“আমার জীবনের সবচেয়ে ইনসিগনিফিকেন্ট ঘটনা হল আমার বিয়ে। সবচেয়ে ক্ষণস্থায়ী, সবচেয়ে ফালতু, ফেক, বাজে, বেহুদা, বোকামো, বুদ্ধুমি, বালের ঘটনা হল আমার বিয়ে। সবচেয়ে অদরকারি, সবচেয়ে শিটি, ফাকিং ঘটনা এই বিয়ে।“ — বলেছেন তসলিমা নাসরিন।
বিবাহ, অর্থাৎ বিয়ে সম্পর্কে শ্রীমতী তসলিমার এহেন মন্তব্য পাঠ করে চমকে গেলেন নাকি ! তসলিমার বক্তব্য যদি মেনে নিতে হয়, তাহলে প্রশ্ন হল হাজার হাজার ধরে বিবাহ নামক ব্যবস্থা টিঁকে আছে কী করে ? সারা পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষই বিবাহ-ব্যবস্থায় আস্থা রাখে। কারণ বিবাহ ছাড়া মানুষের অন্য কোনো পথ খোলা নেই। মানুষ ছাড়াও পৃথিবীর বুকে আরও কোটি কোটি প্রজাতির প্রাণী আছে। এই কোটি কোটি প্রজাতির প্রাণীরা কেউই বিয়ে করে না। কেবলমাত্র মানুষই বিয়ে করে। কেন ? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের এক্কেবারে শিকড়ে চলে যেতে হবে।
বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে যেই জেনেটিক বিবর্তন ঘটে সেটার সফল পরিসমাপ্তি হল একটা ভিন্ন প্রজাতির সৃষ্টি। এই ধারাবাহিক বিবর্তনের ধাপে ধাপে এইসব প্রজাতির ভেতরে আন্তঃনিষেক ঘটে, যখন যৌনজনন পদ্ধতিতে একটা অন্যটার সঙ্গে বংশবিস্তার করতে পারে না, তখনই সেটাকে আমরা পৃথক প্রজাতি বলি।
আজ থেকে প্রায় ৩৫ কোটি বছর পূর্বে পৃথিবীতে প্রথম জীবনের সঞ্চার হয়েছিল। দিনে দিনে সেই প্রাণ উন্নত হয়ে আসে এককোশী অ্যামিবা। তারপর বিবর্তিত হতে হতে প্রথমে মধ্যবর্তী জীব এবং ধীরে ধীরে উভচর, সরীসৃপ, স্তন্যপায়ী ও সবশেষে মানুষের আবির্ভাব ঘটে আমাদের এই প্রিয় পৃথিবীতে। নিজের অস্তিত্ব রক্ষার্থে ও বিবর্তনের এ ধারা অব্যাহত রাখার জন্য সকল জীব প্রজননকে বেছে নেয়। এ ক্ষেত্রে যৌন এবং অযৌন দুই উপায়ে তাদের বংশবিস্তার করতে থাকে। বর্তমান ইউক্যারিয়টদের প্রায় ৯৯.৯% জীব যৌন প্রজননকেই বেছে নিয়েছে। কেউ কেউ বলেন জীব যৌন প্রজনন হয়তো বেছে নিয়েছে, কারণ এটি আনন্দদায়ক। কিন্তু বিবর্তনবাদের দিক থেকে বিশ্লেষণ করলে এটি সম্ভব নয়। প্রথম ইউক্যারিয়ট যারা যৌন প্রজননে অংশ নেয় তাদের আবির্ভাব ঘটে প্রায় ২০ কোটি বছর পূর্বে, যেখানে প্রথম প্রাণী যারা আনন্দ বা কষ্ট এরকম অনুভূতি বুঝতে পারে তারা এই পৃথিবীতে জন্ম নেয় প্রায় ১৩ কোটি বছর আগে। তাই আনন্দ নিশ্চয় তাদের মূল লক্ষ্য ছিল না। গবেষণা থেকে যা তথ্য পাওয়া যায় তাতে নিশ্চিত হওয়া যায় যে বাহকের যৌন প্রবৃত্তি বৃদ্ধি ও বজায় রাখার ক্ষেত্রে এই স্বার্থপর জিন প্রভাব রাখে। অন্যদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য যত উৎসাহী হব আমরা, ততই এই জিনের সুবিধে। তাই যৌন মিলনে আনন্দের প্রক্রিয়া সম্ভবত এসব জিনের প্রভাবেই এসেছে।
