বর্তমান সময়ে চলতি নারীবাদের অন্যতম একজন সমালোচক হচ্ছেন লন্ডনের কিংস কলেজের অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ এবং নারীঅধিকারকর্মী এলিসন ওলফ (জন্ম: ১৯৪৯)। এক সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পলিসি এনালিস্ট হিসেবে কাজ করেছেন।
বিষয়ে ওপর ব্রিটেনের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্যা গার্ডিয়ানে তিনি একটি কলাম লেখেন। লেখাটির শিরোনাম ছিল—
“এই নারীবাদ এখন শুধু নিজেদের অভিজাত এবং শহুরে জীবনের প্রতি নিমগ্ন থাকে”
প্রায় একই বক্তব্যে তিনি বিবিসি রেডিওতে একটি সাক্ষাৎকার প্রদান করেছিলেন।
২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে বিবিসি রেডিওর সাথে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন,
“এই নারীবাদ বেশিরভাগ নারীদের জন্য কিছুই করছে না আসলে।”
অর্থাৎ প্রতিকী অর্থে কিছু নারী বিশেষভাবে সুযোগ সুবোধ পাচ্ছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নারীমুক্তি ঘটছে না।
তিনি বলেন, “সামনে নির্বাচন, এখন খুব আলোচনা হবে, নারীরা কী চায়, কী তাদের জন্য ভালো— এসব বিষয়ে। সময় এসেছে এসব বন্ধ করার। এগুলো অনেক পুরাতন হয়ে গেছে। নারীদের জীবন এখন আর ছকে বাধা নয়, “‘ভালো বিবাহের’ মধ্যে তাদের জীবন আর সীমাবদ্ধ নেই। বিপরীতে নারীরা এখন পুরুষের মতোই বহুমাত্রিক জীবনযাপন করছে।”
তিনি নারীদের ঐতিহাসিক অগ্রগতির কথা বলেছেন, একইসাথে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন— নারীদের মধ্যে আয় বৈষম্য পুরুষদের মধ্যের আয় বৈষম্যের চেয়ে এখন বেশি।
তিনি বলেছেন, “বর্তমানে আমরা অনেক বেশি গৃহকর্মী এবং পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োজিত করি। শিশুপালনকারী, দ্বাররক্ষক থেকে শুরু করে নানানকাজে অসংখ্যা নারী এখন যুক্ত হচ্ছে, বিশেষ করে চিরাচরিত ঘরের কাজগুলোতে। এসবক্ষেত্রে কাজ করা কর্মীরা বেশিরভাগ নারী, কিন্তু তারা খুব সামান্য বেতন পায়। এদের ছাড়া স্বামী-স্ত্রী একইসাথে দু’জন কেরিয়ার গড়তে পারত না, চাকরি করতে পারত না।”
তিনি উল্লেখ করেছেন, “বর্তমানে নারী শ্রমিকরা একটি এলিট পেশাজীবী নারী সমাজের জন্যই কাজ করে, পুরুষের মতো যাদের (এলিট পেশাজীবী) কাজের মূল ঝোঁক থাকে ব্যক্তিগত পরিচিতির দিকে।”
এলিসন বলেছেন, “নারীদের মধ্যে এখন জীবনযাপন, আগ্রহ এবং আচরণে বিশেষভাবে ব্যবধান রয়েছে।” উনি বলতে চেয়েছেন, এই ব্যবধানটা তৈরি হয়েছে উপার্জনের বৈষম্য এবং দৃষ্টিভঙ্গির কারণে।
এলিসনের বক্তব্যের সারবস্তু হচ্ছে— নারীবাদের কথা বলে সকল নারীকে একই প্যারাডিম (দৃষ্টি) দিয়ে বিচার করার সুযোগ আর নেই।
