ছোটগল্প: ফাঁসি

Hasna Hena

ভোর নেমেছে এইতো কিছুক্ষণ। তারপরও সূর্যটা বেশ প্রখর । উত্তরের ভিটের ভাঙা ঘরটার পেছনে শিরদাঁড়া উঁচু করে সটান দাঁড়িয়ে থাকা সুপারিগাছগুলো কেমন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে সূর্যের দিকে । বাতাসে শূন্যতার ঘ্রাণ। অক্সিজেনের অভাব বোধ করছে নিলু। বুকের ভেতরটা ভীষণ ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।

গত এক বছরে রাজ্যের শূন্যতা বাসা বেঁধেছে তাঁর বুকের ভেতরটায়। পৃথিবীর কোথাও যেন নিলুর জন্য একটু স্বস্তি নেই এমনটাই মনে হচ্ছে তাঁর। ছেলে, মেয়েরাও আজ জলদি বিছানা ছেড়েছে। দৌড়াচ্ছে নিজেদের মতই খেলছে । নিলু অবাক হয়ে দেখছে ওরা কতটা স্বাভাবিক। ওদের কোন চিন্তা নেই ভাবনা নেই । মাঝে মাঝে রাতে শুতে গিয়ে ঘুম পাড়ানি শুনতে শুনতে হঠাৎ প্রশ্ন করে মাকে-
– আমাগো আব্বা কি আর কোনো দিন জেল থন ছাড়া পাইবো না মা?
– নিলু ভারি গলায় জবাব দেয় কে কইছে ছাড়া পাইবো না! সময় হলি অবশ্যি ছাড়া পাইবো।
– সবাই তো কয় বাবা নাকি আর কোনো দিন জেল থন ছাড়া পাইবো না!
– যারা এসব কয় হগলতেই মিছে কতা কয়। খুব জলদিই তোর বাবা ছাড়া পাইবো।

সাত সকালেই কতগুলো কাক উদাস গলায় কা কা কা করে ডেকে সাঁই-সাঁই উড়ে গেল নিলুর ঠিক মাথার উপর দিয়ে। কাকের কা কা শব্দে শিউরে উঠলো নিলু, ভয়ে কেঁপে ওঠল প্রাণ। ভেতরে কোথাও তীক্ষ্ম কিছুর আঁচড় অনুভব করলো সে। মনটা কেমন যেন কু-ডাক ডাকছে। কপালে হাত দিয়ে বসে ভাবনার ঘোরে চলে যায় নিলু। ঘোর কাটে, কাজ করে, আবার ঘোরের মধ্যে চলে যায়। এভাবেই চলছে, সে কিছুতেই কাজে মন বসাতে পারছে না আজ। স্বামীর কেসের চুড়ান্ত রায় কী হবে? একটা ভাবনাই মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। অভাবের সংসার ঠিক, তবে ভালোবাসার কমতি ছিল না ওদের ভাঙা ঘরে। গত এক বছরে অনেক কেঁদেছে, অনেক ঝড় তুফান পেরুতে হয়েছে তাকে। এই এক বছরে কত চিল, শকুন নখর বসাতে চেয়েছে নিলুর শরীরে তা কেবল নিলুই জানে? সেই শৈশবে বাবাকে হারিয়েছে, বাবার চেহারাটাও স্পষ্ট মনে পড়ে না । বাবার ভালোবাসা কেমন হয় তাও মনে নেই।

মা অন্যের বাড়ি কাজ করে অনেক কষ্টে তিন ভাই বোনকে বড় করেছেন। পাঁচ বছর হলো সে মাও পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন। গত ক’দিন ধরে মাকে খুব মনে পড়ছে নিলুর। এই কষ্টের সময় যদি মা বেঁচে থাকতেন তাহলে হয়তো ….হায় জীবন। জীবন তিন অক্ষরের জটিল গহ্বর। মোহ মায়া কিংবা ঘোর। কষ্টের চোরাবালিতে ফেঁসে গিয়ে হাঁসফাঁস করতেই করতেই কখন ফুরিয়ে যায় সময়। অতঃপর হঠাৎ একদিন দপ করে নিভে যায় জীবন প্রদ্বীপ। এ’জীবন কারো কাছে খুব মূল্যবান। কেউ আবার নিত্যই নিজ মৃত্যু কামনা করে। নিলুও আজ বার বার স্রষ্টার কাছে নিজের মৃত্যু কামনা করছে। কিন্তু দুসন্তানের কথা ভাবতেই বুকের ভেতরটায় হু হু করে ওঠে। উনুনে বসানো টগবগ করে ফুঁটতে থাকা ভাতের পাতিলের দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে ভাবছে নিলু।

