মর্মান্তিক! চোখের সামনেই নগ্ন করে পিটিয়ে মারা হলো নারীকে
খবরটি আমাকে দুমড়ে মুছড়ে দিয়েছে একেবারে। বিবেকতাড়িত বা আবেড়তাড়িত না হয়ে আমি কোনোদিন এক কলমও লিখিনি, কিন্তু এখন লিখছি শুধুমাত্র নিজেকে সুস্থ করতে!
আমি সবসময় অামার পরিবারের একটি বিষয় যথাসম্ভব মানুষের কাছে লুকিয়ে রেখেছি। লুকিয়ে রেখেছি, কারণ, আমি জানি, মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষের প্রতি এই সমাজের মানুষের আচরণ কী হয়। তাই বলে এটা ভাবিনি যে আমার চারপাশের মানুষ এরকম কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলবে। কিছু ঘটনা বাদ দিলে আমি মানুষের কাছ থেকে এ পর্যন্ত বরং সহযোগিতাই পেয়েছি।
আমার মা ঢাকা শহরে এখন পর্যন্ত দুইবার হারিয়ে গিয়েছে, একবার তাকে পুরোন ঢাকার লক্ষ্মীবাজার পেয়েছিলাম অজ্ঞান অবস্থায়। মাইকে ঘোষণা করার পর সন্ধান পেয়েছিলাম। কয়েকজন শিক্ষার্থী সেদিন মাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিল। ওদের প্রতি আমি শ্রদ্ধায় অবনত হয়েছিলাম। মা সুস্থ হলে জেনেছিলাম, অনেকে তাকে বিভ্রান্ত করেছিল সেদিন, নানানভাবে উত্যক্ত করেছিল।
সবচে’ বেশি ভয়ঙ্কর বিষয় হচ্ছে, মানসিক রোগ যে একটা রোগ এটি আমাদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত নয়, এর চেয়েও ভয়ঙ্কর- অনেকে মনে করে এরা (মানসিক রোগীরা) যেহেতু দিকহারা থাকে তাই তাদের সাথে যে কোনো রকমের ব্যবহার করা যায়, এমনকি শারীরিকভাবে নিগৃহীত করার সুযোগও নেয় অনেকে। কিন্তু আমি সবসময় এটুকু আস্থা রাখতে চেয়েছি যে বর্তমান পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ ভালো, মানবিক এবং সহনশীল। কিন্তু বারে বারে আমি ধাক্কা খাই, অামার সে বিশ্বাস ভেঙ্গে যায়।
এক জায়গায় অনেক মানুষ যখন একই রকমের আচরণ করে তখন তারা আসলে গণমানুষের প্রতিনিধিত্ব করে, যদিও তাই বলে এরকম সিদ্ধান্তে আসার সুযোগ নেই যে কোনো একটি জায়গায় শতকরা একশোভাগ লোক নিষ্ঠুর এবং নিষ্ক্রিয় আচরণ করেছে বলে সব জায়গার শতভাগ লোক একই রকম।
‘আমাদের সমাজ’ এবং ‘এই সমাজ’ বলাতে অনেকের কাছে খটকা লাগতে পারে। কারণ, খবরে যে ঘটনাটির কথা বলা হচ্ছে, সেটি সীমান্তের ওপারে আমাদের পাশ্ববর্তী দেশে। খবরটি হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের সেকেন্দ্রা গ্রামের, সেখানে একজন মানসিক ভারসাম্যহীন নারী গ্রামটিতে ঢুকে পড়লে এলাকাবাসী তাকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করে।
আমাদের সমাজ বলছি, কারণ, আমি ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের মানবিকতাবোধ এবং সামগ্রিক আচরণ ও শিক্ষা-দীক্ষা একই পাল্লায় মাপতে চাইছি। যদিও আমার বিশ্বাস এবং ধারণা হয়, বাংলাদেশ অপেক্ষাকৃত ভালো, হতে পারে শুধু নিজের দেশ বলে বলছি।
অবশ্য এরকম ঘটনা যে আমাদের দেশে ঘটে না তা নয়, নোয়াখালিতে মিলন নামে এক কিশোরকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল পুলিশের সামনেই, এরকম অনেক ঘটনা আছে। পায়ুপথে পাম্পের বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা করার ঘটনা আছে, গাছে বেঁধে রেখে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা আছে, পারিবারীক নির্যাতন-সহিংসতা তো আছেই।
