সত্যি কথা বলতে সেদিন আমি বুঝেছিলাম যে, অধিকারের সীমানা বোঝাটা কত জরুরী। শার্টটি ছিল মাত্রাতিরিক্ত বড়, সেজন্য এবং শার্টটা দেখলে সবার বিস্মিত মুখ চোখে পড়ত বলেও তা আর আমার পরা হয়নি। দু’ একবার মাত্র পরেছিলাম।
অন্যের, বিশেষ করে স্বচ্ছল যারা, তাদের সবই সঠিক এবং অনুকরণীয় মনে হতে তখন। আমি ওরকম করতে চাইতাম, ওরকম পরতে চাইতাম, হাব-ভাবও অনুকরণ করতাম। নিজেকে মনে হত হীন, নিকৃষ্ট—চারপাশের মানুষই এমন ভাবতে বাধ্য করেছিল।
নিজের উপর প্রবল অবিশ্বাসে শুধু বাধ্য হয়ে কিছু করতাম। পড়াটা ছিল সবচেয়ে বড় দায়, দায়সারা। মামাদের জমের মত না হলেও ভয় পেতাম, সত্যি কথা বলতে ঐ ভয়টুকু না থাকলে চলত না। আসলে ভয়ের থেকে আমার লজ্জাবোধই বেশি ছিল। লজ্জাবোধই আজীবন আমাকে সামনের দিকে ঠেলেছে বেশি। ভাবতাম, মামাদের বাড়িতে থাকি, শুধু খেলেদুলে বেড়ালে কীভাবে হয়, কিছু পড়া কিছু কাজ করা তো উচিৎ—এই ঔচিত্যবোধটুকু কীভাবে জানো খুব ছোটবেলাতেই আমার মাঝে জাগ্রত হয়েছিল।
যে কথা বলছিলাম, তখন সবই আমি অনূকরণ করি, মামাদের মনে হত আইকন। ওনারা বাড়ি থাকতেন না। জেলা শহরে, কেউ বিভাগীয় শহরে থাকতেন। সবাই খুব ফরমাল, বিড়ি-চুরট কেউ খান না, প্যান্ট শার্ট পরিপাটি হয়ে চলাফেরা করেন, প্রত্যেকের আচরণ মার্জিত, সংস্কৃতিমনা, সংবেদনশীল, এগুলো আমার ভালো লাগত—অর্থাৎ এর বাইরে কিছু জানা শোনার সুযোগ তখন আমার ছিল না।
কীভাবে যেন ভালো না লাগা জিনিসগুলো আমি বর্জন করতে পেরেছিলাম। ওনাদের অনেক জিনিস আমার কাছে তখনই অপ্রয়োজনীয় এবং নেতিবাচক মনে হত, আমি সেগুলো বর্জন করতে পেরেছিলাম বা আমার মনে একটা প্রশ্ন থেকে যাচ্ছিল। এককথায় মামাবাড়ি থেকে ভালো গুণগুলো আমি নিজের সংগ্রহে রাখতে সমর্থ হয়েছিলাম হয়ত।
একটি অনুকরণের কথা মনে পড়লে এখনও লজ্জা পাই। তখন সিল্কের এক প্রকার বিশেষ শার্ট বেরিয়েছে, সম্ভবত ১৯৯৭ বা ’৯৮ সাল হবে। মেজ মামা এরকম একটি শার্ট পরে বাড়িতে আসলে আমার খুব লোভ হয়। সিদ্ধান্ত নিই এরকম একটি শার্ট আমার কিনতেই হবে। এর আগে এরকম কখনো হয়নি। জোর করে কোনো কিছু কেনার চেষ্টা করিনি।
দুই মাইল দূরের বাধাল বাজার তখনই বেশ বড়, মোটামুটি সব পাওয়া যায়, গিয়ে খোঁজ নিলাম ঐরকম শার্ট আছে কিনা, হবহু না পেলেও পেলাম। দাম চাইল ছয়শো টাকা। তখন একশো বা বড়জোর দেড়শো টাকার মধ্যে শার্ট পরি, মামাদের শার্টও পরি। সেখানে ছয়শো টাকা কল্পনার অতীত। শুকনো সুপারির কেজি তখন ষাট-সত্তর টাকা, যা এখন তিনশো থেকে চারশো টাকা। অর্থাৎ, ওরকম একটি শার্ট কিনতে হলে আমাকে দশ কেজি সুপারি বিক্রী করতে হবে। তাই করার সিদ্ধান্ত নিলাম তখন।
কাঁচা হাতে দশকেজি সুপারি ফোঁড়াও কম কথা নয়। মামারা প্রায়ই কেউ বাড়ি থাকতেন না, তাই মামা বাড়ির রাজত্ব পুরোটাই পেতাম এক প্রকার। দিদিমা বারে বারে জিজ্ঞেস করছিলেন—এত সুপারি দিয়ে কী করব। যেহেতু আমার খুব একটা দুর্নাম ছিল না, তাই কেউ প্রথমে গা করেনি। অবশেষে যখন দেখল আমি ওরকম একটি শার্ট কিনে নিয়ে এসেছি ছয়শো টাকা দিয়ে তখন সবাই যেভাবে বিস্মিত হয়েছিল তাতে শুধু ঘৃণাই মেশানো ছিল।
সত্যি কথা বলতে সেদিন আমি বুঝেছিলাম, অধিকারের সীমানা বোঝা কতটা জরুরী। শার্টটি ছিল মাত্রাতিরিক্ত বড়, সেজন্য এবং শার্টটা দেখলে সবার বিস্মিত মুখ মনে পড়ত বলেও তা আর আমার পরা হয়নি। দু’ একবার মাত্র পরেছিলাম।