কাঞ্চনপুর গ্রামে বাস করত চাষী বশির মিয়া। বশির মিয়ার বিশাল একটা সবজির বাগান ছিল। বাগানে হরেক রকমের সবজি গাছ ছিল। এমন কোনো সবজি গাছ নাই যে বশির মিয়ার বাগানে ছিল না। তার বাগানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আর্কষর্ণীয় ছিল— পটল আবাদ করা অংশটা। বশিরের বাগানে প্রচুর পটলের ফলন ছিল। পটল গুলো ছিল খুবই স্বাস্থ্যবান। এত পটলের মাঝে দুটি পটলের মধ্যে বেশ ভাব ছিল। ওরা দুজনে খুব ভাল বন্ধু— ওরা পাশাপাশি একই স্থানে বড় হয়েছে।
ওদের একজনের নাম ছিল মিঠু, আরেকজনের নাম ছিল মনা। দুজনে দেখতে একই রকম । কে মিঠু এবং কে মনা চেনা খুব মুশকিল ছিল। কিন্তু ওরা দুজন বিষয়টা নিয়ে মোটেই ভাবে না বরং ওরা এই ভেবে খুশি হয় যে, ওরা সহজেই বাগানের অন্যান্য সবজি সম্প্রদায়কে ধোকা দিয়ে বোকা বানাতে পটু। দুজনের গলায় গলায় ভাব। সারাদিন ওরা ত্রিং ত্রিং করে খেলা করে আর সন্ধ্যা হলে ঘরে ফিরে আসে। কিন্তু একদিন ওরা কি নিয়ে যেন তুমুল ঝগড়া করল। তারপর থেকে দুজনের কেউ কারো সাথে দেখাও করে না কথাও বলে না। দুজনেরই খুব মন খারাপ। কিন্তু কীভাবে যেন দুজনের পরিকল্পনা এক হয়ে যায় সব সময়— ঝগড়ার পরেও।
মিঠু ভাবল যে মনার মুখ দেখবে না, তাই সে মাটির নিচ দিয়ে রাস্তা খুড়ে যাতায়াত করার ব্যবস্থা করল মনাকে না জানিয়ে। এদিকে মনাও মাটির নিচ দিয়ে রাস্তা খুড়ে মিঠুকে না জানিয়ে। দেখা গেল দুজনের পাশাপাশি রাস্তা হয়ে গেছে। কী আর করা! দু’জনে নিজ নিজ রাস্তা দিয়ে আসা যাওয়া করে কেউ কারো দিকে তাকায় না, দুজনেই উপরের দিকে তাকিয়ে হাটে।
একদিন সন্ধ্যায় অন্ধকারে দুজনের খেলা শেষে বাড়ি ফিরছে নিজ নিজ রাস্তা দিয়ে পাশাপাশি হেঁটে, কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না। হাঁটছে উপরের দিকে তাকিয়ে। এভাবে উপরের দিকে তাকিয়ে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে দুজনেই দুষ্টুমির ছলে অন্ধকারে ঘুরে দাড়িয়ে পরস্পর বিপরীতমুখী হাটা শুরু করে। এভাবে পাশাপাশি হয়ে হাঁটার সময় একজনের পেটের সাথে আরেকজনের পেটের ভীষণ জোরে ধাক্কা লাগে, কারণ দুজনের পেট গোলাকৃতিরভাবে খুব মোটা।
ধাক্কার পর মিঠু আর মনার মধ্যে অনেক ঝগড়া হয়। ওদিকে মাটির উপরের পটলরা ভাবছে কী ব্যাপার মাটির নিচে কিসের এত চিৎকার শোনা যাচ্ছে — এগিয়ে যাই তো। সবাই এসে তো অবাক মাটির নিচে দুটি রাস্তা দেখে! সবাই মিঠু আর মনার গোপন যাতায়াতের রাস্তার সন্ধান পায়। গিয়ে দেখতে পেল মিঠু আর মনা ঝগড়া করছে।
সবাই কিছুক্ষণ ওদের ঝগড়া দেখল তারপর ওদের দুজনের ঝগড়া থামিয়ে শান্ত করে যার যার ঘরে পাঠিয়ে দেয়। মিঠু এবং মনা ঘরে এসে কেউ শান্তিতে ঘুমাতে পারছে না। দুইজনেই ভাবছে— ইস্ ধাক্কা না হয় লেগেইছিল তাতে আমরা ঝগড়া না করলেও পারতাম। সেই ছোটবেলা থেকেই তো আমরা বন্ধু। তারপরও কেন যে বুঝলাম না!
