Headlines

সাজাপ্রাপ্ত হয়েও ‘পলাতক’ খুনিরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে!

বিশ্বজিৎ হত্যার চার বছর

বহুল আলোচিত পুরান ঢাকার দর্জি দোকানি বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত এক ডজন আসামি এখনও পলাতক। এদের মধ্যে দু’জন ফাঁসির ও ১০ জন যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত। এরা সবাই ছাত্রলীগের  সাবেক নেতাকর্মী।

সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামিদের অনেকে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে হরহামেশা দেখা যায় তাদের। কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সক্রিয়।

কিন্তু পুলিশের চোখে তারা পলাতক। দীর্ঘদিনেও আসামিরা গ্রেফতার না হওয়ায় হতাশ বিশ্বজিতের পরিবার। কিছু অসাধু পুলিশ কর্মকর্তা ও ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদের ম্যানেজ করেই তারা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

বিশ্বজিতের পরিবারের দাবি, পলাতক খুনিরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও ক্ষমতাসীন দলের লোকজন হওয়ায় তাদের গ্রেফতার করছে না পুলিশ। খুনিরা গ্রেফতার না হওয়ায় পরিবারটি আতংকের মধ্যেও রয়েছে।

তারা পলাতক সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের গ্রেফতার করে দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন। বিশ্বজিতের বাবা অনন্ত দাশ বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামিরা বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পুলিশ এতো আসামি ধরে, কিন্তু তাদের ধরছে না। সরকারদলীয় বলেই তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে না বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর দর্জি দোকানের কর্মচারী বিশ্বজিৎ দাসকে পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কের পাশে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। দেশব্যাপী চাঞ্চল্য সৃষ্টি করা ওই হত্যা মামলায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১ ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয়।

বিচার শেষে ২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর ২১ আসামির মধ্যে আটজনকে মৃত্যুদণ্ড ও ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আট আসামি হল- পটুয়াখালীর মো. রফিকুল ইসলাম  ওরফে শাকিল, ভোলা জেলার দৌলতখান থানার পশ্চিম জয়নগর গ্রামের মাহফুজুর রহমান ওরফে নাহিদ, যশোরের শার্শা থানার কাইবা পূর্বপাড়ার এমদাদুল হক ওরফে এমদাদ, খুলনা জেলার পাইকগাছা থানার নাসিরপুর কলেজ রোডের জিএম রাশেদুজ্জামান ওরফে শাওন, নরসিংদী জেলার মনোহরদী থানার চন্দনবাড়ীর সাইফুল ইসলাম ওরফে সাইফুল, কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর থানার বাড়িয়াচারার কাইয়ুম মিঞা ওরফে টিপু, নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা থানার মনতলা গ্রামের রাজন তালুকদার ও রংপুর জেলার পীরগাছা থানার সুলিপাড়া গ্রামের মীর মো. নূরে আলম ওরফে লিমন। এদের মধ্যে রাজন তালুকদার ও নুরে আলম পলাতক।

অন্যদিকে, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয় ১৩ জনকে। এই আসামিদের মধ্যে জেলে আছে- মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া থানার রাজুইর গ্রামের গোলাম মোস্তফা ও বরিশাল জেলার আগৈলঝড়া থানার চেংগুটিয়া গ্রামের এএইচএম কিবরিয়া।

এছাড়া মাগুড়ার গাংনালিয়া গ্রামের খন্দকার মো. ইউনুস আলী ওরফে ইউনুস, বগুড়ার সেওজ আমতলা গ্রামের তারেক বিন জোহর ওরফে তমাল, পঞ্জগড় জেলার অটোয়ারী থানার ছোটধাপ গ্রামের মো. আলাউদ্দিন, নোয়াখালীর হাতিয়া থানার চর কৈলাশ গ্রামের ওবায়দুর কাদের তাহসিন, ফরিদপুর সদর থানার চর চাঁদপুর গ্রামের ইমরান হোসেন ওরফে ইমরান, খুলনার খানজাহান আলী থানার বড়বাড়ী মধ্যপাড়ার আজিজুর রহমান ওরফে আজিজ, মাদারীপুর জেলার রাজৈর থানার সাতবাড়ীয়ার আল আমিন শেখ, নড়াইল কল্যাণখালীর মো. রফিকুল ইসলাম, কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব থানার মধ্যপাড়া মোল্লাবাড়ির মনিরুল হক ওরফে পাভেল, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থানার মধ্যপাড়া দানুমোলার বাড়ির কামরুল হাসান ও কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব থানার শ্রীনগরের মোশাররফ হোসেন এখনও পলাতক। পলাতক এক আসামি আদালতে আত্মসমর্পণ করেছে বলে আদালত সূত্র জানায়।

তবে তার নাম-ঠিকানা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত পলাতক আসামি রাজন চন্দ্র তালুকদারকে প্রকাশ্য ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাকিম চত্বরের সামনে সন্ধ্যার পর প্রায়ই দেখা যায় তাকে। তবে সম্প্রতি ভারতে পাড়ি জমিয়েছে সে।

সে ওই দেশের একটি  রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ডে সক্রিয়। তার ফেসবুক থেকে এ তথ্য জানা গেছে। আরেক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি নূরে আলম লিমন রাজধানীর আশুলিয়ায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছে। মাঝে মধ্যে সে শাহবাগ এলাকায় আড্ডা দিতে আসে।

বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার পরোয়ানা মাথায় নিয়ে রাজধানীতে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও পুলিশ তাদের গ্রেফতার করছে না।  যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া আসামি কামরুল হাসান বিভিন্ন সরকারি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত।

বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল ভর্তি এবং চাকরির পরীক্ষার প্রশ্নপত্র মুঠোফোনে এসএমএসের মাধ্যমে পাঠিয়ে বাণিজ্য করছে বলে জানা যায়। সন্ধ্যার পর মাঝে মধ্যে শাহবাগ এলাকায় আড্ডা দেয় সে। এছাড়া কক্সবাজারে তার একটি আবাসিক হোটেলও রয়েছে।

যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আরেক আসামি আল-আমিন শেখ ওই মামলার রায় হওয়ার পরই কলকাতায় চলে যায়। যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত রফিকুল ইসলাম বর্তমানে মালেয়েশিয়া রয়েছে। আর ইমরান হোসেন চলতি বছর বিয়ে করে ফরিদপুরে বসবাস করছে।

এছাড়া ওবায়দুল কাদের তাহসিন দুবাই ও তারিক বিন জোহর সিঙ্গাপুর আছে বলে ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে। জানতে চাইলে বিশ্বজিতের বাবা অনন্ত দাস যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা বিচার পেয়েছি। কিন্তু রায় ঘোষণার ৩ বছর পার হল, এখনও পর্যন্ত রায় কার্যকর হল না।

মৃত্যুর আগে রায় কার্যকর দেখে যেতে পারলে আমার আত্মা শান্তি পেত। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে কেউ কোনো খবরও নেয় না। এখন রায় কার্যকরের বিষয়টি উচ্চ আদালতে পড়ে আছে। কারও কোনো উদ্যোগ নেই। আপনাদের মাধ্যমে (গণমাধ্যম) তাদের (সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের) কানে পানি দিতে চাই। যেন তারা দ্রুত রায় কার্যকরে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামিরা বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পুলিশ এতো আসামি ধরে, কিন্তু তাদের ধরছে না। সরকারদলীয় বলেই তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে না। সরকারের গাফিলতিতে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে সাজাপ্রাপ্ত এসব আসামিরা।’

আদালত সূত্র জানায়, বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলার রায়ের দু’দিনের মাথায় আসামিদের স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। কিন্তু গ্রেফতারি পরোয়ানা তামিল সংক্রান্ত পুলিশি প্রতিবেদন এখন পর্যন্ত আদালতে আসেনি।

নিয়মানুসারে, যতদিন পর্যন্ত আসামি গ্রেফতার না হবে ততদিন পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট থানায় গ্রেফতারি পরোয়ানা পেন্ডিং থাকবে। এছাড়া আসামির মৃত্যুর খবর পেলে পুলিশ প্রতিবেদনের মাধ্যমে সে বিষয়ে আদালতকে জানানো হয়।

এদিকে এ মামলার আসামিদের মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য ‘ডেথ রেফারেন্স’ হিসেবে মামলাটি এখন হাইকোর্টে বিচারাধীন। ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য প্রস্তুতি চলছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার সাব্বির ফয়েজ যুগান্তরকে বলেন, এ মামলার ডেথ রেফারেন্সের পেপারবুক (মামলার যাবতীয় নথিপত্র) তৈরির কাজ চলছে।

এ কাজ শেষ হতে আরও চার থেকে পাঁচ সপ্তাহ সময় লেগে যাবে। এরপর বিজি প্রেস থেকে পেপার বুক ছাপানোর কাজ শেষ হলে এটা শুনানির জন্য হাইকোর্টের এখতিয়ার সম্পন্ন কোনো বেঞ্চে পাঠানো হবে। এছাড়া আসামিপক্ষেও হাইকোর্টে আপিল দায়ের হয়েছে। আসামিপক্ষের আইনজীবী খন্দকার মাহাতাব হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘সাধারণত, ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানি একসঙ্গে হয়। বর্তমানে মামলাটির আপিল শুনানি উচ্চ আদালতে অপেক্ষমাণ।’

২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর ১৮ দলীয় জোটের অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে বাহাদুর শাহ পার্কের কাছে পথচারী বিশ্বজিৎ দাসকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কর্মীরা নির্মমভাবে পেটায় ও কোপায়। বাঁচার জন্য দৌড় দিলে তিনি শাঁখারীবাজারের রাস্তার মুখে পড়ে যান। রিকশাচালক রিপন তাকে রিকশায় তুলে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যান।

সেখানে চিকিৎসক বিশ্বজিৎকে মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনার সময় বিশ্বজিৎ লক্ষ্মীবাজারের বাসা থেকে শাঁখারীবাজারে নিজের দর্জি দোকানে যাচ্ছিলেন। হত্যার ঘটনায় ওই রাতে সূত্রাপুর থানার এসআই জালাল আহমেদ মামলা করেন। পরদিন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি ও ভিডিও ফুটেজ দেখে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ওই ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। এরপর কয়েকজন আসামিকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

সংবাদ : যুগান্তর