ছেলে অনেকদিনপর বাড়ি আসছে, মায়ের আনন্দের শেষ নেই। মা মাঝে মাঝে ভাবে এর চেয়ে ছেলে-মেয়ে পড়াশুনা না শেখাই ভালো, এমন দূরে গিয়ে থাকলে পড়াশুনা করিয়ে লাভ কী!
এটা তার অবশ্য কথার কথা, সব মায়ের মতো সেও চায় ছেলে-মেয়ে অনেক বড় হোক, নাম হোক, যশ হোক। পাড়ার লোকে বলবে, অমুকের মা, তাতেই তার শান্তি। যখন পাড়ার কেউ বলে, “ও রায়হানের মা, তোমার পোলাডা তো একটা সোনার ছেলে।” এতেই তার জীবন পুর্ণ হয়ে যায়। আর কিছু সে চায় না। আগে সে খুব একটা বাড়ির বাইরে যেত না। এখন এ পাড়ায় ও পাড়ায় যায় শুধু ছেলে সম্পর্কে দুটো ভালো কথা শোনার জন্য।
রায়হান বাড়িতে ঘন ঘন আসতে পারে না। পড়াশুনার চাপ, পাশাপাশি টিউসনি করে অনেকগুলো। তবে যখন আসে খুব আড়ম্বর করে বাড়িতে আসে সে। বেশ টাকা পয়শা খরচ করে যায়, পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভালো মন্দ খেয়ে যায়। তাতে করে সে আরও বেশি সোনার ছেলে হয়ে ওঠে। অনেকের চোখে প্রতিহিংসার পাত্রও হয়। তবে গ্রামের বেশিরভাগ লোক রায়হানকে ভালোবাসে।
রায়হান গ্রামে এসে চুপচাপ থাকে না। গ্রামে সাত দিন থাকলে অন্তত সাতটা ইভেন্টে জড়ায়, এভাবে গ্রামের মানুষের ভালোর জন্য নীরবে কিছু কাজও সে শুরু করেছে, যদিও খুবই পরোক্ষভাবে। কারণ, গ্রামগুলোও চলে গেছে এখন দুবৃত্তের দখলে, চাইলেও সরবে খুব বেশি কিছু করা সম্ভব নয়।
ইদানিং গ্রামের শয়তান মানুষগুলোর চোখের পড়ে গিয়েছে সে। বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কুদ্দুস মিঞা তাকে খুব খারাপ চোখে দেখতে শুরু করেছে। কুদ্দুস মিঞার সাথে রায়হানের একবার বেশ বচসাও হয়েছিল। ওয়ার্ডের মেম্বারও তাকে সহ্য করতে পারে না। রায়হানের উপস্থিতিই তাদের গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেয়।
ও বাড়ি আসবে রবিবার। এদিকে এলাকায় খুব তোলপাড় চলছে একটা ঘটনা নিয়ে। পাশের গ্রামের একটা মেয়েকে মাদ্রাসায় যাওয়ার পথে কে বা কারা তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে, মুমূর্ষু অবস্থায় মেয়েটিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
এ খবর শোনার পর থেকে মায়ের একটু ভয়ভয় করে। মায়ের মন, কোনো অস্থিরতা চারপাশে হলেই মায়েদের ছেলেমেয়ের জন্য এক ধরনের চাপা ভয় কাজ করে। মা বারে বারে ফোন দিতে চেষ্টা করে। রায়হান ফোন ধরে না।
রবিবার পার হয়ে গেল কিন্তু রায়হান আসলো না, মা কিছুতেই বুঝতে পারছে না। মোবাইল করেও পাওয়া যাচ্ছে না। এভাবে সারাদিন মোবাইল তো বন্ধ থাকে না। বাড়িতে ছোটো বোন আর অসুস্থ পিতা ছাড়া কেউ তেমন নেইও।
কয়দিন হলো সুমি মামাবাড়ি গিয়েছে। একারণেও মা খুব অসহায় বোধ করছে। পাশের বাড়ির সুমনকে বলে মা চেষ্টা করে বাস কাউন্টারে খোঁজ নিতে। সুমন কোনো তথ্য আনতে পারে না। আজকেও সারাদিনটা কেটে যায়। রাত কেটে যায়।
সকালে একটা খবর সবাই খুব বলাবলি করছে। কে নাকি উত্তর পাড়ার মাঠে একটা লাস পড়ে থাকতে দেখেছে।
মায়ের বুকের মধ্যে ধক করে ওঠে। একটু বেলা গড়াতে আরও খবর আসে। সুমী খবর শুনে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে চলে এসেছে বাড়িতে, কিন্তু প্রতিবেশীরা কেউ খবর নিচ্ছে না।
মা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। সুমন এসে চেষ্টা করছে সবাইকে শান্ত করতে।
রায়হানের গলায় ভুল বানানে লেখা, “আমি ধরসক …”।
সবাই স্তব্ধ।
শুধু সুমন বারে বারে বলছে, “অসম্ভব, সুমন ভাই কোনোভাবেই জড়িত নয়, তাকে ষড়যন্ত্র করে হত্যা করা হয়েছে। আমি জানি কে করেছে, আমি বুঝতে পারছি কে করেছে।”
ছোট্ট ছেলের কথা কেউ পাত্তা দিচ্ছে না, কালাম মেম্বার ধমক দিয়ে সুমনকে থামিয়ে দেয়।
পুলিশ এসেছে। পোস্টমর্টেম দরকার আছে কিনা বলাবলি হচ্ছে। উপস্থিত লোকজন সবাই নীরব, শুধু মেম্বার এবং চেয়ারম্যানের সাথে যারা থাকে তারাই সব ম্যানেজ করছে। কিছুক্ষণ পর পুলিশ লাস নিয়ে যায়। সদর হাসপাতলে লাসের সুরতহাল হবে। চেয়ারম্যানের লোকজন লাশ পৌঁছার আগেই হাসপাতালে পেঁৗছে যায়।
এদিকে ধর্ষক খুন হওয়ার খবর ফেসবুকের মাধ্যকে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। সবাই খুব হাততালি দিচ্ছে, সবাই চায় ধর্ষকের এমন পরিণতি হোক। অবশ্য এমন একটি কথাও চোখে পড়লো, সেখানে লেখা- “এদেশের কমপক্ষে আশিভাগ লোক দুবৃত্ত, দুবৃত্তের দেশে অন্যের সাজাটাও তারা খুব তাৎক্ষণিক এবং মর্মান্তিক চায়। কোথাও ভুল হলো কিনা এটা তাদের বিবেচনার বিষয় নয়, বিবেচনার শক্তি তাদের নেই।”
গল্পটি দিব্যেন্দু দ্বীপ -এর গল্পসমগ্র থেকে সংগৃহীত।