যৌনমিলনের ফল হল সন্তানের জন্ম, অনিবার্য। এবং তার উত্তরাধিকার থেকে পরিবার বংশ, গোত্র, সমাজ, জাতি এবং সম্ভবত রাষ্ট্রেরও উৎপত্তি হয়েছে। আমাদের পুর্বপুরুষেরা যখন পরিবার প্রথা চালু করেছিল। তার আগে নর-নারীর যৌন সম্পর্ক ছিল নির্বিচার। প্রথমে আপন ভাই-বোনেদের মধ্যে বিয়ে নিষিদ্ধ হয়, পরে অন্যান্য রক্তের সম্পর্কের মধ্যেও বিয়ে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। অন্তর্প্রজনন তখনই শেষ হয়ে যায়, গোত্র প্রথার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে। একসময় দেখা গেল সন্তান উৎপাদনে পুরুষেরও ভূমিকা আছে। আর তখনই সম্পত্তির উত্তরাধিকারের প্রশ্নে, সন্তানের পরিচয় নিশ্চিন্ত করতে, নারীদের আরও বিশেষভাবে বন্দিনী করার প্রয়োজনের তাগিদে, নিখুঁত এক-বিবাহের প্রয়োজন দেখা দিল। কিন্তু সেটা একমাত্র নারীর ক্ষেত্রে, পুরুষের ক্ষেত্রে নয়। কারণ সন্তানের চিহ্নিতকরণ তখনই সম্ভব, যখন নারী একজন মাত্র পুরুষের সাথে যৌন সম্পর্ক রাখবে। স্বাধীন অরণ্যচারিণী নারীকে খাদ্য ও নিরাপত্তা দিয়ে বশ করেছিল আদিম পুরুষ। বিনিময়ে পেয়েছিল আপন পিতৃত্বের নিশ্চয়তা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই শৃঙ্খল আরও দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয় এবং ধর্মের নিয়ম-নিগড়ের সহায়তায় নারীকে প্রায় পণ্যে পরিণত করে পুরুষ, নানা অছিলায়।
Proceedings of the Royal Society B জার্নালে সম্প্রতি প্রকাশ হয় নিউজিল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অফ অকল্যান্ড এর বিজ্ঞানীদের একটি গবেষণা এবং এখানেই তারা মত প্রকাশ করেন যে ‘স্বার্থপর জিন’গুলি প্রাণীদেরকে মিলনে উৎসাহিত করে, যাতে এরা অন্য জিনকে প্রভাবিত করতে পারে। মোদ্দা কথা, পিতামাতা উভয়ের শরীর থেকে জিন সন্তানের শরীরে আসার সময় দুই ভাগ হয়ে যায় এবং এই দুই অর্ধাংশ একত্র হয়ে সন্তানের জেনেটিক গঠন তৈরি করে। এই ভাগ হওয়ার সময় কিছু জিন বাদ পড়ে যায়। কিন্তু “স্বার্থপর” জিনগুলি এভাবে ভাগ হয় না। পিতা-মাতার শরীরে এই জিন থাকা মানে সন্তানের শরীরে এটা থাকবেই থাকবে। আর তাছাড়া এই জিনগুলি মানুষের শরীরে কোনও উপকারও করে না। এ কারণেই এদেরকে বলা হয় স্বার্থপর। নিউজিল্যান্ডের এই গবেষকরা ধারণা করেন যে, স্বার্থপর জিনগুলি শুধুমাত্র যৌন প্রজননের মাধ্যমেই ছড়াতে পারে। মানুষের শরীরে এই জিন থাকে তবে যত বেশি মানুষের সঙ্গে তিনি মিলিত হবেন তত বেশি পরিমাণে এই জিন ছড়ানোর সুযোগ পাবে। আর মানুষ যদি মিলনে আনন্দ পায় তবে তিনি অবশ্যই বেশি পরিমাণে এবং বেশি মানুষের সঙ্গে মিলিত হতে চাইবেন। এ থেকেই ধারণা করা যায়, মানুষের যৌন প্রজননে যে আনন্দ লাভের প্রক্রিয়া তার পিছনে এই স্বার্থপর জিনের হাত আছে।
