ষাট বছর আগে ঢাকা কেমন ছিল, তার একটি দৃশ্যপট বইটি পড়ে আমার মনে গেঁথে গিয়েছে। লেখকের ছোট বেলার কথা তো আছেই, তবে তার চেয়ে বেশি আছে তখনকার ঢাকার কথা, ঢাকার মানুষের কথা। সাধু গ্রেগরি বা সেইন্ট গ্রেগরি স্কুলের কথা।
মোট নয়টি ভাগে বইটি শেষ হয়েছে- ১। প্রকৃতির পাঠশালায়; ২। সাধু গ্রেগরির দিনের শুরু; ৩। একা থেকে অনেকের ভিড়ে; ৪। স্কুলের নতুন বন্ধুরা; ৫। দুষ্টুমির রকমফের; ৬। শিক্ষকদের প্রিয় মুখ; ৭। আনন্দ আর উৎসবের সমারোহ; ৮। একজন লেখকের জন্ম; ৯। অবাধ্যতার বয়স।
১. প্রকৃতির পাঠশালায়ঃ ঢাকার তেজগাঁও অঞ্চলে যে আস্ত একটি বাগানবাড়ি ছিল মাত্র পঞ্চাশ-ষাট বছর আগেও, সেখানে পুকুর ছিল, জঙ্গল ছিল,শিয়াল-বনবিড়াল ছিল তা বইটি না পড়লে আমি ধারণা করতে পারতাম না। সেরাটন বা আজকের রূপশী বাংলা হোটেলে ওখানে বিশাল খাল ছিল, বর্ষাকালে সেখান থেকে মাছ ধরে আনা যেত, দৃশ্যটা একটু ভাবলে সত্য মনে করা কঠিন হয়ে যায় না। কিন্তু সত্য তো, এভাবেই তো বদলাচ্ছে সময়। ঢাকার পাশের কোন গ্রামের মত তখন তেঁজগা, ইলেকট্রিকের লাইনও ছিল না। জীবনের প্রথম কয়েক বছর পিতা-মাতার সাথে সেখানে কাটিয়ে লেখক পিতা-মাতার সাথে শহরে, অর্থাৎ আজকের পুরনো ঢাকার রূপচাঁন লেনের বাড়িতে চলে আসেন।
২. সাধু গ্রেগরির দিনের শুরুঃ মাত্র সাড়ে চার বছর বয়সে লেখকের মা মারা যান, তাঁর ছোট ভাইয়ের কয়স তখন মাত্র দেড় বছর। বড় এক ভাই রয়েছে। বড় ভাই স্কুলে চলে যায়, ছোট ভাইকে নিয়ে বাবা অফিসে চলে যায়; বাড়িতে সাড়ে চার বছরের শিশুর কাজের লোকের সাথে একা দিনযাপন, নিশ্চয়ই একাকিত্ব তাকে নানান ধরনের চিন্তার জগতে বিচরণ করিয়েছে।
’৫৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লেখক সেইন্ট গ্রেগরি স্কেুলে ভর্তি হয়েছিলেন। আমার জন্মের ঊনত্রিশ বছর পূর্বে। বাংলাদেশের জন্মের ১৬ বছর পূর্বে। তার মানে বাংলাদেশের জন্মকথা তিনি জানেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, বাংলাদেশের জন্ম-ইতিহাস জানেন এবং মনে-প্রাণে মানেন এরকম একজন লেখকের শিশুকাল কেমন ছিল তা জানার মধ্যে শিক্ষণীয় আছে অনেক কিছু।
৩. একা থেকে অনেকের ভিড়েঃ ছোটবেলা থেকেই লেখক ছবি দেখতেন, বই পড়তেন। স্কুলের প্রথম দিনগুলোতে তিনি ছিলেন শান্ত প্রকৃতির। একটি ভালো পারিবারিক পরিমণ্ডলও ছিল তাঁর। শহীদুল্লা কায়সার, জহির রায়হান এবং লেখক যে একই পরিবারের তা এ বইটি পড়তে গিয়ে জেনেছি।
৪. স্কুলের নতুন বন্ধুরাঃ নির্মল বুড়িগঙ্গার বর্ণনা এখানে পাওয়া যাবে। পাল তোলা নৌকা চলত, দু’একটি বড় স্টিমার চলত, ইস! এরকম বুড়িগঙ্গার বর্ণনা পড়তেও তো বেশ। এ সময় লেখকের সাথে স্কুলের অনেকের বন্ধুত্ব হয়েছে, তাদের অনেকেই দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছে।
লেখক একবার ছোটবেলায় বিনা পাসপোর্টে কোলকাতায় গিয়ে ফেররা পথে ধরা পড়েছেন, আবার জেলও খেটেছেন। বিনা পাসপোর্টে গেলে কি হবে সিনেমা ঠিকই তিনি দেখে ফিরেছিলেন।
৫. দুষ্টুমির রকমফেরঃ শান্ত প্রকৃতির হলেও। ছোটবেলায় একেবারে যে দুষ্টুমি করেন নি তা নয়। তবে বন্ধুদের দুষ্ঠুমির কথাই বইয়ের এ অংশে উঠে এসেছে বেশি।
৬. শিক্ষকদের প্রিয় মুখঃ লেখক স্কুলে অনেক ভালো শিক্ষক পেয়েছেন। তখনকার দিনের শিক্ষকদের একটি অবয়ব এ বইটি থেকে পাওয়া যায়। স্কুলের একজন শিক্ষকের বিদায় অনুষ্ঠানে লিখিত ভাষণ উপস্থান করে সবাইকে মুগ্ধ করেছিলেন লেখক।
৭. আনন্দ আর উৎসবের সমারোহঃ তখন স্কুলে অনেক রকম উৎসব হত। বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা তো ছিলই, পাশাপাশি আনন্দমেলা, বিজ্ঞানমেলা, বনভোজন হত; একটার পর একটা অনুষ্ঠান লেগেই থাকত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুরস্কার হিসেবে বই দেওয়া হত।
৮. একজন লেখকের জন্মঃ ‘শাহীন’ ‘সেতার’ এবং শুকতারা নামে ছোটদের পত্রিকা লেখকের পিতা কিনতেন। সেসব পড়েই ম্যাগাজিন পড়ায় হাতেখড়ি। পাশাপাশি বই পড়া, সিনেমা দেখা ছিল লেখকের ছোটবেলার শখ। ওখান থেকেই পেয়েছেন হয়ত লেখালেখির অনুপ্রেরণা, পাশাপাছি গ্রেগরি স্কুলে স্কুল ম্যাগাজিন ছিল বলেই হয়ত নিজেকে যাচাই করে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন সেই শিশু বয়সেই।
৯. অবাধ্যতার বয়সঃ এখানে সেই শান্ত শাহরিয়ার কবিরের মধ্য থেকে একজন প্রতিবাদী মানুষ বেরিয়ে আসে। একজন ইংরেজ শিক্ষক বাংলা ভাষাকে গালি দেওয়ায় তিনি প্রতিবাদ করেছিলেন, শেষপর্যন্ত ব্যক্তিগত প্রতিবাদ সামষ্টিক রূপ নিয়েছিল এবং ঐ শিক্ষক ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়েছিলেন।