ছোটগল্প: বন্ধুত্ব ও ধর্ম

দুই বন্ধু, এক ক্লাসে পড়ে, একই স্কুলে যায়। ফাহিমের পিতা পুলিশ। বড় কোন পুলিশ অফিসার নয়। প্রমোশন পেয়ে ছোট দারোগা হয়েছে। জীবনে তার এখন একটাই লক্ষ্য বড় দারোগা হওয়া। পুলিশের চাকরিতে ঘুষপাতি সবকালেই ছিল, দিনে দিনে বেড়েছে, সামসু মিঞার আয় উপার্জন বর্তমানে তাই খুব ভালো।

অনুতোষের পিতার মিষ্টির দোকান- মলয় ঘোষ ডেয়ারি। উপার্জন উত্তরোত্তর বেড়েছে। ভোক্তা অধিকার এদেশে কার্যকর নয়। ভেজাল বিরোধী আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ নেই। ফলে লাভের অংক বছরে বছরে দিগুণ তিনগুণ হয়েছে।

ছেলেদের উপর ওদের পিতাদের রোজগারের ছাপ পড়েছে। ছেলেরা পড়ে মাত্র ফাইভে, কিন্তু এখনই তারা সবকিছু পছন্দ করে কিনতে শিখেছে। ঘরে ফাহিমের পিতা ওর মা-খালার সাথে যেভাবে কথা বলে ও সেভাবে কথা বলা রপ্ত করছে। ‘ধুর’ শব্দটা ফাহিম এখন কারণে অকারণে ব্যবহার করে। একদিন তো শিক্ষককেও বলে ফেলেছিল- ‘ধুর’। সেদিন অবশ্য কানমলা খেতে হয়েছিল।

বনশ্রী ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুলের ছাত্র ওরা। ঐ স্কুলের নিয়ম হচ্ছে সব ছাত্রকে টুপি পরে যেতে হয়। হিন্দু ছাত্র বাদে অন্য সব ছাত্ররা টুপি পরে যায়। স্কুলে কোন হিন্দু ধর্ম শিক্ষক নেই, হিন্দু ধর্ম ক্লাস মানে শুধু পড়া দেওয়া আর পড়া নেওয়া।

অনুতোষ একদিন ওর মাকে এসে ফিসফিস করে বলছিল, মা, ফাহিম মা-কালি কে “মাগি” বলেছে। ওর মা বলেছে, তাতে কোন সমস্যা নেই। ওর যা মন চায় ও বলুক।

– তাহলে আমিও বলব।

– তুই কী বলবি?

– আমি ওদের …

– খবরদার! ওর মা ওকে শাঁসিয়ে রেখেছে।

– আচ্ছা মা, মা-কালি ওরকম থাকে কেন? (নেংটা বলতে ও লজ্জা পেয়েছে)

– দেব দেবীদের নিয়ে বেশি ভাবতে নেই, শুধু পূজো করতে হয়। ওর মা ওকে বুঝায়।

পরের দিন ফাহিমের সাথে দেখা হতেই অনুতোষ পাশ কাটায়। এই ছোট্ট বয়সেই ওর অধিকারবোধ তৈরি হয়ে গেছে, ও বুঝে গেছে “মা-কালি” ওদের। মা-কালিকে গালি দিলে সেটা ওর গায়ে লেগেছে। ফাহিমকে উপযুক্ত জবাব দিতে না পারার বেদনাও ওর মধ্যে তৈরি হয়েছে। টিফিনে ফাহিম এসে ওর মান ভাঙায়।

– তুই কি আমার উপর রাগ করছিস?

– না। রাগ করি নাই।

– তাহলে কথা বলিস না যে?

– তুই রোজা থাকিস, এজন্য কথা বলি না। সারাদিন না খেয়ে থাকিস তো।

– রোজা থাকলে কি কথা বলা যায় না?

– কষ্ট হয় না?

– ওহ! আজকে তুই আমার সাথে ইফতার করবি?

– বাসায় যেতে দেরি হলে মা চিন্তা করবে।

– আচ্ছা, তাহলে একটা কাজ করি, স্কুল ছুটির পর আমি তোর সাথে বাসায় যাব, তারপর তোর মাকে বলে আমাদের বাসায় যাব। যাবি?

