বিরল এক নায়কোচিত ভূমিকায় মা-ছেলেকে বাঁচিয়ে রেলে কাটা পড়ে প্রাণ হারালেন এক রেল শ্রমিক।
শুক্রবার দুপুর দেড়টার দিকে কুড়িল বিশ্বরোড এলাকার রেল ক্রসিংয়ে ঘটনাটি ঘটেছে।
নিহত শ্রমিকের নাম বাদল মিয়া (৫৮)। তিনি কুড়িল এলাকায় রেলের উন্নয়ন কাজে নিয়োজিত ছিলেন।
খিলক্ষেত থানার ডিউটি অফিসার দুর্ঘটনার বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, বাদলের লাশ উদ্ধার করেছে রেল পুলিশ।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুপুরে রেল লাইন অতিক্রম করার সময় চলন্ত ট্রেনে প্রায় কাটা পড়তে যাচ্ছিলেন এক মা ও তার শিশু সন্তান।
এ সময় রেল শ্রমিক বাদল দৌড়ে গিয়ে শিশুটির মাকে বাঁচান। তবে শিশুটিকে বাঁচাতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়েন বাদল। মারা যাওয়ার আগে অবশ্য শিশুটিকেও বাঁচিয়ে যান তিনি।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্নণা থেকে জানা যায়, ট্রেনটি খুব কাছে ছিলো। ক্রসিং এর উপর পথচারী দেখে প্রতিদিনের মতই ট্রেন চালক বার বার হুইসেল দিচ্ছিলেন। হুইসেল শুনে রেললাইনের ওপরে থাকা লোকজন লাইন থেকে সরে যাচ্ছিলেন। ঠিক মুহূর্তে একজন মা তার পাঁচ বছর বয়সী শিশুকে নিয়ে রেললাইন পার হচ্ছিলেন। আশেপাশের শব্দে অন্যমনস্ক থাকায় হয়তো তিনি ট্রেনের হুইসেল শুনতে পাননি। অবচেতন মনেই শিশুকে নিয়ে তিনি রেললাইন পার হচ্ছিলেন যখন ট্রেনটি একেবারে ক্রসিংয়ে এসে পড়ে। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ঘটনা! রেললাইনের উপরে শিশুকে নিয়ে ‘কিংকর্তব্যবিমুর’ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন ঐ মা। পাশেই রেললাইন মেরামতের কাজ করতে থাকা বাদল মিয়ার চোখে পড়ে বিষয়টি। মুহূর্তের মধ্যে দৌড়ে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেন মা ও শিশুকে। একটু দুরে ছিটকে পড়ে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পায় মা ও শিশুটি। উপস্থিত লোকজন চোখের পলক ফেলতেই ক্রসিং এর উপর দিয়ে চলে যায় দ্রুতগামী ট্রেনটি । এরপরের দৃশ্য স্তব্ধ করে দেয় উপস্থিত সবাইকে!
প্ররত্যক্ষদর্শি রেজাউল করিম জানান, ট্রেন সরে যেতেই ক্রসিং এর রেললাইনে দেখা যায় ক্ষত বিক্ষত একজনের লাশ। মা ও শিশুকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারলেও নিজেকে রক্ষা করতে পারেননি সেই রেল কর্মচারী।
নিজের জীবন বিপন্ন করে হৃদয়বিদারক এক দৃশ্যের মধ্য দিয়ে খুব সাধারন একজন মানুষ মুহূর্তেই তৈরি করে গেলেন মানবতার এক অনন্য নিদর্শন।
ঢাকা রেলওয়ে থানার উপপরির্শক (এসআই) আলী আকবর বিষয়টি নিশ্চিত করে জানিয়েছেন , দুপুর ১টার দিকে রেলওয়ের লাইন মেরামত করছিলেন বাদল মিয়া। তখন ৫ বছরের একটি শিশুকে নিয়ে এক মা রেল লাইন পাড় হওয়ার চেষ্টা করছিলেন। এ সময় সিলেট থেকে ঢাকাগামী সুরমা এক্সপ্রেসের ট্রেনে প্রায় কাটা পড়তে যাচ্ছিলেন ওই মা ও ছেলে। এ সময় বাদল দৌড়ে গিয়ে শিশুটির মাকে বাঁচান। তবে শিশুটিকে বাঁচাতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়েন বাদল।
বাংলাদেশ রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী মোহাম্মদ হামিদুল হক জানান, বেলা পৌণে একটার দিকে তিনি রেল লাইনের ঐ স্পটটিতে ছিলেন। সেখানে রেল লাইন রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করছিলেন রেল কর্মীরা। তাদের মধ্যে ছিলেন মোহাম্মদ বাদলও।
“বিমানবন্দর থেকে একটা ট্রেন ক্যান্টনমেন্টের দিকে যাচ্ছিল। সেই ট্রেনের আওয়াজ পেয়ে লোকজন সরে যেতে শুরু করে। এক মহিলা তার মেয়ে শিশুকে নিয়ে রেললাইন পার হচ্ছিলেন বিপজ্জনকভাবে। তখন মহিলাটিকে সময়মতো রেললাইন থেকে সরানো সম্ভব হলেও সঙ্গের মেয়ে শিশুটি লাইনের উপর থেকে যায়। তাকে সরাতে আবার ছুটে গিয়েছিলেন বাদল।”
হামিদুল হক জানান, ঘটনাস্থল থেকে তিনি মাত্র দুশো ফিট দূরে ছিলেন। সেখানে গিয়ে দেখেন তাঁর রেলকর্মী মোহাম্মদ বাদল ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছেন। কিন্তু মেয়েটি প্রাণে বেঁচে যায় । বাদল অনেকদিন ধরে বাংলাদেশ রেলওয়ের একজন মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করছিলেন।
হামিদুল হক আরও জানান, রেলকর্মী মোহাম্মদ বাদলের পরিবারকে সাহায্য করার চেষ্টা চলছে। রেলওয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের এই ঘটনা জানানো হয়েছে।
ঢাকা রেলওয়ে থানার ওসি ইয়াসিন ফারুক মজুমদার টেলিফোনে জানান, নিহত বাদল মিয়া বাংলাদেশ রেলওয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের কর্মচারী (ক্যান্টনমেন্ট গ্যাং নম্বর-৭৬)। তিনি ওই এলাকায় নিয়মিত দায়িত্ব পালন করেন। তার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও এলাকায়। তিনি আট সন্তানের জনক। কাওলায় রেলের জায়গায় টিনের ঘর তুলে তিনি পরিবার নিয়ে থাকতেন। প্রায় ২৯ বছর ধরে রেলে কাজ করা বাদল মিয়া শুরুতে দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করতেন। পরে তার চাকরি স্থায়ী হয়। শুক্রবার ময়নাতদন্ত শেষে লাশ নেয়া হয় কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে। সেখানে জানাজা শেষে তার লাশ নিয়ে যাওয়া হয় ময়মনসিংহে।