প্রাণীর বিবর্তনের ধারা : প্রায় ১৩৭৫ কোটি বছর আগে বিগব্যাং-এর সূত্রে বর্তমান বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয়েছিল। পরবর্তী ১০০০ কোটি বছরের মধ্যে গ্যালাক্সিগুলোর বিন্যাস হয়েছিল বটে, কিন্তু সুবিন্যস্ত ছিল না। ১৩৬০ বছরের দিকে আমাদের ছায়াপথ তৈরি হয়েছিল। ৪৬০ কোটি বছরের দিকে আমাদের সৌরজগত দিকে তৈরি হয়েছিল, তখন মহাকাশেও তেমনি প্রক্রিয়া চলছিল। ৩৮০ কোটি বছর সময়কে অজীবীয় কাল বা Azoic হিসাবে বিবেচনা করে থাকেন। কারণ এই সময় প্রাণের বিকাশ ঘটেনি। ৩৫০ কোটি বছর আগে প্রাণকোশের উপকরণসমূহের এই সমন্বয় হয়েছিল প্রায় । এই আদি জীবকোশেরই একটি প্রজাতি হল আর্কেব্যাক্টেরিয়া বা Archaebacteria নামক জীবকণিকা। ২৫০ থেকে ১৬০ কোটি বছরের ভিতরে সাগরের জলে একটি নতুন ধরনের ব্যাক্টেরিয়ার উদ্ভব হল। বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন সায়ানোব্যাক্টেরিয়া বা Cyanobacteria। এর অন্য নাম নীল-সবুজ শৈবাল (blue-green algae)। এই সময়কে প্রোটেরোজোইক কালের প্রথমাংশ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এই কালের শেষ সমাপ্তি সময় ধরা হয় ৫৪৪০ লক্ষ বছর আগে। ৫৪/৫৩ কোটি বছর থেকে ৫০ কোটি বছর পূর্বকাল পর্যন্ত ক্যাম্ব্রিয়ান অধিযুগ স্থায়ী ছিল। এই সময় পৃথিবীর অধিকাংশ স্থান জলে ঢাকা ছিল। এই অধিযুগে ক্রমান্বয়ে বাতাসে অক্সিজেন বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে অক্সিজেন গ্রহণকারী প্রাণীকুলেরও বিকাশ হতে থাকে। এই সময়ই বহুকোশীয় প্রাণিজগতের (এ্যানিমেলিয়া Animalia) সূচনা ঘটে। তখন সাগরের জলে বিকশিত হয়েছিল অমেরুদণ্ডী প্রাণীকুল। বিশেষ করে স্পঞ্জ, ওয়ার্ম, ব্রায়োজয়ান, হাইড্রোজোয়ান, ব্র্যাকিওপোড, মোলাস্কা জাতীয় প্রাণীকূল। ৫২ কোটি ৫০ লক্ষ বছর আগে মেরুদণ্ডী প্রাণীর উদ্ভব ঘটেছিল। ৪১ কোটি ৮০ লক্ষ বৎসর আগে Sarcopterygians মাছের উদ্ভব ঘটে। ৪১ কোটি থেকে ৩৯ কোটি বছরের ভিতর এই মাছ দুটি ভাগে হয়ে যায়। এই ভাগ দুটি হল — Coelacanths এবং Rhipidistians। ৩৯-৩৭ কোটি বছরের ভিতর Rhipidistians বিভাজিত হয়ে সৃষ্টি হয় — Lungfish এবং Tetrapodomorphs। ৩৯ কোটি ৭০ লক্ষ বছর থেকে ৩৫ কোটি ৯০ লক্ষ বছরের ভিতরে Tetrapods উদ্ভব হয়েছিল। ৩২-৩১ কোটি বছর আগে কার্বোনিফেরাস অধিযুগে সরীসৃপ জাতীয় প্রাণীর উদ্ভব ঘটেছিল। ২৪ কোটি ৫০ লক্ষ বছর আগে ইক্থায়োসর বা Ichthyosaur নামক সামুদ্রিক প্রাণীর বর্গের প্রাণীকুলের আবির্ভাব ঘটেছিল। ২২কোটি ৫০ লক্ষ বছরের দিকে স্তন্যপায়ী প্রাণীর আবির্ভাব ঘটে। এই সময়ে কিছু উড়ন্ত সৃরীসৃপের আবির্ভাবও ঘটে। এই সময় কিছু কিছু স্থল সরীসৃপ পুনরায় জলচর হয়ে উঠে। ১৮ কোটি ৫০ লক্ষ বছর আগে থেরাপ্সিডদের আবির্ভাব ঘটে। ১৬ কোটি বছর আগে জুরাসিক অধিযুগে ট্রেটাপড ডাইনোসর থেকে পাখির উৎপত্তি ঘটে। ক্রেটাসিয়াস অধিযুগের শেষে অর্থাৎ ৭ কোটি বছর আগে স্তন্যপায়ী প্রাণীর বিবর্তনের ধারায় প্রাইমেট বর্গের সূচনা হয়েছিল। পরবর্তী ৬ কোটি ৫০ লক্ষ বছরের দিকে এসে প্রাইমেটদের আদর্শরূপ বিকশিত হয়েছিল। ৬ কোটি ৩০ লক্ষ বৎসর পূর্বে এই বর্গের প্রাণীরা দুটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিকশিত হয়ে উঠলো। বিজ্ঞানীরা এই ভাগ দুটিকে উপবর্গ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। এই উপবর্গ দুটি হল – (১) স্ট্রেপ্সির্হৃনি (Strepsirrhin) এবং (২) হ্যাপ্লোর্হৃনি (Haplorrhini)।
৫ কোটি ৮০ লক্ষ বছর আগে হ্যাপ্লোরহৃনি উপবর্গটির প্রাণীকুল দুটি ভাগে বিভাজিত হয়ে যায় যায়। এই ভাগ দুটি হল — ক্ষুদ্রবর্গ (Infraorder) : সিমিফোর্মস (Simiiformes) এবং : টার্সিয়ের্স (tarsiers)।৪ কোটি বছর আগে, সিমিফোর্মস ক্ষুদ্রবর্গের প্রাণীগুলো ‘নব্য পৃথিবীর বানর’ হিসাবে মূল ধারা থেকে পৃথক হয়ে যায়। অবশিষ্ট থেকে যায় প্রাচীন পৃথিবীর বানর এবং এপ-সমূহ। সিমিফোর্মস ক্ষুদ্রবর্গের এই অবশিষ্ট প্রাণীগুলোকে বিজ্ঞানীরা নাম দেন ক্যাটারহৃনি বা Catarrhini। ৩ কোটি ৫০ লক্ষ বছর থেকে ২ কোটি ৯০ লক্ষ বছরের ভিতরে ক্যাটারহৃনি নামক উপক্ষুদ্রবর্গ (Parvorder) থেকে প্রাচীন পৃথিবীর বানর পৃথক হয়ে যায়। মূল ধারায় থেকে যায় Hominoidea নামক অধিগোত্রের (Superfamily) প্রাণীসমূহ। Hominoidea নামক অধিগোত্র গিবোন (Hylobatidae গোত্রের প্রাণীকূল) পৃথক হয়ে যায় ১ কোটি ৮০ লক্ষ বছর পূর্বে। মানুষের বিবর্তনের মূলধারার রয়ে যায় Hominidae গোত্রের (family) প্রাণীসমূহ। এই গোত্রের প্রাণীগুলির ভিতরে থাকল ওরাং ওটাং, গরিলা, শিম্পাঞ্জি ও মানুষ (Homo sapiens)। Hominidae গোত্রের প্রাণীকুলের ভিতরে প্রথম ১ কোটি ৪০ লক্ষ বছর আগে বিভাজিত হয়ে যায় গণের (Pongo) প্রাণীকূল। এই গণের প্রাণীদের সাধারণ নাম ওরাং ওটাং। এরপর দ্বিতীয় গণ গরিলা (Gorilla) পৃথক হয়ে যায় ৭০ লক্ষ বছর আগে। শেষপর্যন্ত রয়ে যায় মানুষের নিকটতম প্রজাতি শিম্পাঞ্জি। উল্লেখ্য শিম্পাঞ্জি প্যান (Pan) গণের প্রাণী। প্যানগণের গণটি পৃথক হয়ে যায় ৬০ লক্ষ বছর আগে। ফলে Hominidae গোত্রের প্রাণিকুলের মূল ধারায় থেকে যায় মনুষ্য জাতি।