এলিসনের বক্তব্যের বটম লাইন দাঁড়ায়— নারীবাদ এখন অভিজাততন্ত্রের সমার্থক হয়ে গেছে। সাক্ষাৎকারের শেষে এসে তিনি বলেছেন,
“সিস্টারহুড বলে এখন আর কিছু নেই। একজন নারীর সাথে আরেকজন নারীর জীবনযাপনপদ্ধতি এবং আগ্রহের এখন আর মিল নেই। নীতিনির্ধারণকারীদের এখন তাকাতে হবে নারী শ্রমিকদের দিকে, শীর্ষে অবস্থান করা নারীদের দিকে নয়।”
গার্ডিয়ানের লেখাটিতে শুরুতে এলিসন বলেছেন, “নারীবাদ সবসময় উচ্চ শিক্ষিত এবং সুবিধাপ্রাপ্তদের দ্বারা পরিচালিত হয়ে এসেছে, কিন্তু এখন সেটি শহুরে অভিজাতবাদে রূপ নিয়েছে।” তিনি বিষয়টিকে হতাশাজনক বলেছেন।
তিনি বলেছেন, “সুবিধাপ্রাপ্ত পুরুষের জায়গায় সুবিধাপ্রাপ্ত নারী বসালে তাতে কিছুমাত্র বৈষ্যম্য কমবে বলে মনে হয় না।”
বিষয়টা অনেকটা এরকম, জরিনার জায়গায় সখিনা নির্যাতিত হচ্ছে এবং সেটি হচ্ছে আরো বাজেভাবে। আগে নারীরা গৃহে শোষীত হত, এখন তারা গৃহে এবং বিভিন্ন পেশায় শোষীত হচ্ছে, নির্যাতিত হচ্ছে, অবমাননার শিকার হচ্ছে।
উচ্চ শিক্ষিত কিছু নারী হয়ত বাইরে কোনো বেশি লাভজনক পেশায় নিয়োজিত হয়েছে, বা ধনীর স্ত্রী বা কন্যা ‘আরামদায়ক অলসজীবন’ বেছে নিয়েছে, কিন্তু তার জায়গায় ঠিকই আরেকজন নারী একইকাজ করছে এবং ঐ গৃহে পদমর্যাদাহীন কর্মচারী ব্যতীত আর কোনো স্ট্যাটাস তার না থাকায় সেটি তাকে করতে হচ্ছে অধিক কষ্ট মেনে নিয়ে।
সুস্পষ্টভাবে, চর্চিত নারীবাদ একটি এলিট শ্রেণি তৈরি এবং তা জিইয়ে রাখতেই বেশি কাজে লেগেছে। সেখানে এতটুকু মাত্র হয়েছে যে, সমাজের এলিট শ্রেণিতে সামান্য কিছু নারী এলিটদেরও অন্তর্ভুক্তি ঘটেছে এবং অনেক উচ্চশিক্ষিত নারী মূলত নারী আন্দোলনের নামে সেই অন্তর্ভুক্তির জন্য লড়াই করছে। এভাবে চেতন বা অবচেতন কৌশলে নারীমুক্তি আন্দোলনের সামগ্রিক দিকটা স্থিমিত করে ফেলা সম্ভব হয়েছে।
যেহেতু এলিট লিস্টটা সবসময় খুব ছোট থাকে, তাই ‘সে আন্দোলনে’ পিছিয়ে পড়ে অনেক নারী পুরুষতন্ত্রকে গালি দিলেও সেটি আসলে ব্যক্তিগত আকাঙ্খাটি অপূর্ণ থাকার বেদনা, সমগ্র নারীসমাজের হতাশার জায়গা থেকে নয়।
নারীবাদ কীভাবে “অভিজাতবাদ এবং সুবিধাবাদে” রূপ নিয়েছে সেটি পশ্চিমা সমাজের এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি আলোচ্য বিষয়। নারী সমাজের বিদগ্ধ এবং সচেতন পণ্ডিতরাই বিষয়টি নিয়ে এখন বেশি সোচ্চার।
বিদ্র: পুরো লেখাটি সরাসরি অনুবাদ করা হয়নি। এলিসন ওলফের লেখাটির ওপর আলোচনা তুলে ধরেছেন ফলোআপনিউজ.কম ’র সম্পাদক। মূল লেখাটির লিংক অন্তর্ভুক্ত করা আছে। এলিসন ওলফ-এর বায়োগ্রাফি লিংকে গিয়ে দেখে নিতে পারেন।