কথা হচ্ছিল প্রাগৈতিহাসিক যুগের এক লেখকের সাথে, যাকে আপনারা মানেন, কিন্তু তাকে জানেন না। আমি গিয়েছিলাম মিগরার নামক দেশটিতে। প্রায় ৩৫০০ বছর আগে আমি সেখানে গিয়েছিলাম।
দেশটি এত ভালো লেগেছিল যে, এরপর থেকে প্রায়ই যেতাম। সিনভেঘ নামে ঐ লেখকের বাড়িতে আড্ডা দিতাম। ওনাকে তখন ঐ অঞ্চলের সবাই গুরু মানত। তবে ওনার মনে একটা দুঃখ ছিল। উনি চাইছিলেন আমি যেন গোপনে ওনার সাথে কিছুদিন কাটাই। আমি মাঝে মাঝে লম্বা সময় থাকতে রাজি হয়েছিলাম।
প্রতিদিনই উনি আমার সাথে কথা বলতেন। বলতেন, “এখন আর আমার হাতে কিছু নেই, যে পথে আমি মানুষকে মানুষ করতে চেয়েছিলাম, সেটি বুমেরাং হয়েছে। আমি বুঝতে পারছি সবকিছু উলোট পালোট হতে যাচ্ছে।”
উনি আমাকে খুলে বলতে চাইলেন। বুঝাতে চাইলেন আমি যেন বার্তাটা পৃথিবীর মানুষের কাছে পৌঁছে দিই।
উনি বললেন—
আমি বর্বর মানুষকে মানুষ করতে চেয়েছিলাম। যেহেতু আমাকে সবাই মানে, রাজা-প্রজা সবাই মানে, তাই আমি এমন কিছু বলতে চেয়েছিলাম যাতে মানুষ সভ্যতার দিকে অগ্রসর হতে পারে।
আমি তখন তোমার বয়সেই ছিলাম। এখন থেকে ৩০ বছর আগে আমি মানুষকে এ ‘মন্ত্র’ দিয়েছিলাম। মানুষকে পাপ পূণ্যের কথা বলেছিলাম, স্বর্গ-নরকের কথা বলেছিলাম। তাতে প্রথম প্রথম ভালোই কাজ হয়েছিল। দলে দলে মানুষ আমার কাছে আসতে শুরু করল। আমাকে বানিয়ে বানিয়ে অনেক কথা বলতে হতো।
কাকে কী বলতাম সবসময় মনেও থাকত না। কিন্তু ওরা আমার বলা সব কথা মুখস্থ করে ফেলত। ওরা নিজেদের মধ্যে রক্তরক্তি বাধিয়ে দিত আমার বক্তব্যের সত্যতা নিয়ে। দুই দলই আমার কাছে আসত প্রমাণ করতে। আমি দুটোই খারিজ করে দিয়ে আবার নতুন কথা বলতাম।
এরপর মানুষের মধ্যে বড় পরিবর্তন চলে আসল। মানুষ খুব ভয় পেয়ে গেল। পাপের ভয়ে মানুষ খুব নির্জীব হয়ে যেতে থাকল। মানুষের মধ্য থেকে স্বাভাবিকতা হারিয়ে গেল।
সবকিছুকে তারা পাপ পূণ্য দিয়ে বিচার করতে শুরু করল, এবং একে অপরের সাথে বিতর্কে মেতে উঠতে থাকল। প্রতিদিন বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খুনের খবর আসতে থাকল।
আমার কথার ব্যত্যয় হলেই ওরা খুন করত। অথচ আমি তো নানান জনকে নানান কিছু বলেছি। আমিও তো আর মনে করতে পারব না কাকে কী বলেছিলাম।
কিন্তু ওরা যার যার মুখস্থ করে রেখেছে আমার সব কথা। কোনো কোনো দল ছোট ছোট বইও বের করেছে। দশ বছর একটা ঝঞ্জাময় সময় কেটেছে মিগরারে। তখন এখানে সবে কেবল একটা সমাজ কাঠামো দাঁড়াতে শুরু করেছে, বলার মতো দক্ষ কোনো সমাজপতি বা ওভাবে কোনো রাজাও ছিল না।
যে যার জোরে চলত। তখন আমিই হয়ে উঠলাম মূল ত্রাতা। দেশের অঘোষিত প্রধান আমি। দেশ বলতে যত দূর পর্যন্ত ওরা আমার বার্তা নিয়ে যেতে পারত ততদূর পর্যন্ত আমিই প্রধান হয়ে উঠতাম।
আমি অনুভব করলাম, শুধু স্বর্গ-নরক তত্ত্ব দিয়ে মানুষকে পথে রাখা যাচ্ছে না। মানুষ হতাশ-অবসন্ন হয়ে যাচ্ছে, কোনোকিছু আর চলছে না। এরপর পাপ মোচনের কথা বললাম।