– ঠিক আছে, চল, মাকে বলে দেখি।

পথে যেতে যেতে দু’জনের মাঝে অনেক কথা হয়। এক ফাঁকে অনুতোষ বলে আমিও একদিন রোজা রাখব। কীভাবে রোজা রাখতে হয়? ফাহিম ওকে বুঝিয়ে দেয়।

স্কুল ছুটির পর ওরা দু’জন অনুতোষদের বাসায় গিয়ে ওর মাকে বলে। মা “সাবধানে যেও” বলে পাঠিয়ে দেয়।

ইফতার হতে এখনো কিছু সময় বাকি। এরই মধ্যে খাবার টেবিলে সাজানো হয়েছে। সবাই টেবিলের চারপাশে বসে আছে, ফাহিম এবং অনুতোষ এসে হাত-মুখ ধুয়ে এক কোণায় বসে পড়েছে। ফাহিমের সমবয়সী কাজের মেয়ে বিভিন্ন আইটেম টেবিলে সাজিয়ে রাখছে।

সময় প্রায় শেষ, সবাই অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে। অনুতোষের সামনেও সবার সমান খাবার দেওয়া হয়েছে। বিশাল আয়োজন! আযান দিতেই সবাই প্রথমে সরবতের গ্লাসে চুমুক দেয়। অনুতোষও সরবতের গ্লাসে চুমুক দেয়। এরপর ধীরে ধীরে অন্য খাবারগুলো খেতে থাকে। অনুতোষ জীবনে এই প্রথম ইফতার করছে। ও ভেবেছে, ইফতার করার নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। ও ফাহিমকে ফলো করছে, ফাহিম যেভাবে, যার পরে যা খাচ্ছে, ও তাই তাই করছে।

হঠাৎ ওর মুখ কালো দেখে ফাহিমের মা জিজ্ঞেস করে, বাবা, তোমার কি কিছু হয়েছে? ও তাড়াতাড়ি “না” বলে আবার খাওয়ায় মনোযোগ দেয়। সবাই তখন কাবাব খাচ্ছিল, ও একটু খেয়ে আর খাচ্ছে না। ফাহিম ওকে খেতে বলে। অনুতোষ হঠাৎ চোখ মুখ লাল করে ঘামতে শুরু করে। মুখ চেপে ধরে বেসিনে গিয়ে বমি করে দেয়।

হঠাৎ সবাই ভ্যাবাচ্যাক খায়। অনুতোষ কাঁদো কাঁদো হয়ে বাড়ি যেতে চায়। ফাহিমের মা খুব দরদী মহিলা। ওকে কোলে বসিয়ে “কী হয়েছে” জানতে চায়। অনুতোষ ফিসফিস করে বলে, মা গরুর মাংস খেতে নিষেধ করেছে। গতবছর ঈদের সময় এক বন্ধুর বাসায় খেতে গিয়েছিলাম, বলেছিলেন, “গরুর মাংস খেও না। হিন্দুরা খেতে নেই।” কিন্তু আজকে যে আমি খেয়ে ফেললাম!

“সোনা, তুমি গরুর মাংস খাওনি। ওটা খাসির মাংস দিয়ে তৈরি।” ফাহিমের মা ওকে স্বান্তনা দেয়।

ফাহিম ওর মাকে বলে, মা, ওরা গরুর মাংস খায় না কেন?

– গরুতে ওদের দেবতা থাকে।

– তাহলে আমরা কি ওদের দেবতা খাই। হাহাহাহা …
– “চুপ করো” বলে মা ছেলেকে ধমক দেয়।

– আমরা শুকরের মাংস খাই না কেন?

– আমাদের ধর্মগ্রন্থে নিষেধ আছে।

– আমাদের ধর্মগ্রন্থ আর কী কী নিষেধ আছে আমাকে শিখিয়ে দাও না …

– দেব।

খাওয়া শেষে দুই বন্ধু বেরিয়ে আবার গল্পে মগ্ন হয়। কেউ-ই খুব একটা অন্তরঙ্গ হতে পারছে না। পড়াশুনা, চলাফেরা, খাওয়া-দাওয়া, সবকিছুতে ওরা কিছু পার্থক্য টের পেয়েছে ইতোমধ্যে।

এই ছোট্ট বয়সে ওরা বুঝতে বাধ্য হয়েছে, “আমরা আলাদা, কারণ, আমাদের ধর্ম আলাদ।” মিলনের চেয়ে বিচ্ছেদের সুরই যেন ওদের মধ্যে ওদের অজান্তে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।


গল্পটি দিব্যেন্দু দ্বীপ এর গল্প সংকলন থেকে সংগৃহীত।