হোমোনিডি গোত্র থেকে মানুষ : প্রাইমেট বর্গের অন্তর্গত হোমোনিডি গোত্রের একটি গণ (Genus) অস্ট্রেলোপিথেকাসের বিকাশ ঘটেছিল প্রায় ৪০ লক্ষ বছর আগে পূর্ব আফ্রিকায়। এই গণের একটি প্রজাতি অস্ট্রেলোপিথেকাস ঘারি এই প্রজাতিটি ৩০ থেকে ২৫ লক্ষ বছর আগে এই প্রজাতিগুলো আফ্রিকা মহাদেশে বসবাস করত। প্রায় ২৪,০০,০০০ থেকে ২৩,০০,০০০ বছর আগে একটি পৃথক গণের প্রজাতির উদ্ভব ঘটে। এই গণকে বিজ্ঞানীরা নামক দিয়েছেন হোমো (Homo)। এই গণের প্রজাতিগুলির আদি প্রজাতিটি হোমো হ্যাবিলিস। এই প্রজাতিটি বুদ্ধিমত্তার বিচারে অস্ট্রেলোপিথেকাস থেকে একটু উন্নত ছিল। ২৩ লক্ষ বছর আগে এরা পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকাতে বিকাশ প্রাপ্ত হয়েছিল। অবশ্য বিজ্ঞানীরা এই প্রজাতিটিকে যথার্থ আধুনিক মানুষের পূর্বপুরুষ মনে করেন না। ২০১০ সাল পর্যন্ত হোমো হ্যাবিলিসকেই আদি মানব হিসাবে বিবেচনা করা হত। ২০১০ সালে হোমো গোটেনজেনসিস নামক একটি প্রজাতির জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকে এই প্রজাতিটিকে আদি মানুষের যথার্থ পূর্ব পুরুষ হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এরও ২০ লক্ষ বছর আগে পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকাতে বসবাস করত। এইসময়ে একই স্থানে অস্ট্রেলোপিথেকাস গণের অস্ট্রেলোপিথেকাস সেডিবা নামক প্রজাতিও বসবাস করত। ১৯ লক্ষ বছর আগে হোমো এরগাস্টার নামক একটি প্রজাতির বিকাশ ঘটেছিল পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকাতে। এর পাশপাশি আরও একটি হোমো রুডোলফেন্সিস নামক প্রজাতির বিকাশ ঘটেছিল। হোমো রুডোলফেন্সিস নামক এই প্রজাতিটি প্রায় ১৯/১৮ লক্ষ বছর আগে আফ্রিকার কেনিয়া অঞ্চলের বসবাস করত। পৃথকভাবে বিকশিত এই দুটি প্রজাতি দুটি মানুষের পূর্বপুরুষ নয়। হোমোগণের আদি প্রজাতি হোমো হ্যাবিলিস বিবর্তনের ধারায় ১৮ লক্ষ বৎসর আগে হোমো জর্জিকাস নামক প্রজাতিতে পরিণত হয়েছিল। এই প্রজাতিটি আফ্রিকা ছেড়ে ইউরোপে প্রবেশ করেছিল। ১৮ লক্ষ ৫০ বছর আগে আরও একটি প্রজাতির সন্ধান পাওয়া যায়, এর নাম হোমো অ্যারেক্টাস। এই প্রজাতিটিই আফ্রিকা ছেড়ে ব্যাপকভাবে এশিয়া এবং ইউরোপের দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। এরা আফ্রিকা থেকে প্রথমে