জীবনটা আমি হালকাভাবে নিয়েছি বলেই এরকম মহা বিপদগ্রস্থ একটা পরিবার সাথে নিয়ে বহাল তবিয়তে বেঁচে আছি। জীবনটাকে খুব সিরিয়াসলি দেখলে খবর ছিল।
২০০৭ সালে, আমাকে ক্রমাগতভাবে একটা কারণে মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হচ্ছে। আমি আসলে মোটেই ভয় পাচ্ছিলাম না। অবশেষে তাদের বললাম, “ভাই, বলেন, আপনারা কই আছেন, অামি একটু লুকায়ে দেখে যাই আপনাদের, যারা খুন করতে পারে তাদের আমি খুব অসাধারণ প্রকৃতির অমানুষ মনে করি।” সম্ভবত সুযোগে কেউ মজা করছিল। এরপর আর ফোন দেয় নাই। পরে অবশ্য জীবনহানীকর বিপদ প্রায় একটা ঘটেছিল।
টাকাপয়শার বিপদে কেমন পড়েছি তা আর বলে শেষ করা যাবে না। ২০০১ সাল, তখন খুলনায় থাকতাম। টাকা না থাকা নিত্যদিনের ব্যাপার। বিভাষ দার দোকানে কাজ করতাম, কিন্তু সে দোকান চলত না, ফলে আমারও কোনো আয় ছিল না।
প্রথম প্রথম খাওয়াথাকা বিভাষ দা চালাত, এরপর নিজের। কোনো আয় নেই, কোনো সম্ভাবনাও নেই। ম্যাচের পরিচালককে বলতে থাকলাম, বিশেষ একটা সমস্যার কারণে বাড়ি থেকে টাকা আসতেছে না, দুই মাসের টাকা একবারে দিয়ে দেবানে।
অর্থাৎ আমি এভাবে কিছু সময় হাতে নিলাম। এরমধ্যে আমার জোগাড় জন্তর করতে হবে। খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে আমি বরাবরই একটু লোভী প্রকৃতির, খাবার দেখলে খেতে ইচ্ছে করে। খুলনায় আহসান আহমেদ রোডে তখন চমৎকার দুটো সিঙ্গড়া সমুচার দোকান। খালি পকেটে পাশ দিয়ে যাই আসি! একদিন ঢুকে পড়লাম। খাইলামও। টাকা দেওয়ার সময় বললাম, ভাই, আমার তো রোজ এসব খাওয়া লাগে, তাই মাস চুক্তি খাই। আগে অমুক দোকান থেকে খাইতাম, কিন্তু ওদের মাল আর ভালো নেই, এখন আপনার এখান থেকে খাব। লোকটা কী ভাবল কী জানি। মাথা নেড়ে সায় দিল। রোজ খাই, সকাল বিকাল খাই। কিন্তু কতদিন?
দুই মাস চলে গেল, আয়ের কোনো বন্দোবস্ত নেই, অবশেষে ৫০০টাকা বেতনের একটা টিউশনি জুটলো রয়েল হোটেলের পেছনে, ছাত্রী ফাইভে পড়ত। প্রথম দিনেই টাকা অগ্রীম চাইলাম। বললাম, অগ্রীম টাকা না দিলে পড়ানো সম্ভব হবে না। ছাত্রীর মা বলল, তাহলে পড়ানোর দরকার নেই। বললাম, ঠিক আছে, অগ্রীম লাগবে না।
ইতোমধ্যে দেয়ালের মধ্যে পিঠ ঢুকে গেছে, সেই দেয়াল সাথে নিয়েই চলছি। পনেরো দিনে আরেকটি টিউশনি জুটলো মাসিক ৭০০টাকা বেতনে। এবার আর বলদের মতো অগ্রীম টাকা চাইলাম না।
সমুচার দোকানের সামনে দিয়ে আর হাঁটি না, কিন্তু বাসায় না যেয়ে তো উপায় নেই। কিরিটী দা তখন মেচের পরিচালক। সবাই সেদিন আমার জন্য অপেক্ষা করতেছে, চালের দোকানদার এসে ফিরে গেছে। দোকানে ১৫০০টাকা কীভাবে বাকী পড়লো কৈফিয়ত দিতে হবে। সবাই তো টাকা ঠিকই দিয়েছে, তাহলে বাজারের চালের দোকানে মেচের নামে বাকী কেন?
আমি তো সবার দেয়া টাকার একটা অংশ দিয়ে গত এক মাস চলেছি, কিছু বইও কিনেছি। সমুচাও খেয়েছি কিছু।
বাসায় ঢোকার সাথে সাথে সবাই ঝাপিয়ে পড়ল যে যার মত করে। আমি বললাম, “কই! চালের দোকানে কোনো বাকী রাখি নাই তো। –এই ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।”
তখন হাতে হাতে মোবাইল এসে পারেনি, দোকানে গিয়ে কল করা লাগে, তাই বক্তব্য নিশ্চিত করার খুব একটা সুযোগ সে মুহূর্তে নাই।
আমার প্লান হচ্ছে, খুব ভোরে বাড়ি রওনা হব। হলামও তাই। বাড়ি এসে চারা চারা কয়েকটি তালগাছ বেঁচে ৯০০০টাকা ম্যানেজ করে নিয়ে গেলাম। বাড়িতে বেঁচার মতো আর কিছু ছিলও না আসলে। জীবনে এই একবারই আমি পড়াশুনা বাবদ বাড়ি থেকে কোনো টাকা নিয়েছি। এসএসসি পর্যন্ত দাদু বাড়ি থেকেছি।
খুলনায় গিয়ে আগে চালের দোকানে টাকা দিলাম। এরপর দিলাম সমুচার দোকানে, কারণ, ঐ পথ দিয়ে না হাঁটতে পারলে অনেক ঘোরা লাগে।
এরপর বাসায় গিয়ে হিসেব করে সব দিলাম। গরীবের যায় বেশি অবশেষে, অনেকক্ষেত্রে বেশি দিতে হলো, বাক বিতণ্ডা করে আর লাভ হল না, যাইহোক, ডিফল্টার হলে তো আর বেশি কথা বলা চলে না। হাতে ২০০০টাকার মতো থাকল। টিউশনি থেকে আসবে মাসে ১৫০০ টাকা। নাউ লাইফ ইজ বিউটিফুল। সকল বইয়ের একটা করে লেকচার গাইড কিনে ফেললাম। সম্ভবত তখন অক্টোবর/নভেম্বর মাস, ২০০১ সাল।