প্রতিদিনের মতই খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে কাজ শুরু করেছে। ছেলে মেয়ে আর শাশুড়ির জন্য চারটে ডাল ভাত রান্না করে রেখে আদালতে যাবে নিলু। শাশুড়িও অসুস্থ, বেশ কিছু দিন হলো বিছানা নিয়েছেন তিনি। হয়তো একমাত্র ছেলের কারাবাস উনি সহ্য করতে পারেননি। নিলুর স্বামীর কেসের আজ চূড়ান্ত রায় হবে। এক বছর হলো খুনের দায়ে নিলুর স্বামী কারাগারে আছে। স্বামীর শেষ পরিনতি কী হবে? সে ভাবনায় এক ফোঁটা ঘুম নামেনি চোখের পাতায়। গত এক বছর নিলু আধ পেটে খেয়ে কখনও না খেয়ে অন্যের বাড়িতে কাজ করে সন্তান আর শাশুড়ির মুখে আহার তুলে দিয়েছে ।

ক্লান্ত পরিশ্রান্ত বড় বেশি তৃষ্ণার্ত যেন আজ পৃথিবী। ঘুমোট আকাশে মেঘেরা দল বেঁধে উড়ছে। বিকেল গড়িয়ে বেড়াল পায়ে এগিয়ে আসছে সাঁঝ । নিলু রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে এলোমেলো পায়ে। পৃথিবীর সকল ক্লান্তি এসে ভর করেছে নিলুর পরিশ্রমে কাতর দুটি পায়ে। গতকাল দুপুরের পর থেকে পেটে কিচ্ছুটি পড়েনি। গলা দিয়ে পানিও নামতে চায় না।

বারে বারে কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলো চেয়ারম্যান বাড়ির কাজের মেয়ের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলা কথাগুলো। নিলু বিড় বিড় করে আনমনে বলেই যাচ্ছে, না….আমি উনারে চিনি আমার স্বামী কহনও চুরি করতে পারে না, আমার স্বামী কহনও কাউকে খুন করবার পারে না। আমি বিশ্বাস করি না, সব মিছে কতা।

আদালতের সামনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিল নিলু। সাথে দূর সম্পর্কের একজন আত্মীয় ছিল। তিনিই চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে গাছের ছায়ায় শুয়িয়ে বাতাস করেছেন । নিলু জ্ঞান ফিরতেই দেখে তার চারপাশে ভিড় করে ঘিরে আছে অনেক লোকজন। নিলু নিচু গলায় প্রশ্ন করে,

– আমি এইহানে ক্যান? আমার কী হইছিলো ভাই?
– ভাবী আপনে আদালতের সামনে জ্ঞান হারাইছিলেন। আমি আরও কয়েকজনরে নিয়্যা আপনেরে এইহানে নিয়্যা আইছি।

কান্নায় ভেঙে পড়ল নিলু। সন্তানদের এতদিন সান্ত্বনা দিয়ে এসেছে- সময় হলেই তোদের আব্বা ফিরে আসবে। আজ কী জবাব দিবে ওদের? কী করে বলবে তাদের বাবার ফাঁসির আদেশ হয়েছে। তাদের বাবার সময় ফুরিয়ে এসেছে। আর চার দিন পর পৃথিবী থেকে মুছে যাবে ওদের বাবা। ভাবতে ভাবতে বুকের ভেতর পাঁজর ভাঙা ব্যথা অনুভব করে নিলু। চোখের সামনে ভেসে ওঠে অতীত দিনের একসাথে কাটানো সুন্দর সুখময় মুহূর্তগুলো। সেই কৈশর পেরুতেই যে মানুষটির হাত ধরে এই সংসারে এসেছিল, ধ্যান খেয়াল সবটুকু জুড়ে যে মানুষটার বসত, তাঁকে ছাড়া কীভাবে কাটাবে বাকি জীবনটা -ভাবতেই পৃথিবী জুড়ে আঁধার নেমে আসে।