ইউরেশিয়ায় প্রবেশ করে। এর আর একটি শাখা ইউরোপের ককেশাশ অঞ্চলে থেকে যায়। অবশিষ্ট অংশ চিন, ভারত, জাভা অঞ্চলে বসবাস শুরু করেছিল। এছাড়া মস্তিষ্ক ও দেহের কাঠামোগত পরিবর্তনের দিক দিয়ে এরা আধুনিক মানুষের মতো হয়ে উঠেছিল। এই প্রজাতিটিই স্থানের বিচারে বলা হয় জাভা মানব, পিকিং মানব। প্রায় ১২ লক্ষ বছর থেকে ৮ লক্ষ বছর আগে এরা ইউরোপে বসবাস করত। ইউরোপে যে কয়েকটি মনুষ্য প্রজাতি বসবাস করত হোমো অ্যান্টেসেসর ছিল তার মধ্যে একটি।
মনে করা হয়, এরা ছিল হোমো এরগাস্টার এবং হোমো হাইডেলবার্গেনসিসের মধ্যবর্তী একটি প্রজাতি। কিন্তু Richard Klein সহ আরও অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন হোমো এরগাস্টার থেকে বিবর্তিত হয়ে এই প্রজাতিটির উদ্ভব হয়েছিল। বৈশিষ্ট্যে বিচারে এরা হোমো হাইডেলবার্গেনসিসের কাছাকাছি ছিল। অপরদিকে অনেকে মনে করেন হোমো অ্যান্টেসেসর আর হোমো হাইডেলবার্গেনসিস একই প্রজাতি। ৬ লক্ষ বছর আগে আমরা পাই হোমো হাইডেলবার্গেনসিস নামক প্রজাতিটিকে। মনে করা হয়, প্রায় ২ লক্ষ বছর আগে হোমো স্যাপিয়েন্সের আবির্ভাব ঘটে। ১ লক্ষ ৬০ হাজার বছর আগে মূল প্রজাতি থেকে একটি উপ-প্রজাতি পৃথকভাবে বিকশিত হয়। এই প্রজাতিটি হল Homo sapiens idaltu।
১৮৬৫ সালে জার্মানির নেয়ানডার্থাল নামক স্থানে মাটি খনন করে পাওয়া গিয়েছিল একটি মাথার খুলি । বিজ্ঞানীদের মতে এই খুলিটি ছিল মানুষের পূর্বপুরুষের । মাটির যে স্তর থেকে এতি আবিষ্কৃত হয়, এর প্রাচীনত্বের হিসাব অনুযায়ী খুলিটির বয়স ছিল ৭৫ হাজার বছর । এটি ছিল নেয়ানডার্থাল মানুষ । ১৯০৮ সালে ফ্রান্সের শাপেন ওস্যা নামক গ্রামের কাছে একটি গুহা থেকে পাওয়া গিয়েছিল একটি আস্ত কঙ্কাল। এটি ছিল একটি মানুষের কঙ্কাল এবং তা নেয়ানডার্থাল মানুষের সমবয়সি এবং সমগোত্রীয় । ১৮৬৮ সালে ফ্রান্সের দোর্দোঞন অঞ্চল থেকে মানুষের ৫টি পূর্ণাবয়ব কঙ্কাল আবিষ্কৃত হয় । এগুলির উচ্চতা ছিল ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি থেকে ৬ ফুট ১ ইঞ্চির মধ্যে । এদের মাথা ছিল লম্বা, মুখ থ্যাবড়া, পেশিবহুল প্রত্যঙ্গ ও চোয়াল ছিল উঁচু । চেহারার দিক দিয়ে পুরাপুরি আধুনিক মানুষ । কঙ্কালগুলোর বয়স ছিল মাত্র ৩০ হাজার বছর । এগুলোকে বলা হয় ক্রোমাঙ্গ মানুষ । বিজ্ঞানীরা বলেন, পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব হয়েছে ১৫০ কোটি বছর পূর্বে । কিন্তু মানুষের আধুনিক রূপ গঠিত হয়েছে মাত্র ৩০ হাজার বছর আগে ।