বললাম, পাপ থেকে নিষ্কৃতি লাভেরও উপায় আছে। তারপরেও সবকিছু এলোমেলো হয়ে যেতে থাকল। খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম। মনে হল, মানুষকে বিধিবদ্ধ কোনো উপায় বাতলে দিতে হবে, যাতে তারা সুস্থির হতে পারে।
ভাবলাম, নিজের নামে আর নয়, সবকিছু অলৌকিক আখ্যা দিতে হবে। আমি কোথা থেকে কীভাবে কী জানছি তা মানুষকে জানাতে হবে। আমার একটা বিরোধীপক্ষও তলে তলে গড়ে উঠছিল। তারা চাইছিল আমি যেন এভাবে সরাসরি কোনো সমাধান না দিই।
তাদের বক্তব্য ছিল, “এভাবে সরাসরি মনগড়া সামধান দিলে মানুষের অগ্রগতি থমকে যাবে।” আমার বিরোধিতা করার জন্য একটি সংগঠন বেশ প্রকাশ্যে চলে এল।
কিন্তু তাদের কথা ধোপে টিকল না, গণজোয়ার তখন এমন পর্যায়ে যে, এরকম একশো জন দার্শনিককে আমার বিরোধিতা করার জন্য হত্যা করা হল।
এ হত্যকাণ্ডে আমায় সায় ছিল না, কিন্তু জনগণকে থামতে বলার মতো সাহসও আমার ছিল না। আমি সবকিছু সামাল দিতে চাচ্ছিলাম, শেষ করতে চাচ্ছিলাম। সকল বক্তব্য এক জায়গায় এনে মানুষের জন্য একটা জীবনপ্রণালী তৈরি করে দিতে চাইছিলাম।
মূলত একটি সংঘাত থেকে আমার এ সিদ্ধান্ত— দেশের দার্শনিক, বিজ্ঞানী, লেখক সমাজের সাথে আমাদের, আমরা যারা রাজনীতি করি তাদের একটা বিরোধ হয়। অবশ্য রাজনীতির বাইরেও আমার তখন তাত্ত্বিক এবং লেখক হিসেবে খ্যাতি ছিল, ঐসব দার্শনিক, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানীরা আমার খ্যাতি সহ্য করতে পারতো না। তোমাকে সত্য কথা বলছি, আমি মানুষের মন্দ চাইতাম না। এটা সত্য যে, আমি চাচ্ছিলাম— মানুষ আমাকে মানুক, আমি সবাইকে ছাড়িয়ে যেতে চেয়েছিলাম। সৃষ্টি তত্ত্ব, ঈশ্বর —এসব নিয়ে আমারও কোনো স্পষ্ট বিশ্বাস বা বিশ্লেষণ ছিল না। আমি শুধু জনগণের মতিগতির প্রতি খেয়াল করছিলাম, তাদের পছন্দগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে উপায় বাতলাতাম। এভাবেই আমি অলিখিতভাবে বিশাল এক অঞ্চলের হর্তাকর্তা হয়ে উঠতে থাকলাম।
সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে মানুষের প্রচলিত ধারণার বাইরে তারা (তখনকার সময়ের প্রতিষ্ঠিত কবি সাহিত্যিক বিজ্ঞানীরা) কথা বলতে শুরু করে। এটা মানতে পারে না জনগণ। তখন এ অঞ্চলে অনেক দেবতা— এক একটা অঞ্চলের মানুষ এক একটা দেবতার পূজো করে। দেবতাদের উছিলায় নানান অপকর্ম এবং নিষ্ঠুরতা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আমি চাচ্ছিলাম এসব থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে। আমি বর্তমান সময়ের জন্য একটা সমাধান খুঁজছিলাম।
আমি দেখলাম, আমার কথাও মানুষ বেশিদিন মানবে না। এখনই অনেক মানুষ বলতে শুরু করেছে যে, আমি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কথা বলি। আমি ধরা পড়ে যেতে শুরু করলাম। তখন আমি চিন্তা করলাম, কিছুদিন নিজেকে আড়াল করতে হবে। দীর্ঘসময়ের জন্য আমি আড়ালে চলে গেলাম। কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিকদের মধ্যে একটা গ্রুপ ছিল, যারা আমার সাথে তাল মিলিয়ে চলত, তাদের নিয়ে আমি অন্তর্ধানে গেলাম। আসলে ধ্যান ট্যান কিছু নয়, আমি চেয়েছিলাম জনগণ যাতে আমার জন্য অপেক্ষা করে, আমার অভাব বোধ করে। তাছাড়া এই সময়ের মধ্যে আমি জনগণের জন্য লিখিতভাবে একটা জীবন প্রণালী রচনা করতে চেয়েছিলাম।
