ছোটগল্প: সৌভাগ্য বয়ে বেড়ানো সুন্দর প্রজাপতিটি // দিব্যেন্দু দ্বীপ

butterfly

বড় ছেলেটি চিৎকার করে বলল, মা, দ্যাখো দ্যাখো, কত সুন্দর একটা প্রজাপতি! নানু, বলেছিল, প্রজাপতি ঘরে আসলে নাকি টাকা আসে। মা তখন জামা কাপড় ভাজ করছিল, ছেলের কথায় কোনো পাত্তা না দিয়ে বলে, তুমি তাড়াতাড়ি গোসলটা সেরে নাও। আজকে আমরা বাইরে যাব। মেটে রংয়ের উপর কালো কালো ফোটার প্রজাপতিটি সুইচবোর্ডের উপর বসে ছিল। সৌম্য খাটের কার্নিশে উঠে প্রজাপতিটি ধরতে যায়। প্রজাপতিটি ওর ছোট্ট হাতকে ফাঁকি দিয়ে ডানা দুটো আলোতো করে মেলে মায়ের হাতের কাপড়ের উপর গিয়ে পড়ে। প্রজাপতিরা বোধহয় মৃত্যুঝুঁকি বোঝে না। কেউ ধরতে গেলে দৌড় দেয় হয়ত আনন্দে, নয়তো বিরক্তিতে। নইলে এক মানুষের হাত থেকে বাঁচতে ও কেন আরেক মানুষের হাতে গিয়ে পড়বে? এবার মা বলে ওঠে, “সত্যিই তো প্রজাপতিটা খুব সুন্দর।” সুবর্ণার উল্লাস শুনে কাজের বুয়াও জানালা মোছা বাদ দিয়ে প্রজাপতিটি দেখতে আসে। সৌম্য এবার প্রশ্রয় পায়। মায়ের কাপড়ের উপর থেকে প্রজাপতিটি ধরে নিজের হাতে নিতে চায়। প্রজাপতিটা আবার আঁকা ছবির মতো পাতলা ডানা মেলে উড়াল দেয়। এবার গিয়ে বসে আলনার উপর। সৌম্য আবার ধরতে যায়। এবার ডানাটা একটু ধরতে পারে। মনে হলো যেন ডানাটা কিছুটা ভেঙেই গিয়েছে। প্রজাপতিটা আবার একটু সরে গিয়ে বসে। 

কাজের বুয়া কাজে মন দেয়। সুবর্ণাও কাপড় ভাজ করে আলমারিতে রাখতে থাকে। সৌম্য এবার একটা পাটকাঠী নিয়ে প্রজাপতিটাকে খোঁচাতে থাকে। দু’তিনবার খোঁচা দিয়ে মায়ের ধমক খেয়ে বিরত হয়। কিছুক্ষণ পরেই সৌম্যর ছোট ভাই রম্য স্কুল থেকে আসে। সৌম্য রম্যকে ডেকে প্রজাপতিটা দেখায়। রম্যও খুব আহ্লাদিত হয়। বইয়ের ব্যাগটা কোনোমতে রেখে প্রজাপতিটা ধরতে যায়। সৌম্য এবার অভিভাবকের ভূমিকা নিয়ে বলে, ধরতে হয় না, শুধু দ্যাখ। রম্য একটা তালপাতার পাখা এনে প্রজাপতিটাকে জোরে বাতাস দেয়, বাতাসের তোড়ে ও সরে যেতে গিয়ে পড়ে যায় আলনার নিচে। ডানায় খুব ব্যথা। আলনার উপর উঠতে গিয়েও উঠতে পারছে না। খুব কষ্ট করে জুতোর বাক্সের উপর গিয়ে বসে। রম্য আলনা ঝাঁকি দিয়ে প্রজাপতিটাকে বের করতে চেষ্টা করে। এমন সময় জানলা দিয়ে নানুকে দেখতে পায়। নানুর হাতে অনেকগুলো প্যাকেট, নানান ধরনের খাবার দাবার। দুই ভাই খাবার নিয়ে ব্যস্ত হয় পড়ে। সুবর্ণা মাকে দেখে খুশিতে হাত থেকে ব্যাগগুলো নিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে। 

রম্য খাবারের প্যাকেটগুলো রেখে নানুকে প্রজাপতিটা দেখাতে চায়। সৌম্যও যোগ দেয়। “নানু, তুমি না বলেছিলে প্রজাপতি ঘরে আসলে টাকা হয়। তাহলে এবার কি আমাদের অনেক টাকা হবে?” নানু মাথা নেড়ে ‘হা’ সূচক জবাব দেয়। নানুকে অমনোযোগী দেখে রম্য এসে ঝাঁকি দিয়ে বলে, নানু, আমাদের অনেক টাকা হলে তোমাকেও দেব। নানু হাসতে থাকে। প্রজাপতিটা আলনার কাপড় বেয়ে বেয়ে উপরের দিকে উঠতে চেষ্টা করে। পারে না, কয়েকবার চেষ্টা করে ও পড়ে যায়। পঞ্চমবারের চেষ্টায় একটু উড়তে পারে। এবার জানালার দুই কপাটের মাঝখানে গিয়ে বসে। উড়ে বেরিয়ে যাবার শক্তি নেই, ডানায় খুব ব্যথা, ভেঙেছে মনে হচ্ছে। 