৩০ হাজার বছর আগে সেই মানুষ ছিল উলঙ্গ, বন্য, পশুর মতো হিংস্র। কাজ : খাদ্য সংগ্রহ, খাদ্য গ্রহণ, যৌনমিলন, আত্মরক্ষার লড়াই, আক্রমণের প্যাঁচ-পয়জার এবং মৃত্যু। তখন মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক তৈরি হয়নি। যৌনক্রিয়া চলত অবাধে, যখন যার সঙ্গে খুশি। পেটের ক্ষুধার পরই জীবজগতে মানুষের যৌনাকাঙ্খার প্রবল চাহিদা। আর পাঁচটা বন্যপশুদের মতোই ছিল মানুষের অরণ্য-জীবন। বন্যপশুদের মতোই ছিল মানুষের যৌনজীবন।পুরুষরা ইচ্ছা করলেই যে-কোনো নারীর সঙ্গে যৌনক্রিয়া করতে পারত না।নারীরাই নির্বাচন করে নিত যৌনসঙ্গী। নারীকে কেন্দ্র করে বাধত লড়াই, রক্তপাত। জয়ী পুরুষই ঈপ্সিত নারীকে লাভ করত।নারীকে কেন্দ্র করেই সৃষ্টি হয়েছিল দুই পুরুষের শত্রুতা। শত্রুতাকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হল গোষ্ঠী। গোষ্ঠী থেকে রাষ্ট্র।
যৌন-আবেগ ও আকর্ষণ প্রায় অদম্য। যার ওরপ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা মানুষের জন্য প্রায় অসম্ভব। প্রাণীজগতে মানুষই বোধ হয় একমাত্র জীব, যার যৌনক্ষুধা সীমিত নয়। অধিকাংশ প্রাণীর ক্ষেত্রেই সন্তান উৎপাদনের জন্য যৌনমিলনের আকাঙ্ক্ষা জাগে এবং স্ত্রী-পুরুষ একত্রে যৌনমিলনের মধ্য দিয়ে সন্তান উৎপাদনের প্রবৃত্ত হয়। অপরদিকে মানুষের ক্ষেত্রেই এরূপ কোনো নির্দিষ্ট ঋতু নেই। মানুষের মধ্যে যৌনমিলনের বাসনা সকল ঋতুতেই জাগ্রত থাকে। তাই যৌন আবেগ বা চাহিদাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে বা সভ্য করতে নর-নারীর মিলন একদিন রূপ নেয় বিয়েতে। জগৎ সৃষ্টির বিবর্তনে আজকের বিয়ে বা পরিবার এভাবেই হয়তো এ সভ্যতা তৈরিতে সহায়ক হয়েছে। এছাড়া আদিম মানুষের খাবার সংগ্রহ ছিল অতি দুরূহ ব্যাপার। মনে রাখবে হবে, মানুষ তখন পর্যন্ত কোনোরূপ উৎপাদন করতে শেখেনি। কৃষিকাজ জানত না। পশুমাংসই ছিল তাদের প্রধান আহার। ফলমূলও খেতে শিখেছিল। যাই হোক, এই পশুশিকারের জন্য আদিম মানুষকে মাঝেমধ্যেই নিজের আশ্রয় ছেড়ে অনেক দূরে যেতে হত। এভাবে পুরুষেরা যখন দূরে থাকত, তখন নারী সম্পূর্ণ অসহায় ও রক্ষকহীন অবস্থায় থাকত। অপর কোনো পুরুষ বলপূর্বক তুলে নিয়ে গেলে যুদ্ধ ও রক্তপাতের সৃষ্টি হত। তাই প্রয়োজন হয়ে পড়ল মালিকানা। নারীর স্থায়ী দখলদার। অতএব এহেন রক্তপাত এড়াতেই মনুষ্যসমাজে বিবাহ দ্বারা স্ত্রী-পুরুষের সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়ছিল। জঙ্গল-জীবনে বিশেষত পুরুষকে নারীর সঙ্গে যৌনমিলনের জন্য কোনো বিনিময়-মূল্য দিতে হত না। শুধুমাত্র যৌন-চাহিদা মেটাতেই পুরুষকে বিয়ে নামক চুক্তিতে আবদ্ধ হতে হল। প্রকারান্তরে নারী-পুরুষ উভয়ই বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হল।
যৌনমিলনেই কাজ শেষ হয়ে যায় না পুরুষ মানুষের। পুরুষ মানুষকে একটি নারীর সারা জীবনের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হল। শুধু নারীর দায়িত্বই নয়, দায়িত্ব নিতে হয় অসংখ্য সন্তানেরও। মহাভারতের শ্বেতকেতু উপাখ্যান থেকে পাওয়া যায়, শ্বেতকেতুই ভারতবর্ষে প্রথম বিবাহপ্রথার প্রবর্তন করেন। অবশ্য বিবৃত কাহিনি থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায়, তার আগেই শ্বেতকেতু পিতা-মাতার সঙ্গে পরিবারে বাস করতেন।
যৌনমিলনকে প্রাতিষ্ঠানিক বা সভ্যরূপে রূপ দান করতে সমাজকে অনেক ক্ষতিও স্বীকার করতে হয়েছে। এমনকি মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে হাজার হাজার মানুষকে। যার জন্য সৃষ্টি হয়েছিল বৈরাগ্যবাদ। বৈরাগ্যবাদীরা মনে করতেন যৌন-আবেগকে অবদমিত করতে পারলেই শান্তি পাওয়া যাবে, আসবে মানবতার মুক্তি দূর হবে সমস্ত অশান্তি। সেজন্য মিসর, গ্রিস, ভারতবর্ষ, চিন, ইউরোপ এবং আরও বহু জায়গায় বৈরাগ্যবাদ সথেষ্ট প্রসারও লাভ করেছিল। এ ব্যাপারে বেশি জল ঢেলেছে খ্রিস্টবাদ। কারণ জিশু নিজেই বিয়ে করেননি, তিনি কখনোই মিলিত হননি কোনো নারীর সঙ্গে। তাই খ্রিস্ট পাদরিরা নারী থেকে এমনভাবে দুরে থাকতে আরম্ভ করে যে, তাঁরা মনে করতে নারী বা যৌনতা মানেই কোনো নোংরা ক্লেদময় অবস্থা।
যৌন-আবেদনের আর-একটি জটিল ব্যাপার হল, মানুষ যখন যৌনতাকে অবদমন করে তখন মেজাজ ও স্বভাব-প্রকৃতি ওই চেষ্টা সাধনাকে গ্রহণ করতে পারে না। কারণ মানুষের স্বভাব-প্রকৃতি এমন যে, তার মধ্যে যৌন-আবেগ ও চাহিদা প্রচণ্ডভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত তার যৌন-চাহিদা পূরণ না-হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত যে স্বাভাবিক হতে পারে না। ১৯৫৭ সালের মার্চে ব্রিটেনের একদল মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ এগারো হাজার মানসিক রোগীর কেস হিস্ট্রি পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত দেন যে, “মনের শান্তি ও নানাবিধ মানসিক রোগ থেকে রক্ষা পেতে বিয়ের চেয়ে ভালো কিছু আর হতে পারে না।”
প্রাচীন কাল থেকে বৈরাগ্যবাদের পাশাপাশি অবাধ যৌনাচারের ধারণটিও বাস্তবায়িত হয়ে আসছে। অবাধ যৌনাচারের যুক্তি হল, যেহেতু যৌনাকাঙ্খা প্রাকৃতিক তাই তাতে বাধ সাধার কোনো অবকাশ নেই। অন্যান্য প্রকৃতিগত আকাঙ্খার মতো তারও (যৌনাকাঙ্খা) পরিতৃপ্তির ব্যবস্থা থাকা দরকার। এ ব্যাপারে সঠিক ও বেঠিক এবং বৈধ অবৈধতার বাধ্যবাধকতা আরোপ নিরর্থক। (চলবে)