মোট ১১২ জন প্রাজ্ঞ লোক নিয়ে আমি অন্তর্ধানে গিয়েছিলাম। সবাইকে কাজ ভাগ করে দেওয়া হলো। আমরা বেশ কিছু পুঁথি সাথে নিয়েছিলাম, যেগুলো সমাজ সংস্কারমূলক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক গ্রন্থ। আমি আমার বিপক্ষ শিবির থেকেও লোক বাছাই করে নিয়েছিলাম। এভাবে অনেক দিনের পর্যালোচনার পর একটি গ্রন্থ রচনা সম্ভব হয়েছিল। এরপর খুব আড়ম্বর করে একদিন আমরা হাজির হই জনগণের মাঝে। ততদিনে অনেক জায়গার অনেক খবর আমরা পাইনি। সবদিকে ভীষণ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়ে গেছে। এখনো থেমে থেমে দাঙ্গা চলছে। নাস্তিক আখ্যা দিয়ে প্রায় সকল কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, দার্শনিকদের হত্যা করা হয়েছে। নারী নির্যাতন এবং নারী নিগ্রহ ভয়ানক পর্যায়ে পৌঁচেছে।
এসেই আমরা গ্রন্থখানি উন্মুক্ত করিনি। সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে গ্রন্থটিতে আরো কিছু কাঁটাছেড়া করা হয়। আস্তে আস্তে ছড়িয়ে দেওয়া হয় এ খবর চারিদিকে। ‘স্বপ্নে পাওয়া’ এ গ্রন্থ সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ বাড়তে থাকে, মানুষ খোঁজ খবর নিতে থাকে, বহু দূর দূরান্ত থেকে মানুষ আসতে থাকে মিগরারে। আমি যে গ্রামে থাকতাম, সেটি হয়ে ওঠে একটি তীর্থস্থান। মানুষের আগ্রহ এবং উত্তেজনা দেখে আমি বেশ ভয়ও পাচ্ছিলাম। ভেবে পাচ্ছিলাম না, কীভাবে গ্রন্থখানি উন্মুক্ত করব। কীভাবে মানুষ এ গ্রন্থখানি পড়বে এবং জীবনযাপনের কাজে লাগাবে!
আরো কয়েক বছর কেটে যায়, মানুষ উতলা হয়ে ওঠে। গত কয়েক বছর আমি বলতে গেলে লোকজনের সাথে মেলামেশা করিনি। আমি তখন মানুষের কাছে এক অনন্য উচ্চতায়। ভাবছিলাম, আমি তো যে কোনো সময় মারা যেতে পারি— আমাকে কেউ মেরে ফেলতে পারে। তাই এখনই গ্রন্থখানি উন্মুক্ত করে দেওয়া উচিৎ, আবার এটাও ভাবছিলাম, গ্রন্থটিতে যেভাবে যা আছে, সব যদি মানুষ আক্ষরিক অর্থে মানতে শুরু করে এরং অপরিবর্তনীয় ভাবে তাহলে তো উপকারের চেয়ে মানব জাতির ক্ষতিই বেশি হবে। তারপরও আমার কিছু করার ছিল না, এটি প্রকাশ না করে উপায় ছিল না।
আজ দেখতে পাচ্ছি— আমার আশঙ্কাই সত্য হয়েছে। মানুষ এটা আর পরিবর্তন করতে পারেনি, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। মাত্র বিশ বছর অতিবাহিত হয়েছে, আরো দীর্ঘ সময় যদি এভাবে অপরিবর্তনীয়ভাবে চলে তাহলে মানব জাতির সমূহ ক্ষতির সম্ভবনা আছে। কিন্তু আমার আর কিছু করার নেই। সবকিছু বেহাত হয়ে গেছে, জনগণ উন্মাদ হয়ে গেছে। জানি না দূর ভবিষ্যতে কী হতে যাচ্ছে! আমি দুঃখিত।
[অসমাপ্ত, বাকী অংশ এক সপ্তাহ পর]
শেকস্ রাসেল
লন্ডন, যুক্তরাজ্য