিয়ে। প্রায় তিন দশক ধরে বাংলাদেশের মানুষের সুপেয় এবং ধোয়াপাল্লার পানির সমস্যার সমাধান করেছে টিউবওয়েল। কিন্তু আর্সেনিক আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়ে অথবা প্রকৃপক্ষেই আর্সেনিক একটি বড় সমস্যা বলে মানুষকে টিউবওয়েল ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখা হয়েছে। এরপর বাংলার মানুষ সুপেয় পানি সমস্যার স্থায়ী আর কোনো সমাধান পায়নি। সমস্যার ফাঁক গলে ঢুকে পড়েছে বাণিজ্যিক স্বার্থ। এ স্বার্থের বড় অংশীদার বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। ইউনিলিভারের পিউর-ইট ফিল্টার এবং আর-ও এখন গ্রামাঞ্চলগুলোতেও জোরেসোরে ব্যবহৃত হচ্ছে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, টিউবওয়েল এবং প্রাকৃতিক ফিল্টার মিলিয়ে যে সমস্যার সমাধান বিনামূল্যে হতে পারে, সেই সমস্যার সমাধান এখন গ্রামের সাধারণ একটি খেটে খাওয়া পরিবারকেও করতে হচ্ছে মাসিক কমপক্ষে ৫০০ টাকার বিনিময়ে। গ্রামের মানুষ এখন সাদা ড্রামের পানি কিনে খাচ্ছে, যেগুলো ৩০ থেকে ৫০ টাকা মূল্যে বিক্রি করা হয়।

ফাল্গুন শেষে চৈত্র মাস শুরু হতেই সুপেয় পানির জন্য হাহাকার শুরু হতে থাকে বলা হলেও এ সমস্যা আসলে প্রায় আট মাসের। এই হাহাকার দক্ষিণ উপকূলবাসীদের শুধু নয়, এখন সারা দেশের। প্রায় সব পানির উৎসগুলোতে লবণাক্ততা ব্যাপক আকারে বেড়ে গেছে। শুষ্ক মৌসুমে উপকূলের নদীগুলোকে লবণাক্ত করে তোলে বঙ্গোপসাগরের নোনাপানি।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে গত ৩০-৪০ বছরে শুষ্ক মৌসুমে পানির উৎসগুলোতে লবণাক্ততা বাড়ার ফলে দেখা দিচ্ছে সুপেয় পানির তীব্র সংকট। যারা বর্ষার মৌসুমে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে রাখে, তারা কিছুটা স্বস্তিতে থাকে। আর যাদের সেই উপায় থাকে না, তাদের বাধ্য হয়েই খাওয়াসহ অন্যান্য কাজে লোনাপানিই ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু এ সংরক্ষণের উপায় বাতলে দিতে গিয়েই বিগত সরকারের প্রভাবশালী কয়েকজন জড়িয়েছিলো ভয়াবহ দুর্নীতিতে। দুর্নীতির বিস্তার ছিলো একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত।
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে বিশেষভাবে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। জনশুমারি ও গৃহগণনা (২০২২) অনুযায়ী, বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত ১৯টি জেলায় বসবাস করে প্রায় ৪ কোটি ৩৮ লাখ মানুষ। সুপেয় পানির সমস্যায় সবচেয়ে বেশি ভুগছে এই ১৯ জেলার মানুষ।
সম্পর্কিত সংবাদঃ