ভাঙ্গাচোরা এই কম্পিউটারটিই দীন মোহাম্মদের এখন একমাত্র সম্পদ। এটি দিয়েই কোনোমতে পেট চলছে তার। শুধু নিজের চলা তো নয়, পরিবারের ভরণপোষণও যতটা পারা যায় সে করছে। সম্পর্ক ভালো থাকছে না অবশ্য কারো সাথে, কথা দিয়ে কথা রাখাও সম্ভব হচ্ছে না।
নিজের ভাবালুতাও কম ভোগায় না নিজেকে। একেকবার একেকরকম মনে অাসে, কোনো দিশা না থাকলে যা হয়। বয়স তো কম হয়নি, ষাটের কাছাকাছি হবে। এই বয়সে কোনো উদ্যোগ নেবার কথা বললে মানুষ মন দিয়ে শোনো কেউ কেউ, সাথে সাথে আবার দিগুণ মনোনিবেশে তা ভুলেও যায়।
দীন মোহাম্মদ এসব বোঝে না তা নয়, তারপরেও কিছু তো বলতে হবে, চলতেও হবে। বিষন্ন বিতশ্রদ্ধ হয়ে থাকার চেয়ে “গড়ে হরিবোল” জীবনই বোধহয় শ্রেয়। যা হচ্ছে হোক, যে যা বলবে বলুক, সমাধান তো কিছু দেখা যায় না। দীন মোহাম্মদ এখন সে মতেরই অনুসারী।
বাঁচার জন্য কখনো হয় কথা নয়, নয় কথা ছয় করতে হচ্ছে, মানুষ প্রতারক ভাবছে কখনো কখনো। কিন্তু কিছু তো করার নেই। এর চেয়ে কম থাকা তো যায় না, এর চেয়ে কমভাবে থাকা মানে মরে যাওয়া, তাতেও যদি কেউ ঠকে, কাউকে ঠকাতে হয় তাহলে আর কী করার থাকে? দীন মোহাম্মদ ভেবে পায় না- সৎভাবে বেঁচে থাকা বলতে তাহলে আসলে কী বোঝায়!
অাজকে হঠাৎ কম্পিউটারটা কিছুতেই আর অন করা গেল না। এমনিতে দিন অানি দিন খাই অবস্থা, এই মুহূর্তে কম্পিউটার সারানোর টাকা কোথা থেকে আসবে? দুইশো টাকা কন্ট্রাক্টে একজন লোক ডেকে সমাধান কিছু পাওয়া গেল না, কিন্তু জানা গেল যে কম্পিউটারটির জীবনীশক্তি আসলে শেষ হয়েছে। তারপরেও নতুন মাদারবোর্ড লাগিয়ে কিছুদিন চালাতে চায় মোহাম্মদ।
নাম মোহাম্মদ হলে কী হবে মোহাম্মদের অনুসারীরা তাকে শত্রু জ্ঞান করে, তাই এ তল্লাটের কারো কাছ থেকে দুই পয়শা সহযোগিতা পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। দু’এক জন দায় ঠেকে কাজ করায় তা দিয়ে কোনোমতে চলে। সুবিধা হলে ব্যবসায়ীরা শত্রুকেও কাজে ডাকে। এই কারণে দীন মোহাম্মদও কিছু কাজটাজ পায়। তাই বলে ভালোবেসে কেউ এক কাপ চা খাওয়াবে সে সম্ভাবনাও খুব কম।
হঠাৎ তার মনে পড়ল সুদীপের কথা। সুদীপ এক আজব চরিত্র। বোঝা যায় না কিছু। অস্বচ্ছল না স্বচ্ছল, ধ্বংসপ্রাপ্ত, নাকি ধ্বংসপ্রায়, নাকি ভেতরে ভেতরে সম্রাজ্য জয়ের প্রস্তুতি চলছে কিছুই আঁচ করা যায় না। দীন মোহাম্মদের সাথে সুদীপের সম্পর্ক খারাপ না, পরিচয় খুব বেশদিনের না হলেও একটা সম্পর্ক মোটামুটি তৈরি হয়েছে।
মোহাম্মদ চাইছে এই অবস্থায় সুদীপের স্মরণাপন্ন হতে, যদিও জানে সুদীপ নিজেই আছে বর্তমানে বিপদে। তারপরেও কূলহারা মানুষের যা হয়, সুদীপের কথা ভেবে দীন মোহাম্মদ নিজের মধ্যে হঠাৎ আশার সঞ্চার করে ফেলেছে।
পকেটে আছে মাত্র বিশ টাকা, দশ টাকা দিয়ে সুদীপের ছেলের জন্য এক প্যাকেট চিপস কিনে ওদের বাসায় যায়। বাসায় গিয়ে খুব একটা ভূমিকা না করেই সূদীপের কম্পিউটারটা চেয়ে বসে। কিন্তু এটা তো অযৌক্তিক। কীভাবে নিজের কম্পিউটারটি কাউকে দেওয়া যায়! সেকথা অবশ্য বিপদের মধ্যে দীনের মনে আসে না।
সুদীপ না করাতে দীন মনক্ষুণ্ন হয় না। অতি আবেগী মানুষ বাস্তবতা বুঝতে পারে একটু দেরীতে, এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। কিন্তু আজকের ঘটনাটায় একটা বিশেষ বৈপরিত্য আছে। চা বিস্কুট খেয়ে চলে যাওয়ার সময় দীন ভাবছে, পকেটের বিশ টাকা দিয়ে অন্তত দুপুরের খাওয়া কিছু একটা হত। তাও গেল! ব্যাটার ভাব তো কম না, কিন্তু কোনো হেল্প করতে পারল না।
ওদিকে সুদীপ ভাবছে, সকালে এসে এ কী উৎপাত! কারো কম্পিউটার কেউ নিতে চায় নাকি? একটা চিপস নিয়ে বাসায় এসে কী বিপদেই না ফেললেন উনি, ছেলেটা পুরো চিপস বসে বসে খেয়েছে, এখন কি ও আর কিছু খেতে চাইবে?