মিঠু ভাবছে— কেন যে ঝগড়া করলাম বন্ধুর সাথে। দুঃখিত বলেও তো চলে আসতে পারতাম। ওদিকে মনা ভাবছে— কেন যে বললাম না আমি খুবই দুঃখিত। ইস্ বন্ধুর সাথে কতদিন পরে কথা বললাম, থাক ঝগড়া থেকেই হোক আর যাইহোক কথা তো বলেছি। মিঠু আরো ভাবছে— আমরা দুই বন্ধু দেখতে একইরকম হওয়ায় কত মজাই না করতে পারতাম সবাই কে ঠকাতে পেরে! ধুর, এখন সময়টা আর কিছুতেই কাটে না!
ঐদিন রাতে কেউ আর রাতে ঘুমাতে পারল না। পরদিন সকালবেলা ওরা আবার মাটির নিচের রাস্তা দিয়ে পুকুরে যাচ্ছে মুখ ধোয়াঁর জন্য— এবারও সেই একই কাণ্ড ঘটে গেল। একজনের পেটের সাথে আরেকজনের পেটে খুব জোরে একটা ধাক্কা লাগল, দুজনেই ব্যথা পেয়ে দুজনেই দোষ দিতে লাগল নিজেদের পেটটাকে। কেন যে পেটটা এত মোটা হয়েছে! এই পেটের জন্যই যার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না তার সাথে ধাক্কা লাগে।
কিন্তু ওরা একে অপরের সাথে কথা বলার জন্য ভেতরে ভেতরে কষ্ট পাচ্ছে। এবার আর দুজনে ঝগড়া করল না। দুজনেই মাথাটা নিচু করে দুই দিকে চলে গেল।
এদিকে আশে পাশের অন্য পটলরা ভাবছে— কী ব্যাপার ওদের মধ্যে কী হয়েছে কেউ কারো সাথে কোনো কথা বলে না! যেখানে ওরা সারাদিন দুজনে মিলে খেলায় মেতে থাকত অথচ এখন দুজনের রাস্তা দুটো!
আজ মিঠুর খুব মন খারাপ। বিকেলে খেলতে যাবে, কিন্তু মনাকে রেখে একা যেতে তার খারাপ লাগছে। কোনোদিন ওরা একজন আরেকজনকে ছাড়া খেলতে যেত না। মিঠু আর মনার মধ্যে মন কষাকষিতে অন্যান্য পটলদেরও বিষয়টা ভালো লাগছে না। ওদেরকে নিয়ে মজা করে বশির মিয়ার সবজি বাগানের পটল সম্প্রদায়সহ অন্যান্য সবজি সম্প্রদায়রাও আনন্দে দিন কাটাচ্ছিল।
অন্যান্য সবজিরাও চেষ্টা করছে ওদের মধ্যে মিল করিয়ে দিতে, কিন্তু কেন জানি তা হচ্ছে না কোনোভাবে। গত সপ্তাহে বেগুন সম্প্রদায় সালিশ ডাকল মিঠু আর মনাকে একত্র করার জন্য, কিন্তু মিঠু নামের পটলটি সেদিন সালিশে তো আসলই না বরং চিঠি পাঠালো— “আমার সালিশ-বিচার লাগবে না, আমি এমনিতেই ঠিক আছি।”
সালিশের সবাই তো অবাক! এতদিন ধরে ঝগড়া করে বসে আছে, এখন আবার চিঠি লিখেছে সে নাকি একাই ঠিক আছে। ওদিকে মনা সালিশে আসার আগে মিঠুকে চিঠি লিখে পাঠিয়েছে— “তোরে একটা আছাড় দিমু।” মনার সেই চিঠিটি একটি মিষ্টি আলুর মাধ্যমে সালিশে উপস্থাপন করার জন্য পাঠিয়েছে মিঠু।
চিঠির বাক্যটা পড়ে সালিশে উপস্থিত সবাই চোখ রাঙিয়ে তাকায় মনার দিকে। ওদের দুজনের ওপর রাগ করে সালিশ ভেঙ্গে দিয়ে সবাই যার যার মতো চলে যায় নিজেদের জায়গায়। মিঠু সালিশে সরাসরি উপস্থিত না হয়ে সবার অজান্তে এসে দাড়িয়ে ছিল আড়ি পেতে। সবাই যখন সালিশ ছেড়ে চলে যাচ্ছিল তখন সে দৌড় দিয়ে মাটির নিচে রাস্তার ভেতরে চলে যায়।
বিষয়টা অন্যরা কেউ খেয়াল না করলেও মনা ঠিকই খেয়াল করে এবং সেও আস্তে আস্তে তার মাটির নিচের রাস্তার দিকে যায়। ওখানে গিয়ে দেখে মিঠু উপরের দিকে তাকিয়ে মনার রাস্তার মাঝখানে দাড়িয়ে আছে। এই সুযোগে মনা আস্তে করে মিঠুর কাছে গিয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে মিঠুকে একটা আছাড় দেয়। তারপর দুজনে মুখোমুখি হয়ে হেসে একে অপরের সাথে কোলাকোলি করে।