আহা…এমন আলাভোলা মানুষটার আজ ফাঁসির আদেশ হয়েছে! তাও আবার চুরি করতে গিয়ে এক নারীকে খুন করার অভিযোগে। হায়রে টাকা পয়সা, তোর কেরামতির কাছে …. ভাবতে ভাবতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেদিনের দৃশ্য। একদিন রাতে চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ফিরছিলেন নিলুর স্বামী ছেলিম। নিলু ভয়ে চুপসে যাওয়া মুখ দেখে জিজ্ঞেস করেছিল, কী হয়েছে তোমার? তোমার মুখ খান এমন ফ্যাকাসে লাগতাছে ক্যান? প্রথমে বলতে চায়নি ছেলিম। অনেক পিড়াপিড়ি করার পর পুরো ঘটনা খুলে বলেছিল।

চেয়ারম্যান আর তাঁর স্ত্রীর মধ্যে প্রায় সময় ঝগড়া হত। আর সেদিনও খুব ঝগড়া হয়েছিল ঝগড়ার মাঝেই চেয়ারম্যান তাঁর স্ত্রীর মাথায় লাঠি দিয়ে জোরে আঘাত করলে সাথে সাথেই চেয়ারম্যানের স্ত্রী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। নিলুর স্বামী ছেলিম তখন সেখানে উপস্থিত ছিল। এ খুনের সাক্ষী চেয়ারম্যান বাড়ির কাজের মেয়ে আর ছেলিম। কাজের মেয়েকে বেশ কিছু টাকা দিয়ে ভয় দেখিয়ে মিথ্যে সাক্ষী দিতে বাধ্য করে চেয়ারম্যান । কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মেয়েটি এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলে চেয়ারম্যানের শিখিয়ে দেয়া মিথ্যা কথাগুলো। সেদিন কল্পনাও করেনি নিলু সেই খুনের দায় তাঁর স্বামী ছেলিমের ঘাড়েই চেপে বসবে।

আস্তে আস্তে বাড়ি ফিরে নিলু। উঠোনে পা রাখতেই বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে, চিরচেনা উঠোনটা অচেনা লাগে। এটাই কী সেই পরিচিত উঠোন? যেখানে ঐ সাদাসিদে মানুষটা তাঁর হাত ধরে নিয়ে এসেছিল একদিন? তারপর ছোট্ট একটা সংসার। কতগুলো বছর একসাথে হেসে খেলে কেটে গেছে এই উঠোনেই। সবই স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে আজ। এলোমেলো পায়ে উঠোনটুকু পেরোয় নিলু। বারান্দার খুঁটি ধরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে থপাস করে বসে পড়ল মাটিতে। ছেলেমেয়ে দৌঁড়ে এসে নিলুর গলা জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে –
– মা, আমাগো আব্বা কই? তুমি না কইছিলা আমাগো আব্বায় ফিইরা আসবো, তাইলে তুমি একা আইলা ক্যান? আমাগো আব্বা আহে নাই ক্যান?
ঘর থেকে শাশুড়ি কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে
– কী রে বউ আইলি? আমার পোলারে নিয়্যা আইস নাই? আর কত অপেক্ষা করুম, মরার আগে একবার আমার পোলারে দেখবারও পারুম না?
নিলু নির্বাক। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে ছেলেমেয়ের মুখের দিকে। বুকের উপর একটা পাথর চেপে বসে আছে। নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসছে। পৃথিবীর সব কিছুই মিথ্যে মনে হচ্ছে। বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠছে বিগত দিনের মধুর স্মৃতিমাখা মুহূর্তগুলো।

নিলুকে চুপ থাকতে দেখে,শাশুড়ি চিৎকার করে বলতে শুরু করল –
ও…লো মাগির বেটি কতা কস না ক্যান?
কানে কী তুলা গুঁইজা রাখছসনি? অপয়া, কুলটা মাইয়্যা। মা-বাপ সব খাইয়াও খিদা মিটে নাই তোর? এখন আমার পোলাডারেও খাইলি।
নিলু নির্বাক। চুলগুলো রুক্ষ আলুথালু, চোখ দুটো ফোলা ফোলা লাল বর্ণ হয়ে আছে। ভেতরে কূল ভাঙা ঢেউ আঁচড়ে পড়ছে। বুক ভেঙে যাচ্ছে, কাঁদতেও পারছে না। বারান্দায় খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে আছে। মেঘের ভারে নুয়ে পড়েছে আকাশ। হঠাৎ ছন্নছাড়া এলোমেলো বাতাস বইতে শুরু করল। সাথে অঝর ধারায় বৃষ্টি নামল, ভিজে গেল নিলুর চোখের পাতা। চোখের জল আর বৃষ্টির জল মিলে মিশে গড়িয়ে পড়ছে নিঃশব্দে।


হাসনা হেনা                           হাসনা হেনা