কিন্তু তারপরেও আমার বিশ্বাস হয়, নারীদের প্রতি সমাজ একটু বেশি সংবেদনশীল (হওয়ার কথা), এবং কোনো নারী মানসিক রোগী জানার পর তার সাথে মানবিক আচরণ করতে না পারলেও পিটিয়ে মারবে না মানুষ, আমি বিশ্বাস করতে চাই আমাদের দেশের মানুষ এটি করবে না। কিন্তু কাছাকাছি শব্দ দিয়ে গুগল সার্চ করে আমাকে হতাশ হতে হয়েছে। অর্থাৎ, যতই অনুষ্ঠানাদী এবং ঈশ্বর বিশ্বাসের মত-পথে পার্থক্য থাক পশ্চিমবঙ্গ এবং আমরা যেন মূদ্রার এপিট-ওপিট। এসব খবরে মনে হয়- আমরা আসলে একই বৃন্তের দুটি বিষবৃক্ষ আলাদা হয়েছি মাত্র, অন্তর-আত্মায় অনেকেই আমরা লালন করে রেখিছি একইরূপ অসভ্যতা-বর্বরতা।
গুগল সার্চে সারাবিশ্বেই এরকম ঘটনার খবর আছে, মানসিক ভারসাম্যহীন নারীকে কুপিয়ে পিটিয়ে মারার রেকর্ড আমাদের দেশে আছে, পাকিস্তানে নারীদের বিভিন্ন অপবাদ দিয়ে হত্যা করার রেওয়াজ আছে খুব বেশি।
যেমন,
গান গাওয়ায় ৫ নারীকে হত্যা। পাকিস্তানের দুর্গম কোহিস্তান প্রদেশের ঘটনা এটি।
অনার কিলিং-এর ঘটনা তো ঘটছে পাকিস্তানে প্রত্যহই।
‘কুরআন পোড়ানো’র অভিযোগে আফগান নারীকে পিটিয়ে হত্যা। এটি আফগানিস্তানের ঘটনা। শতশত মানুষে মিলে উল্লাস করে হত্যা করেছিল মানসিক ভারসাম্যহীন ঐ নারীকে।
মানসিক ভারসাম্যহীন’ নারীকে কুপিয়ে হত্যা। এটি পাবনার ঈশ্বরদীর ঘটনা। মানসিক ভারসাম্যহীন বৃদ্ধাকে গুলি করে মারলো নিউইয়র্ক পুলিশ। ঘটনাটি ঘটেছিল আমেরিকার নিউইয়র্ক সিটিতে।
কিছুদিন আগে একটি খবর পড়েছিলাম- “ভূত তাড়াতে’ এক নারীকে পুড়িয়ে হত্যা” খবরটি দক্ষিণ আমেরিকার দেশ নিকারাগুয়ার। যৌন সম্পর্কে বাধা দেওয়ায় ১৯ নারীকে পুড়িয়ে হত্যা করল আইএস! ইরাকের মসুলে হত্যাকাণ্ডের এ ঘটনাটি ঘটে।
বোঝা যাচ্ছে, বিশ্বজুড়েই এ ধরনের ঘটনা আছে, যেটি শিক্ষা-দীক্ষায় অনুন্নত এবং মানবিক চর্চার অভাব রয়েছে এমন অঞ্চলে বেশি ঘটে। ‘অজ্ঞতা এবং নৃশংসতা’ ব্যতীত অন্য কোনো বিশেষণে এ হত্যাকাণ্ডগুলোকে বিচার করার সুযোগ নেই।
ঘটনাগুলো বেশি বেশি প্রচার হলে কী লাভ হয়–সুনির্দিষ্ট করে জানি না, তবে মনে হয়–মানুষ অন্তত এই বার্তাটুকু পায় যে আক্রান্ত ব্যক্তির আশেপাশের সবার কাছ থেকে আরো মানবিক আচরণ প্রাপ্য ছিল। এই ঘটনাগুলো জেনে মানুষ হয়ত ভাববে, “আমি থাকলে এরকম করতাম না। মানবিক হতাম।”
মানসিক রোগ যে চিকিৎসায় ভালো হয় তার প্রমাণ আমার পরিবার এবং আমার দেখা আরো অনেক পরিবার। ‘বিউটিফুল মাইন্ড’ সিনেমাটা যারা দেখেছেন তারা সম্ভবত দেখেছেন মুভির নায়ক জন ন্যাশ মানসিক রোগে আক্রান্ত থাকে, এবং যোগ্য সহচার্য এবং চিকিৎসার ফলে তিনি তাঁর গবেষণা চালিয়ে যেতে সক্ষম হন এবং শেষ পর্যন্ত অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পান।
তবে মানসিক রোগীদের চিকিৎসা দেয়া খুব সহজ নয়, বিশেষ করে আমাদের দেশে তা খুব কঠিন। কঠিন দুটি কারণে-
১। মানসিক রোগী নিজে নিজেকে রোগী মনে করে না, ফলে তাদেরকে স্বাভাবিকভাবে চিকিৎসার আওতায় রাখা কঠিন হয়;
২। আমাদের দেশের সরকারিভাবে মানসিক রোগের চিকিৎসা অপ্রতুল এবং অনেকক্ষেত্রে যথাযথ নয় বলে মনে হয়। বেসরকারিভাবেও সঠিক চিকিৎসা নেই, অনেক ক্ষেত্রে তা খুব ব্যয়বহুল।
