ছোটগল্প: শবদাহ

ভারত

বলা যায় একদম হঠাত করেই কোলকাতায় আসা। উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার সদর শহর বারাসাতে এক আত্মীয়ের বাসায় উঠেছি। আমি একরকম চুরি করেই করোনার মধ্যে কোলকাতায় এসেছি। যশোর থেকে এক দালালের সহযোগিতায় এসেছি। বাংলাদেশে ফিরবও ঐ দালালের সহযোগিতায়। আসা যাওয়া, শুধু বর্ডারটুকু পার হওয়ার জন্য পাঁচ এবং পাঁচ— দশ হাজার টাকা কন্ট্রাক্ট করেছি। ভিসা পাসপোর্ট দিয়ে এ সময় যাওয়া সম্ভব ছিল না। 

কোলকাতার লকডাউনের অবস্থাও ঢাকার মতোই— পুলিশ একদিক থেকে পিটাইলে লোকজন আরেকদিকে গিয়ে জড়ো হয়। কোলাকাতা আর ঢাকার মানুষের মধ্যে তুলনা করলে দেখি, লোকজনের চরিত্রে কোনো পার্থক্য নেই, ধর্মটা শুধু শুধু তারা আলাদা করেছে! চরিত্র একই আছে।

বারাসতের পৌরএলাকায় সৌমেন নামে এক বিজ্ঞানমনস্ক তরুণ কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে মৃতদের শবদাহ করার জন্য ফিউনারেল-১৯ নামে একটি ক্লাব করেছে। বারাসাত পৌর এলাকাতে ওরা সেবাটা দিচ্ছে। কোনোদিক থেকে ফোন আসলেই ওরা ছুটে যায়। শুধু যে শবদাহ করছে তা নয়, রুগীর সেবাশুশ্রুষাও করছে। ক্লাবে এই মুহূর্তে স্বেচ্ছাসেবক আছে বাইশ জন। আমাকে নিতে অনুরোধ করলেও ওরা আমাকে নিচ্ছে না। আমি তথ্য গোপন করলাম, বাংলাদেশী বললাম না। একবার করোনা হয়েছিল জানার পরে ওরা আমাকে ক্লাবের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নিতে রাজি হলো।

আমি আজকে প্রথম কলে যাচ্ছি। হাতে গ্লোভস পরে, এন-৯৫-এর উপরে আরও একটি মাস্ক পরে, পিপিপি পরে আমরা চারজনে রওনা হলাম শবদাহ করতে। মেয়েটি তিন মাসের অন্ত:স্বত্ত্বা ছিল। পরিবারের সবাই বাসার এক পাশে বিলাপ করছে, মেয়েটির লাশ পড়ে রয়েছে বারান্দার সাথের রুমে। কেউই কাছে যাচ্ছে না। স্বামী, শাশুড়ী, শশুর সবাই “হায় ভগবান” “হায় ভগবান” করছে কিন্তু কেউ লাশ সতকারের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। ফিউনারেল-১৯-এ ফোন দিয়েছে একজন প্রতিবেশী।

আমরা লাশ মুড়িয়ে নিয়ে দ্রুত শ্মশানঘাটের দিকে রওনা হলাম। করোনার কারণে শশ্মানঘাটে লাসের সংখ্যা দিগুণ বেড়েছে বলে ওদের মন্তব্য। করোনাক্রান্ত হলে মৃত্যুবরণ করলে অত নিয়ম কানুনের বালাই নেই, জাস্ট পুড়িয়ে ফেলা। স্বজনরা দূরে দাঁড়িয়ে থাকলো, আমরা ডোমদের সহায়তায় রোবটের মতো লাস পুড়িয়ে চলে আসলাম। স্বজনেরা “ভগবান ভগবান”-ই করতে থাকলো। একইসাথে আমাদের কাছে আসতেও ভয় পেল। মানুষ বাঁচতে চায়, সাধারণ মানুষ বেশি বাঁচতে চায়, এর চেয়েও বেশি বাঁচতে চায় বোধহয় অমানুষেরা। 

