স্বাধীনতার পর বহু বছর পার হলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার খুব কম সময়ই ক্ষমতায় ছিলো, ’৭৫-এর পর থেকে অধিকাংশ সময় ঘুরেফিরে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিই ক্ষমতায় আরোহণ করেছে। তারা তাদের মতো করে ইতিহাস সাজিয়েছে, সত্য আড়াল করেছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ মানে শুধু সম্মুখ যুদ্ধ নয়, মুক্তিযুদ্ধ মানে শুধু বিজয়ের ইতিহাস নয়, বরং মুক্তিযুদ্ধের বহুমাত্রিক দিক রয়েছে, তার মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং যন্ত্রণাদায়ক একটি দিক হচ্ছে গণহত্যা।
গণহত্যা নিয়ে এ যাবৎ খুব কমই আলোচিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা সংগঠিত হয়েছিল বাংলাদেশব্যাপী। হত্যাকাণ্ডগুলো এতটাই বর্বোরোচিত যে তা পৃথিবীর যেকোনো হত্যাকাণ্ডকে নৃশংতার দিক থেকে হার মানায়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংগঠিত গণহত্যার বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে— এটি সংগঠিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রাক্কালে, এবং মুক্তযুদ্ধকালীন। অর্থাৎ নিরীহ, নিষ্ক্রিয় মানুষের উপর হঠাৎ আক্রমণ ছিলো এই গণহত্যাগুলো। মুক্তিযুদ্ধের সময় সংগঠিত প্রতিটি গণহত্যা সংগঠিত হয়েছিলো বাঙালি সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী জাতিগোষ্ঠীকে, বিশেষ করে হিন্দু জাতিগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার অভিপ্রায় থেকে।
এ বিষয়টি ‘৭১-এর গণহত্যা নিয়ে সকল গবেষকদের লেখায় উঠে এসেছে যে, গণহত্যাগুলো সংগঠিত করা হয়েছিলো প্রধানত ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য, তাদেরকে আতঙ্কিত করে দেশ ছাড়া করার জন্য, তাদের সম্পদ লুটে নেওয়ার জন্য। পাশাপাশি যে কোনো মুক্তিকামী মানুষ, যারা তখন জয় বাংলার লোক হিসেবে পরিচিত, তাদেরকেও হত্যা করা হয়েছিলো।
হত্যাকারীদের (পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসর) উদ্দেশ্য ছিলো, পুরুষদের মেরে ফেলা, নারীদের ধর্ষণ করা। যখন প্রতিরোধ করার মতো আর কেউ থাকবে না, ফলে অন্যরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হবে, এভাবে তাদের সম্পদ-সম্পতি দখল করা সম্ভব হবে। বাস্তবে হয়েওছিলো তাই।
মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন না হলে তারা গণহত্যার মাধ্যমে তাদের লক্ষ্যের দিকে ভালোভাবেই অগ্রসর হচ্ছিলো। বলা যায়, যেটি পৃথিবীতে বিরলতম ঘটনা। আচমকা গণহত্যা ঘটিয়ে একটি জাতিগোষ্ঠীকে তাড়িয়ে দিয়ে ক্ষমতা এবং ভূখণ্ড দখল করার চেষ্টার ইতিহাস পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি আর নেই।
সর্বস্ব হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ এবং স্বজন হারানো বেশিরভাগ পরিবার কখনোই আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। তাদের বেছে নিতে হয়েছে নিভৃত নিরুত্তাপ জীবন। বিস্ময়করভাবে এক ধরনের গ্লানি নিয়ে তাদের বাঁচতে হচ্ছে, দীর্ঘদিন বিচারহীনভাবে স্বজন হারানোর বেদনা বয়ে বেড়ানোয় তাদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে তৈরি হয়েছে নিষ্পৃহতা, নিষ্ক্রিয়তা। অথচ মাথা উঁচু করে স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের বাঁচার কথা ছিলো। রাষ্ট্রযন্ত্র তাদের সে সুযোগ তৈরি করে দিতে পারেনি, রাষ্ট্র তাদের আশ্বস্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে এ যাবৎ।
বিভিন্ন সময়ে অনেকে শহীদ পরিবারগুলোকে অহেতুক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, কখনো তাদেরকে ভুলভাবে বিভিন্ন ফোরামে তুলে ধরা হয়েছে ব্যক্তিস্বার্থে। তারা কখনো সাহায্য চায়নি কারো কাছে, কিন্তু গণহত্যার বিষয়টি রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত না হওয়ার বিষয়টি তারা মেনে নিতে পারে না। শহীদের স্বজনরা চায়, গণহত্যাকাণ্ডের বিচার হোক, গণহত্যার শিকার শহীদদের স্বীকৃতি দেওয়া হোক।
ভাবলে অবাক হতে হয়, লক্ষ লক্ষ মানুষ মেরে ফেলা হলো নির্বিচারে, নৃশংসভাবে, কিন্তু উত্তর প্রজন্ম সেটি জানে না, তাদের জানানোর ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয়ভাবে এতদিন ছিলো না! ২০১৪ সালে খুলনায় গণহত্যা জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সে সুযোগটি এখন কিছুটা তৈরি হয়েছে। কত অজানা গণহত্যা যে রয়েছে এই বাংলায়, স্বাধীন বাংলার মাটিতে!