এরচেয়ে বড় কথা, মানসিক রোগীর দায়িত্ব নেয়া লাগে শতভাগ, অর্থাৎ পরিবারে যদি দায়িত্ব নেয়ার মত সামার্থবান এবং যথেষ্ট উদার মানসিকতার কেউ না থাকে তাহলে যে কোনো মানসিক রোগী এক সময় গৃহহারা হবে। গৃহহারা হলে কী হয় সেটি আমরা পথেঘাটে দেখে থাকি। প্রশ্ন হচ্ছে, গৃহহারা মানসিক রোগীদের দায়িত্ব কে নেবে? রাষ্ট্রের এক্ষেত্রে দায়িত্ব নেয়া উচিৎ নয় কি? আধুনিক রাষ্ট্রগুলো কিন্তু দায়িত্ব নেয়। জার্মানির নাম এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে আসে। আমাদের রাষ্ট্রও সাংবিধানিকভাবে দায়িত্ব নিতে অঙ্গিকারাবদ্ধ।
জনকণ্ঠ পত্রিকার একটি খবর বলছে- দেশে ১৬ ভাগ মানুষ কোনো না কোনোভাবে মানসিক রোগী, কিন্তু বিপরীতে ডাক্তার রয়েছে মাত্র ১৯৫ জন। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে মানসিক রোগের চিকিৎসার জন্য অবকাঠামো এবং বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নেই।
আরেকটি বিষয় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যা উঠে এসেছে–মানসিকভাবে অসুস্থদের মধ্যে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি। অনেক দেশের সুস্পষ্ট পরিসংখ্যান রয়েছে–সে দেশে কতজন স্বীকৃত মানসিক রোগী রয়েছে। ইউরোপে মানসিক রোগের পরিসংখ্যান বিস্তৃত। কোন ধরনের মানসিক রোগে কত শতাংশ মানুষ আক্রান্ত তাও জানা যাচ্ছে। ২০১২-২০১৩ সালের একটি স্বাস্থ্য জরিপে নিউজিল্যান্ড তাদের দেশের ১৬% মানুষের মধ্যে মানসিক ভারসাম্যহীনতা পেয়েছে, যেটি আমাদের দেশের সাথে মিল রয়েছে। সেখানেও নারীদের সংখ্যা বেশি।
একটি অপরাধবোধের কথা বলে লেখাটা শেষ করি। বোধটা এরকম হচ্ছে, কারণ, আমিও এতদিন আমার পরিবারের মানসিক রোগের কথা লুকাতে বাধ্য হয়েছি, ইচ্ছুক হয়েছি। পশ্চিমবঙ্গের ঐ ঘটনাটির প্রেক্ষিতে মনে হল, আমিতো তাদের দায়িত্ব নিয়েছি, তারপরেও লুকাতে চাই মানে আমি নিজেও মানসিক রোগটিকে রোগ হিসেবে তুলে ধরার যুদ্ধটি করতে চাচ্ছি না, তাহলে শিক্ষায়-সক্ষমতায় আরো সামার্থহীন যারা তারা প্রকাশ করবে কীভাবে? তাদের সামনে তো অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।
আমার মনে হয়, রোগটি নিয়ে বেশি বেশি আলোচনা হতে হবে, পরিবারে মানসিক রোগী থাকলে নির্দিধায় সেটি অন্যকে বলতে হবে, মানসিক রোগী রয়েছে এরকম পরিবারগুলোর মধ্যে আন্তঃযোগাযোগ বাড়াতে হবে। মানসিক রোগীদের সাথে কেমন আচরণ করা উচিৎ সেটি জানাতে গণমাধ্যমগুলোকে আরো সোচ্চার হতে হবে। রাষ্ট্রকে তাগিদ দিতে হবে যাতে মানসিক রোগের চিকিৎসা সহজলভ্য হয়, এবং সরকারি মানসিক হাসপাতালগুলোকে বাণিজ্য এবং দুর্নীতির কবল থেকে বের করে আনতে সচেষ্ট হয়।
সর্বোপরি আমরা যেন মনে রাখি–মানসিক রোগ অন্য অনেক রোগের মত একটি রোগ, পার্থক্য হচ্ছে, এই রোগটি দৃশ্যমান নয় একেবারে, যেহেতু রোগীর আচরণই মূলত মানসিক রোগের প্রধান নির্ণায়ক, তাই অনেক ক্ষেত্রে ভুল বোঝাবুঝি হয়। আসল কথা হচ্ছে, মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা, শুধু মানুষের প্রতি নয়, সার্বজনীন ও সামাজিকভাবে দৃষ্টিভঙ্গী মানবিক না হলে শুধু মানসিক রোগী কেন কারো প্রতিই মানবিক হওয়া যায় না।
ওতেরা বিবির (সেকেন্দ্রা গ্রামে আক্রান্ত নারী) ঘটনার প্রেক্ষিতে আমার বারবার শুধু মনে হচ্ছে, ঘটনাটি আমার মায়ের সাথেও তো ঘটতে পারত। অথচ আমি জানি, আমার মা কতটা সহৃদয় মানুষ! আমি আমার চারপাশের মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞ, এবং বিশ্বাস করি তারা কখনো এরকম ঘটনার জন্ম দেবে না। পরিশেষে সবাইকে মানবিক হওয়ার আহ্বান জানাই। সত্যি বলতে, সহৃদয় থাকার চেয়ে এই জীবনে বড় কিছু তো আর নেই।