আসার সময় পথে একটি মন্দির পড়ে। কৌতুলবশত মন্দিরটির কাছে আমরা একটু দাঁড়ালাম। মন্দিরে পূজো দেওয়ার জন্য দুটো লাইন করা হয়েছে। একটি লাইন সাধারণ পূণ্যার্থীদের, আরেকটা লাইন করোনার জন্য যারা পূজো দিতে এসেছে তাদের জন্য। পূজোর রকমও খুব সহজ— ওরা দক্ষিণা দিচ্ছে, পূজারী দক্ষিণা অনুপাতে একটি প্যাকেট ধরিয়ে দিচ্ছে। দক্ষিণা বিশ টাকা দিলে প্যাকেটে হয়ত দশ টাকার কিছু একটা আছে, সাথে দুএকটা ফুলের পাপড়ি, দুএকটা তুলসীর পাতা এবং দুর্বাঘাস। ঠিক দোকান যেন, তবে দোকানের চেয়ে লাভের অংকটা একটু বেশি। দোকানে আপনি দশ টাকা দিলে সাত টাকার খাবার পাবেন, এখানে পাচ্ছেন বড়জোর পাঁচ টাকার। দোকানের ভাড়া দেওয়া লাগে, অনেক ধরনের ব্যবস্থাপনা করা লাগে। এরা সরকারি জায়গায় বা জনগণের জায়গায় দোকান খুলেছে, ব্যবস্থাপনাটাও জগণের বা সরকারের মানে জনগণের। সাধারণ সময়ে এতে সমস্যা খুব বেশি নেই, কিন্তু সর্বনাশ হচ্ছে— এটা আন্দাজ করা যায় যে, এই মন্দির থেকে এই মুহূর্তে প্রতিদিন অন্তত দশজনের মধ্যে করোনা ছড়াচ্ছে।

ফিরে আসার সময় একটা বিস্ময়কর ব্যাপার ঘটলো— আমরা যার শবদাহ একটু আগে পুড়িয়ে আসলাম তার স্বামী, শশুর, শাশুড়ী সবাই দেখলাম এই মাত্র মন্দিরে প্রবেশ করলো! আরও দেখলাম, খুব দু:খিত তারা নয়, বিপরীতে বেশ বড় একটা মিষ্টির প্যাকেট এবং একশো টাকা বের করে পূজারীর হাতে দিলো। পূজারীও কিছুক্ষণ পরে তাদের একটি প্যাকেট দিলো। গড় হয়ে প্রণাম করে ভিড় ঠেলে তারা বিদায় নিলো।

এর পরেও অনেক কলে গিয়েছি— বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা হয়েছে। আজকে আবার একটি কলে যাব। সৌমেন বলছে, মনে হচ্ছে এই ঠিকানাতেই আমরা সেদিন গিয়ে অন্ত:সত্ত্বা নারীর শবদেহ পুড়িয়ে এসেছি (?) সবাই আমরা কনফিউজড্! সত্যিই এক মাস পরে আবার সেই একই বাড়িতেই আমরা পৌঁচেছি। স্বামী করোনাক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছে। সেই শশুর, শাশুড়ীও করোনাক্রান্ত। খবর নিয়ে জানলাম গত এক মাস ধরে মা বাবা এবং নিজের জন্য আশীর্বাদ চাইতে প্রতিদিন সে (স্বামী) পাশ্ববর্তী মন্দিরে গিয়েছে। অতএব, এটাই সঙ্গত ধারণা যে, ঐ মন্দির থেকে হয়ত সে আক্রান্ত হয়েছে, কারণ, এমনিতে তারা ভীষণ সাবধানী আচরণ করেছে সবসময়। শুধু মন্দির বা ভগবানের ঘরকে ভয় পায়নি! আমি মনে মনে ভাবছি— আমাদের দেশেও তো আল্লাহর ঘর আছে, সেখানেও কি একই রকম চলছে?

আমাদের কাজ করোনায় কেউ মারা গেলে তার শবদেহ পোড়ানো। অন্যকিছু নয়। আমরা লাস ‍মুড়ে নিয়ে পুড়িয়ে চলে আসলাম।