নানু প্রজাপতিটাকে দেখেই বলে, এটাতো রাজ প্রজাপতি! এরা আসলেই সৌভাগ্য বয়ে আনে। সৌম্য সাথে সাথে সচকিত হয়ে প্রজাপতিটাকে আবার ধরতে যায়। নানু বলে, দাঁড়াও, তোমাদের আমি এটা ধরে কাঁচের বয়ামে দিচ্ছি। সত্যি সত্যি নানু একটা কাঁচের বয়াম প্রস্তুত করে। প্রজপতিটা আহত, তাই সহজেই ওটাকে ধরে বয়ামে পুরতে পারে। স্বচ্ছ কাঁচের বয়ামে প্রজাপতিটাকে দেখতে সত্যিই খুব সুন্দর লাগছে। বক্স খাটের তাকের উপর বয়ামটা রেখে দেয় ওরা। কিছুক্ষণ প্রজাপতিটা বদ্ধ জায়গায় ছটফট করতে থাকে। এটা দেখে ওদের প্রজাপতির ছন্দময় নাচ মনে হয়, সব মানুষের তাই-ই মনে হয়। সৌম্য বলে, নানু, দেখছো, এই প্রজাপতিটা নাচতেও পারে। ঘণ্টা খানের পরে বয়ামে অক্সিজেন সংকট দেখা দেয়। প্রজাপতিটা শ্বাস নেওয়ার জন্য বয়ামের উপরের দিকে উঠে বয়ামের মুখের সাথে চ্যাপ্টা হয়ে লেগে থাকে। সৌম্য বয়াম ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে থাকে। রম্যকেও দেখায়। হঠাৎ বয়ামটা সৌম্যর হাত থেকে মেঝেতে পড়ে ভেঙে যায়। এ যাত্রা প্রজাপতিটা বেঁচে যায়। ওদের সবার উল্লাসপর্বও শেষ হয়। এক সময় সবাই প্রজাপতিটার কথা ভুলে যায়। 

আহত প্রজাপতিটা সারাদিন আলনার কাছেই গুটিসুটি মেরে লুকিয়ে থাকে। রাত হলে বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করে। দরজার সামনে গিয়ে জুতোর উপর বসে থাকে। রম্যর পিতা জাকির সাহেব একটু দেরি করেই বাসায় ফেরেন। আজকে একটু আগে ফিরেছেন। সুবর্ণা বারান্দার লাইটটা জ্বালিয়ে দেয়। লাইটের আলোয় প্রজাপতিটা আরো বর্ণীল হয়ে ওঠে। জাকির সাহেব, সুবর্ণাকে বলে, দেখেছো, প্রজাপতিটা একদম তোমার মতো সুন্দর! অফিশিয়ার মানুষ, দ্রুতই সিরিয়াস হয়ে ঘরে ঢুরে পড়ে জাকির। প্রজাপতিটা একটু একটু করে মেঝে ধরে এগোবার চেষ্টা করে। অনেকক্ষণ চেষ্টা করে আবার ফিরে আসে। এবার ঘরে ঢোকার চেষ্টা করে। দরজার নিচে এসে আটকে থাকে। দরজার নিচেটায় ফাঁক নেই বললেই চলে। মাঝে মাঝে জাকির সাহেব শেষ রাতে উঠে বারান্দায় গিয়ে একটা সিগারেট ধরায়। আজকেও তার ঘুমের সমস্যা হচ্ছে, বারে বারে ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছে। অবশেষে বিরক্ত হয়ে দরজাটা ঠেলে বারান্দায় যায়। দরজার নিচে প্রজাপতিটা আশ্রয় নিয়েছিল। দরজার সাথে ও একেবারে পিষে যায়। 

সকালে সুবর্ণা খুব ব্যস্ত থাকে। ছেলেদের স্কুলে পাঠাতে হয়। জাকির সাহেবও অফিশে যায়। সকালে মোটে দম ফেলার সুযোগ নেই। তাই মরা প্রজাপতিটা কারো চোখে পড়ে না। দুপুরে সুবর্ণার কয়েকবার চোখে পড়েছে, কিন্তু খুব স্বাভাবিক একটা বিষয় হিসেবে এড়িয়ে গিয়েছে। রম্য স্কুল থেকে ফিরে প্রজাপতিটাকে খুঁজতে থাকে। অন্য সবাই ভুলে গিয়েছে। রম্যর বোধহয় এখনও ভোলার মতো বয়স হয়নি। ও প্রজাপতিটাকে সব জায়গায় খুঁজতে থাকে। অবশেষে মৃত প্রজাপতিটাকে খুঁজে পায়। ও বসে হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে। বুঝতে পারে যে, প্রজাপতিটা মরে গেছে। ওর খুব কান্না পায়। কান্না লুকিয়ে মাকে গিয়ে বলে, মা, প্রজাপতিটা মরে গেছে। মা বলে, যাও, জামা প্যান্ট পাল্টে নাও। এবার নানুকে গিয়ে বলে, নানু, প্রজাপতিটা মরে গেছে, নানু বলে, সোনা তোমার খুব ক্ষুধা লেগেছে না? যাও, হাত মুখ ধুয়ে আসো, খাবে। সৌম্যকে গিয়ে বলে, ভাই, প্রজাপতিটা মরে গেছে। সৌম্য বলে, দেখবি, কালকে আব্বা আমার জন্য কেমন একটা ক্রিকেট ব্যাট এনেছে। রম্য চুপ করে চলে যায়। জামা কাপড় পাল্টে হাত মুখ ধুতে বাথরুমে চলে যায়। বাথরুমে ওর খুব কান্না পায়। চোখের পানি ট্যাপের পানিতে মিশে যায়। ও এখনও খুব ছোট, তাই ও বুঝতে পেরেছে যে, প্রজাপতিটা মরে গেছে। আরেকটু বড় হলে রম্যও হয়ত অন্ধ হয়ে যাবে। রম্য এখনও জানে না— মানুষ হতে হলে প্রজাপতিদের মৃত্যু বুঝতে হয় না! খেলা শেষে, বেলা শেষে ভুলে যেতে হয়।