প্রথম কিস্তি
সবাই বিস্মিত হল। বিস্মিত হওয়ার কথাই। আমি স্টার মার্কস পেয়ে পাশ করেছি। সপ্তাহ খানেক বেশ ফুরফুরে মেজাজে কাটালাম। ঐ বয়সে প্রশংসায় বানভাসি হওয়ার মজাই আলাদা। মামবাড়ি থাকতাম, ফলে পরবর্তী পড়াশুনার কথা উঠতেই মামা রা বিভিন্ন মতামত দিলেন। অবশেষে ভর্তি হয়েছিলাম বাগেরহাট সরকারি পি.সি. কলেজে। পি.সি. কলেজ একটি এতিহ্যবাহী কলেজ। এক সময় খুলনা অঞ্চলের সেরা কলেজ। সে জৌলুস আর না থাকলেও বাগের জেলার সেরা। রামকৃষ্ণ মিশনে উঠলাম। পড়াশুনার জন্য থাকার জায়গা হিসেবে রামকৃষ্ণ মিশন অসাধারণ তবে তুলনামূলকভাবে খরচ কম নয়। ভেবেছিলাম, যেহেতু রেজাল্ট প্রত্যাশার চেয়ে ভাল হয়েছে তাই পড়াশুনার চালিয়ে যাওয়ার মত টাকা পাওয়া যাবে। দুই মাস যেতে না যেতেই বুঝলাম ঝড়ের সময় যে আমগুলো পড়ার কথা ছিল ঝড় থেমে গেলে সেগুলো না পড়াটাই সংগত। আমিও শহুরে হাওয়ায় গা ভাসালাম। পড়াশুনা করি না, পিছনে বসে ক্লাস করি, তবে কিছু বুঝি না। এক সময় ক্লাস করাও বাদ দিলাম। মাঝে মাঝে ক্লাসে যাই। সিটা ভাড়া বাকি পড়ছে, খাওয়াটা বাকি ফেলে ফেলে কোনমতে চালিয়ে যেতে পারলাম। ম্যানেজার হয়ে চালের দোকানে বাকি পড়ল ছয় হাজার টাকা, ঐ দিয়ে চলেছিলাম তিন মাস। চালের দোকানের ঐ টাকা শোধ করেছিলাম তিন বছর পর। মিশনের সিটভাড়া এখনো কিছু পাবে। এক বছর এভাবে কাটানোর পর বুঝেছিলাম যে, কিছুই হচ্ছে না। এভাবে আর না। কোনমতে দ্বিতীয় বর্ষে উঠে মিশন ছেড়ে দিয়ে বাড়ি চলে আসলাম। বাড়ি চলে আসলাম মানে মামা বাড়ি চলে আসলাম। খুব কষ্ট হয়েছিল ফিরতে। বাড়ি ফিরতে এত কষ্ট হত কিনা জানি না। কিছুদিন চোরের মত কাটালাম। চারপাশ থেকে আওয়াজ উঠল- তাহলে ও কি নকল করে ভাল রেজাল্ট করেছিল। সমস্যা অনুধাবন করার মানুষ চারপাশে খুব কমই থাকে, উল্লাস করার লোকের অভাব হয় না, মশকারা করার লোক আরো বেশি। তখন বাস্তবতা বুঝতাম, তাই দুঃখবোধ ছিল বেশি। মামা বাড়িতে থেকেও পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তা চেয়াল টেবিল ওপাশ এপাশ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। আসলে এইস,এস.সি সায়েন্স একা একা পড়া সম্ভব ছিল না। একেবারে দিগ্বিদিক অবস্থা হয়েছিল তখন। টেস্ট পরীক্ষা দেওয়ার সময় আসল। পরীক্ষা দিলাম। মূল পরীক্ষার জন্য টাকা জমা দিলাম। টাকাটা দিদিমা দিয়েছিল। তিনটা পরীক্ষা দিয়ে আর দিলাম না। দিয়ে লাভ হত না। ফেল হয়ত করতাম না। তবে পরীক্ষা না দেওয়ার সিদ্ধান্তটা ছিল সাহসী একটি সিদ্ধান্ত। এবার আর বাড়ি দাঁড়ানোর উপায় ছিল না আমার। এমনিতেই পুরো পরিবার মামাদের বাড়িতে বোঝা হয়ে আছি, তার উপর হাজার দুই টাকা নষ্ট করলাম পরীক্ষা দেওয়ার নাম করে, এটা কেউ মানবে কেন? প্রতিবেশীর তাচ্ছিল্ল করার প্রয়োজটুকুও আর থাকল না। মানুষ যখন কারো পরাজয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে যায় তখন তার সম্পর্কে আর মাথা ঘামাতে চায় না। আমি পালাবার পথ খুঁজতে থাকলাম। – চলবে