কিছুদিন আগে একটি শহীদ পরিবারের সাথে কথা বলতে গিয়ে বিরল দুটি গণহত্যার সন্ধান পেলাম। এর মধ্যে একটি সংগঠিত হয়েছিল সিরাজদিখানের রসুইনা গ্রামে, ওখানে রামকৃষ্ণ দাসের বড়িতে তাকে সহ বাড়িতে আশ্রিত চৌদ্দজনকে হত্যা করা হয়েছিল। আরেকটি সংগঠিত হয়েছিল চলতি পথে লঞ্চের মধ্যে, কুমিল্লার কাছাকাছি কোনো একটি জায়গায়, জায়গাটির নাম সাক্ষাৎকার প্রদানকারী বিস্মৃত হয়েছেন। লঞ্চটিতে থাকা নারী এবং শিশুদের নামিয়ে দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের দোসররা কিছু দূরে লঞ্চটি নিয়ে গিয়ে গুলি করে সবাইকে হত্যা করে। এরকম অজানা হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা শত শত নয়, হাজার হাজার হবে।
যদি পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রে এখন এরকম একটি হত্যাকাণ্ডও ঘটে, মাত্র দশ জন মানুষকেও যদি ঘর থেকে ধরে নিয়ে একটি পুলের উপর দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরে ফেলা হয়, তাহলে পুরো বিশ্ব কেঁপে উঠবে না? পৃথিবীর সমস্ত দেশের পত্রিকার শিরোনাম হবে ঘটনাটি, হবে না? অথচ এরকম ঘটনা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে ঘটেছে কয়েক হাজার, কিন্তু বিশ্ববাসী তা জানে না, জানে কি? তাদের জানানো হয়েছে কি? আমরাও কি সকলে জানি, জানতে চাই?
গণহত্যায় শহীদ পরিবারগুলোর কথা উঠে আসেনি সঠিকভাবে ইতিহাসের পাতায়, ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলো বিশেষ কোনো সহযোগিতা সরকারের নিকট থেকে কখনো পায়নি বলে আমরা জেনেছি। একটি পরিবারের পিতা-পুত্র বা দুই ভাইকে হত্যা করা হলে পরিবারটি কী ধরনের মর্মযাতনা এবং সীমাহীন আর্থিক কষ্টের মধ্যে নিপতিত হয় তা সহজেই অনুমেয়।
তার ওপর পরিবারগুলোকে তাৎক্ষণিক পালিয়ে যেতে হয়েছিল, তারা কোনো মৃতদেহের সন্ধান করতেও পেরেছিল না। কেউ পালিয়েছিলো বাড়ি ছেড়ে নিকটবর্তী কোথাও, অনেকে ভারতে গিয়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলো। যাবার পথেও হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলো, আহত হয়েছিলো অনেকে।
ফিরে এসে তারা শুধু ঘরটি পেয়েছিলো। পাহাড় সমান কষ্ট বুকে চেপে আবার তারা ঘর গুছিয়ে জীবনধারণ করে আসছে গত ছিচল্লিশ বছর ধরে, কিন্তু ভুলতে পারেনি তারা পিতা, স্বামী, পুত্র বা কন্যা হারানোর বেদনা। এখনো তারা কেঁদে ফেরে, তারা কৈফিয়ত চায়, কিন্তু তারা জানে না কার কাছে তারা কৈফিয়ত চাইবে।
তারা না জানলেও আমাদের জানতে হবে। আমাদেরই দিতে হবে জবাব, যারা স্বাধীন এ দেশটাকে নতুন করে গড়ব বলে শপথ নিয়েছি। দেশ গড়তে হলে, ধর্মনিরপেক্ষ-অসাম্প্রদায়িক-মানবিক একটি দেশ পেতে হলে আমাদের শেকড়ের সন্ধান করতে হবে। আমাদের শেকড় মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে, মুক্তিযুদ্ধে প্রতিটি আত্মত্যাগের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে আমাদের সামনে এগোতে হবে। অন্যথায় আমরা একটি অর্বাচীন, ভুঁইফোড় জাতিতে পরিণত হব।
গণহত্যার মতো এরকম ভয়াবহ, হৃদায়বিদারক একটি বিষয় এতদিন অবহেলিত থাকল, এটা ভাবা যায় না! বিষয়টি অনুভব করার মতো একটি সচেতন প্রজন্ম গত পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশ পেলো না, এটা ভাবতে কষ্ট লাগে। কোনো সরকারই ১৯৭১ সালে সংগঠিত গণহত্যা নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কাজ করেনি, বিষয়টি লজ্জাজনক। আসলে সত্য কোনো না কোনোভাবে কারো না কারো মাধ্যমে একদিন প্রতিষ্ঠিত হয়ই, তা একটু দেরিতে হলেও। সত্য প্রতিষ্ঠার সেই মহান কাজে তরুণ প্রজন্মের অনেকেই এখন অংশগ্রহণ করছে, করা উচিৎ।