একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কারজয়ী এই কবির বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর।
তার মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী ও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গভীর শোক জানিয়েছেন।
বিএসএমএমইউতে উপস্থিত জাতীয় কবিতা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক তারিক সুজাত সাংবাদিকদের বলেন, সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য সোমবার কবির মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হবে।
সকাল ১০টায় মরদেহ নেওয়া হবে শহীদ মিনারে। সেখান থেকে বাংলা একাডেমিতে নেওয়া হবে কফিন। জোহরের নামাজের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে জানাজা হবে।
মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে কবিকে সমাহিত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
কবিপত্নী রাজধানীর তিতুমীর কলেজের অধ্যক্ষ দিলারা হাফিজ সাংবাদিকদের বলেন, “একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হোক, আমরা শুধু এটাই চাই।”
একাত্তরে টাঙ্গাইলে আবদুল কাদের সিদ্দিকী নেতৃত্বাধীন কাদেরিয়া বাহিনীর হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন এই কবি।
কবির তিন ছেলে দেশের বাইরে রয়েছেন। তারা ফিরলে দাফনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।
এই দুদিন মরদেহ বারডেম হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হবে বলে জানান তারিক সুজাত।
গত জানুয়ারিতে ব্রেইন স্ট্রোকের পর রফিক আজাদকে বারডেম হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে আরেকটি বেসরকারি হাসপাতাল হয়ে তাকে আনা হয় বিএসএমএমইউতে। এরপর এই হাসপাতালেই নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ছিলেন তিনি।
শনিবার দুপুরে চিকিৎসকরা এই কবির মৃত্যু ঘোষণা করেন বলে তার বড় ভাইয়ের মেয়ে নীরু শামসুন্নাহার জানান।
বিকাল ৩টার দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল হাসান খান সাংবাদিকদের বলেন, “বেদনার সঙ্গে জানাচ্ছি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি, বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিক আজাদ চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুপুর ২টা ১৩ মিনিটে ইন্তেকাল করেছেন।
“তিনি আমাদের এখানে ৫৮ দিন ছিলেন। অনেক রোগে ভুগছিলেন তিনি। সর্বশেষ তার স্ট্রোক হয়।”
লাশের গোসলের সময় আহাজারি করছিলেন কবিপত্নী দিলারা- “আমি যাব কোথায়? কীভাবে বাঁচব?”
এ সময় তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন লেখক সৈয়দ শামসুল হকসহ অন্যরা।
পিতৃবিয়োগে শোকাহত অব্যয় আজাদ এ সময় বলেন, “বাবা বলতেন, তার কোনো খেদ নেই। তিনি কোনো আক্ষেপ রেখে যাননি। আমাদেরও কোনো আক্ষেপ নেই।
“আজন্ম যোদ্ধা ছিলেন ছিলেন তিনি। জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে চলে গেছেন।”
কাদের সিদ্দিকী সাংবাদিকদের বলেন, “আমার সঙ্গে রণাঙ্গনে ছিলেন রফিক আজাদ। বহুজন ঘর-বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেলেও তিনি যাননি, রণাঙ্গনেই ছিলেন। তিনি অস্ত্রহাতে তুলে নিয়েছিলেন। অস্ত্রহাতে যারা যুদ্ধ করেছেন, তাদের সাহস জুগিয়েছেন।
“একটা কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘আমার কমান্ডার আমাকে আত্মসমর্পণ করতে শেখায়নি’। তিনি কখনও কোনো কিছুর কাছে আত্মসমর্পণ করেননি।”
ষাটের দশকের ‘উজ্জ্বলতম কবি’র চলে যাওয়ায় তার ‘অশ্রুমাখা অমর পঙক্তিগুলো’ জাতির জন্য সম্পদ হয়ে থাকবে বলে মন্তব্য করেন তাদের পাশে থাকা সৈয়দ হক।
“তিনি একটা কবিতায় বলেছিলেন, ‘চলে যাব সুতোর ওপারে’। আজ তিনি সুতোর ওপারে চলে গিয়েছেন। তার পেছনে রেখে গেলেন আমাদের অশ্রু আর অশ্রুমাখা তার অমর পঙক্তিগুলো। তার এই কবিতাগুলো আমাদের বাংলা সাহিত্যের সম্পদ হয়ে থাকবে।”
বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কবির মৃত্যুর খবর শুনে আসা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, “কবি রফিক আজাদ শুধু লেখালেখির কারণ নয়, চাকরির সূত্রেও বাংলা একাডেমির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তার ছন্দের গাঁথুনি ছিল অসাধারণ, গল্পকথক হিসাবেও ছিলেন অনন্য।”
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ বলেন, “রফিক আজাদ আমাদের যৌবনের কবি। আমরা যখন যুদ্ধে গিয়েছি তখনও তিনি কবি, যখন ফিরে এসেছি তখনও তিনি কবি। এবং আমৃত্যু তিনি মুক্তিযোদ্ধা।”
রফিক আজাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হাসপাতালে আসা অন্যদের মধ্যে ছিলেন কবি আসাদ চৌধুরী, কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক, ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহফুজা খানম, কবি নাসির আহমেদ, কবি আবু হাসান শাহরিয়ার, কবি হাবিবুল্লাহ সিরাজী, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ প্রমুখ।
১৯৪১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল থানার গুণী গ্রামের এক অভিজাত পরিবারে জন্ম রফিক আজাদের। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে শুরু করেছিলেন শিক্ষকতা।
এরপর বাংলা একাডেমিতে যোগ দিয়ে একাডেমি প্রকাশিত পত্রিকা ‘উত্তরাধিকার’র নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে ১৯৭২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
সাপ্তাহিক রোববার সম্পাদনার দায়িত্বও পালন করেন তিনি। কাজ করেছেন বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন, উপজাতীয় কালচারাল একাডেমি ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে।
স্কুলজীবনে কবিতার হাতেখড়ি হওয়া রফিক আজাদ কেন লিখছেন, তার উত্তর নিজের কবিতায় দিয়েছেন এভাবে- “নির্বিবেক মধ্যবিত্ত পাঠকের পরম্পরাময়/মাংসল পাছায় খুব কষে লাথি মারা সম্ভব হয় না বলে/ লাথির বিকল্পে লেখা…”
রফিক আজাদের জনপ্রিয় অনেক কবিতার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হল ‘ভাত দে হারামজাদা’। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটে তার এই কবিতা।
এই কবিতার জন্য তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতার বিরাগভাজন হলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবির ‘স্বাধীনতা’য় হস্তক্ষেপ করেননি বলে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন রফিক আজাদ।
“বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী আর আনওয়ারুল আলম শহীদ, বঙ্গবন্ধুর কাছে আমারে নিয়া গেছিলেন। উনি ব্যাখ্যা চাইলেন। আমি ব্যাখ্যা দিছি, সারা পৃথিবীর নিরন্ন মানুষের প্রধান চাওয়া হলো ভাত। আমি সারা পৃথিবীর লোকের কথা বলছি। আর আমাদের দেশে, নিরন্ন মানুষ এই ভাষাতেই কথা বলে।
“এটা বলার পর উনি বলে, ‘তা বটে!’ আমার কাঁধে হাত রাইখা বলল, ‘ভালো লিখছিস, যাহ’।”
কবিতা লেখার শুরুর অনেক পরে বেরিয়েছে রফিক আজাদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ। তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে আছে- ‘অসম্ভবের পায়ে (১৯৭৩); সীমাবদ্ধ জলে, সীমিত সবুজে (১৯৭৪); নির্বাচিত কবিতা (১৯৭৫); চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া (১৯৭৭)।
ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৩ সালে তাকে একুশে পদক দেওয়া হয়। ১৯৮১ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারের পর সাহিত্য কর্মের জন্য আরও অনেক স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি।