বড় গল্প: কোথাও নেই (তৃতীয় পর্ব)

কোথাও নেই

কোথায় যাওয়া যায় ভাবছি, আবার না ভাবলেও কোনো সমস্যা নেই, নির্দিষ্ট কোথাও যেতে হবে এমন তো নয়। দু’চোখ যেদিকে যায় যাব। শুধু মরতে চাই না বেঘোরে।

জায়গাটা ভালোই লাগছে, দুপুর গড়িয়ে বিকাল নেমেছে, শেষ রোদটুকু নদীর পানিতে প্রতিফলিত হয়ে আরও তীব্র হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে।

একটা ছোট বাচ্চা অনেকক্ষণ ধরে আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছে। সম্ভবত এরকম কাউকে এভাবে এখানে কখনো বসে থাকতে দেখেনি ও। আশেপাশেই হয়ত ওদের বাড়ি। পদ্মার চরে নতুন নতুন অনেক টিনের ঘর দেখা যায়— অস্থায়ী চরে স্থায়ী বসতি গড়ে উঠেছে! দেশের বাড়তি জনসংখ্যার বেপরোয়া জীবনযাপনের বিষয়টি খুবই স্পষ্ট এখানে।

শিশুটিকে কাছে ডাকলাম, যদিও বিষয়টিতে আমি অভ্যস্ত নই। ব্যাবসায়ীরা এক ধরনের কৃত্রিম জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে যায়, হতে হয়, এভাবে ভেতরের মানবিক বৈশিষ্টগুলি আড়াল হতে থাকে। গত কয়েক দিনে বুঝতে পারছি, সবই ভেতরে জমা আছে, শুধু উপযুক্ত পরিবেশ দরকার, নিজের দিকে একটু তাকানো দরকার।

আসলে আমার বাবার জীবনটা ছিল একেবারেই আমার উল্টো, সারাজীবন সবার উপকার করে সময় কাটিয়েছেন, আয় উপার্জনের টেনশন নেননি, বংশসূত্রে যা পেয়েছেন, তা দিয়েই চলেছেন। এক ধরনের দার্শনিকসুলভ জীবনযাপন করতেন উনি। মানুষের সাথে মিশতেন, সবার সাথে থাকতেন, আবার অস্পষ্ট একটা দূরত্বও বজায় রাখতেন। খুব কাছের মানুষ না হলে সেটি ধরার সাধ্য ছিল না কারো।

আমি একসময় খুব ছন্নছাড়া ছিলাম, কীভাবে কীভাবে যেন জড়িয়ে গেলাম ব্যবসাবাণিজ্যের সাথে। এরপর থেকে ব্যবসা, টাকা-টাকা-টাকা হয়ে উঠল আমার জীবন। আয় করো, ব্যয় করো। আয় করো বেশি, ব্যয় করোও বেশি! কী ভয়ঙ্কর এক জীবন!

হিংস্র উপভোগ আছে এই আয় ব্যয়ের মধ্যে, সহজে ধরা পড়ে না ফাঁকিটুকু, তবে সুক্ষ্ম জীবন-তৃষ্ণার অভাব ঘটে যায় নিজের অজান্তেই। আয়-ব্যয় এবং অহংকারের ব্যস্ততা সবকিছু আড়াল করে রাখে। হঠাৎ যখন স্থুল জীবনটা উঁকি দেয় কোনো এক ঝড়ো হাওয়ায় আলগা হওয়া ফাঁক দিয়ে, তখন সবকিছু খুব শূন্য মনে হয়। এ হতাশা সহজে সবাই বুঝবে না।

ছেলেটা দেখছি সহজে কোনো কথা বলে না। দশ কথা জিজ্ঞেন করলে এক কথার উত্তর দেয়। কী মুশকিল! খুব ইচ্ছে করছে ওর হাতে পাঁচশো টাকা গুজে দিই, কিন্তু এভাবে একটা শিশুর হাতে টাকা দেওয়া যায় না। বাসায় গেলে রহস্য তৈরি হবে— হয়ত ভেবেই বসবে অনেকে যে, এ ছেলে অবতার। ওকে নিয়ে একটু দূরে ফেরিঘাটে গিয়ে দোকান থেকে কিছু কিনে দেওয়া যায়, কিন্তু তাতেও সমস্যা আছে, ছেলে ধরা বলে আমাকে ধাওয়া করা হতে পারে!

সমাজে লাগামহীন অনাচার রয়েছে, অনাকাঙ্ক্ষিত অনাচার থেকে তৈরি হয়েছে ভয়াবহ অবিশ্বাস, অবিশ্বাস শুধু খারাপ জিনিসগুলোকে ঠেকিয়ে রাখে না, অনেক শুভ চিন্তাও আটকে দেয়। রবীন্দ্রনাথ তো বলেছেন—

“দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি।
সত্য বলে, আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি?”

অবশেষে চুপচাপ বসে আছি, ছেলেটাও একটু দূরে বসে দুটো পাতা কুটিকুটি করে খেলছে, মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকাচ্ছে। উঠে যেতে পারছি না। একজন ব্যবসায়ীর জন্যে এগুলো দেখার মতো কোনো বিষয় না, কিন্তু একজন পরিব্রাজকের জন্য মানবিক এসকল বিষয়ই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ আসলে বহুসত্তার— কোনোটি জাগ্রত, কোনোটি প্রচ্ছন্ন, কোনোটি আবার মৃত।

অনেক্ষণ পরে শিশুটির মা এসেছে। ওরা এভাবেই অভ্যস্ত, নদীর পাড়ে পাঁচ-ছয় বছরের শিশু একাকী ঘণ্টা খানেকের জন্য উধাও! শিশুটির মাকে জিজ্ঞেস করলাম, ও সাঁতার জানে কিনা। শিশুটির মা একগাল গ্রাম্য হাসি দিয়ে বলে, “ও সাঁতার শিখেছে আরো এক বছর আগে।”

কিন্তু এই ভরা পদ্মা কি ছোট্ট শিশুর সাঁতার পরোয়া করে? নিশ্ছয় করে না, তাতে ওদের কিছু যায় আসে না, সাঁতার জানে ভেবে ওরা কিছু স্বান্তনা খোঁজে শুধু। জীবন ও মরণ একসাথে নিয়েই বাঁচে, নইলে তাদের পুরোটাই মরে যেতে হয়।

সব পুরুষই বোধহয় এ ব্যাপারে সরলরৈখিক, তাছাড়া দুঃস্থ নারী উর্বসী হলে তার ওপরে চোখটাও পড়ে খুব তাড়াতাড়ি। নিজেকে থামাতে হলো, চোখ ফেরাতে হলো।

হাঁটতে হাঁটতে আবার মাওয়া ঘাটে আসলাম। ভাজা পোড়া জাতীয় খাবার খেতে চাই না, ক্ষণিকের পরিব্রাজক হয়েছি বটে, তাই বলে দীর্ঘ জীবনের তরিকা অমান্য করতে চাই না।

অনেক ন্যুজ ঈশ্বর বিশ্বাসী দেখেছি, একইসাথে দেখেছি বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সবটুকু সুবিধা তাদের নিতে। আবার ঈশ্বর নিয়ে অত চিন্তিত নয়, তাদের দেখেছি একেবারে ঐশ্বরিক জীবনযাপন করতে! তাদের জীবনের মূলমন্ত্রই হচ্ছে— “যা হবে হোক।” তাই এসব আমার খুব গোলমেলে লাগে সবসময়।

ধর্ম বিশ্বাসীর সাথে ধর্ম অবিশ্বাসীর জীবনাচারণের এ পার্থক্যগুলো দৃশ্যমান নয় সবসময়— তবে এটা সত্য যে, ধর্মবিশ্বাসী এবং অনুশীলনকারীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে বেশি স্বার্থপর হয়। আবার কিছু অন্ধ ধর্মবিশ্বাসী মানুষ রয়েছে যাদের জীবনযাপনের সাথে অসাধারণ মানুষের জীবনযাপনের মিল রয়েছে! খুব গোলমেলে বিষয় এগুলো— গোলকধাঁধার মতো।

এদেশে ব্যবসা বাণিজ্য, রাজনীতি করতে ধর্মটা লাগে, সহজ হয় কাজ। আমিও যে ধর্ম ব্যবহার করি নাই তাতো নয়। অফিশে প্রার্থনার জন্য আলাদা জায়গা করে দিয়েছি। ওরা পরকালের পথ চেয়ে থাকে বলেই ইহকালে আমার ভাগে বেশি পড়ে। শ্রম আইন, ইনক্রিমেন্ট, কর্মঘণ্টা কিছুই তারা বুঝতে আসে না, কারণ, পরকালের পথটি তারা পরিষ্কার দেখতে পায়! তাছাড়া হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও অফিশে মুসলমানদের জন্য নামাজের জায়গা করে দিয়েছি— এতে তারা একেবারে গলে যায়।

আমারও আজকাল মাঝে মাঝে ঘোর লাগে। বয়সের ভার হয়ত— তাহলে আমিই কি বঞ্চিত হচ্ছি পরকালের অনন্ত জীবনের নৈরাজ্যকর ভোগবাদ থেকে? মানুষ এমনই, সংখ্যাগরিষ্টের মতামতের প্রতি এক ধরনের দুর্বলতা এমনিতেই তৈরি হয়ে যায়। এটাই সংখ্যার মাহাত্ম। যদিও বুঝি পরকাল একটা মিথ , তারপরেও ওটা মাঝে মাঝে আমাকেও টানে।

চিড়া-দই খেতে চাই, কিন্তু মাওয়া ঘাটে এরকম কোনো দোকান খুঁজে পেলাম না। সিদ্ধান্ত নিলাম গোপালগঞ্জ চলে যাই। রাতটা ওখানে কোনো হোটেলে থেকে পরের দিন সকালে টুঙ্গিপাড়া যাব।

ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা একটি বাসের ইঞ্জিন কাভারে বসলাম গোপালগঞ্জ যাওয়ার জন্য। ইচ্ছে করলে মাইক্রো ভাড়া করে যেতে পারতাম। কিন্তু ওভাবে চললে পরিব্রাজক হওয়ার আনন্দ আর থাকে না। তাছাড়া বহুদিন এক প্রকার সমাজ হতে বিচ্ছিন্ন আছি, মানুষের জীবনটাও দেখতে চাই। আমার কোম্পানির পণ্যগুলো এই মানুষদের চেনে, কিন্তু আমি ওদের চিনি না।

অনেকদিন ধরে আমার চলাফেরা অমানুষ এবং বিশেষ ধরনের মানুষের সাথে। দু’জন জ্ঞানী লোকের বন্ধুত্ব দু’টো প্রিজম পাশাপাশি রাখার মতো— কেউ কারো আলো সহ্য করতে পারে না। দু’জন ব্যবসায়ী বা টাকাওয়ালা মানুষের বন্ধুত্ব হচ্ছে অনেকটা জেলখানায় বন্দী খুনী আসামীর মতো— সাধারণ কয়েদীদের সাথে বন্ধুত্ব তাদের মানায় না। চাচ্ছি অন্তত কিছুদিনের জন্য একটু ভিন্নভাবে বাঁচতে।

-চলবে


লেখকের নাম শেষ কিস্তিতে প্রকাশ করা হবে।