অসুস্থ প্রতিযোগিতায় খেই হারিয়ে বিষাদগ্রস্থ হয়ে পড়ছে অনেকে, কেউ কেউ আত্মহত্যা করছে

রায়হান তাসকিন রাব্বী


দুটো হৃদয় ভেঙ্গে দেয়া ঘটনা আড়াল হয়ে যাচ্ছে দৈনন্দিন কোলাহলের মাঝ থেকে। ঘটনা দুটোর মধ্যে মিল রয়েছে, দুজনই পাঁচতলা থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেছে। কারণও প্রায় একই—তাঁরা চলমান জীবনের সাথে কিছুতেই আর এঁটে উঠতে পারছিল না। দ্বিতীয় বর্ষের ঢাবির যে ছাত্রটি আত্মহত্যা করেছে সে ফিন্যান্স বিভাগে পড়ত। ঢাবির মতো একটি বৈচিত্রময় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েও কেন তাকে আত্মহত্যা করতে হল, কেন বিভাগের শিক্ষার্থী-শিক্ষক কেউই তাঁর বিষাদগ্রস্থতাকে এতটুকু আমলে নিল না?

তাই এক্ষেত্রে বৃহত্তম সমাজ ব্যবস্থা যেমন দায়ী, একইসাথে সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ ’কোঠর‘, যেখানে তরুণ হোসাইন (২২) অনেক স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আরো ক্ষুদ্র করে বললে ফিন্যান্স বিভাগের ছাত্র শিক্ষকরাও এ দায় এড়াতে পারেন না।

ঢাবি ছাত্র তরুণ হোসাইন আত্মহত্যা করেছে মসজিদ থেকে লাফিয়ে, এ খবরটি পুলিশের বরাতে জানা গিয়েছে। পুলিশ বলেছে তরুণ হোসাইনের আত্মহত্যার কারণ জানা যায়নি, তবে তাঁর বাবা আবদুল বারিক বলছেন, “তরুণ তাঁর সাবজেক্ট নিয়ে হতাশ ছিল। কয়েকবার ফেল করায় সে হতাশ হয়ে পড়েছিল। আমাকে ও বলেছিল যে কোনোভাবে পড়ার বিষয়টি পরিবর্তন করা যায় কিনা।”

গণরুমে ‘তরুণ’ (তরুণ হোসেন) ছিল সবচেয়ে নিরীহ একটি ছেলে। শৈশবর মা হারা অযত্নে বড় হওয়া এই ছেলেটি ২০১৫-১৬ সেশনে ভর্তি হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিনান্সে বিভাগে। অর্থিক সংকটে জর্জরিত ছেলিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকে নানা কারণে চরম হতাশায় ভুগতে শুরু করে। তার শারীরিক গঠন ও দেহের কালো রঙের কারণে অনেকের কাছেই সে যেন একটু বেশিই নিগৃহীত হত। কিন্তু আমি জানতাম ছেলেটা কতটা মেধাবী, কতটা সংগ্রামী। এর আগে আমি তার দুঃখ-সংগ্রাম নিয়ে পোষ্টও দিয়েছিলাম।

এটি ছিল নিহত তরুণ হোসেনের বন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এমএসআই খানের ফেসবুক স্ট্যাটাস। দুর্বলের প্রতি, শারীরিকভাবে অসুন্দরের প্রতি, বিত্তহীনের প্রতি যে মনোভাব আমরা দাঁড় করিয়েছি তারই নীরব শিকার হয়েছে তরুণ হোসেন নামের এই ছেলেটি।

নিহত স্কুল ছাত্র
নিহত স্কুল ছাত্র রায়হান রাব্বী।

বগুড়ায় প্রায় একইভাবে আত্মহত্যা করে রায়হান রাব্বী নামে এক স্কুল ছাত্র।  রাব্বী নিশিন্দারা আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন স্কুল ও কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র ছিল। রায়হান রাব্বী তাসিন স্কুলে যাওয়ার আগে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তাঁর আইডিতে ইংরেজিতে লিখেছেন, ‘থ্যাংকস টু আল্লাহ, ফর গিভিং মি অ্যা লাইফ অব ফুল পেইন… বাই, এভরিওয়ান।’ এবং তাঁর প্রোফাইল পিকচারের স্থানে লেখা, ‘আমি আত্মহত্যা করিনি, আমায় হত্যা করা হয়েছে।’

এর আগে ‘বাংলাদেশকে’ চিঠি লিখে আত্মহত্যা করেছিল গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অর্ঘ্য বিশ্বাস। অর্ঘ্য বিশ্বাস মারা যাওয়ার আগে নিজেকে যুক্তিবাদী বেয়াদব আখ্যা দিয়েছিল। অর্ঘ্যর চিঠি থেকে জানা গিয়েছিল বিভাগের বিভিন্ন অনিয়ম এবং চেয়ারম্যানের স্বেচ্ছাচারিতার কথা। গোপালগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে ভয়াবহ অনিয়মের মধ্য দিয়ে চলছিল তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে অর্ঘ্য আত্মহত্যা মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়ে যায়, কিন্তু এতে কিছুই হয় না আসলে, শুধু একটা জীবনের অপচয় ছাড়া।

অর্ঘ্যর চিঠিটি ছিল–

প্রিয় বাংলাদেশ,

আশা করি ভালো আছো। তোমার মেরুদণ্ডহীন সিস্টেমের কাছে শেষ পর্যন্ত হার মানলাম। বোকার মতো শিরদাঁড়াটা সোজা রেখে জীবনটা পার করার যে জেদ ছিল সেটা তোমার মেরুদণ্ডহীনতার তন্ত্রে হার মেনে গেল। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত উপস্থিতি থেকে এবং সিজিপিএ’র জন্য পড়াশোনা করে মেধাবী তকমা পাওয়া কিংবা দুর্ঘটনায় বা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর পর মিডিয়ার প্রচারের স্বার্থে মেধাবী খেতাব নেওয়ার কোনো ইচ্ছা ছিল না। শুধু শুধু গাধার মতো কোনো ইস্যু পেলে চ্যাঁচিয়ে বার বার তোমার মেরুদণ্ডহীনতা বোঝানো ছাড়া বোধ হয় আমি আর কিছু পারতাম না।

তোমার মেধাবী সূর্য সন্তানদের দেখে আমার বড় আফসোস হয়। দেখ, কীভাবে তারা তাদের মেধাগত যোগ্যতা বলে তোমার সিস্টেমের সাথে সুন্দরভাবে খাপ খাইয়ে নিয়েছে।তারা আমাদের কী বলে জানো? ”যুক্তিবাদী বেয়াদব”। আমরা ডিপার্মেন্ট-এর বদনাম করি, দল করে সুন্দর সাজানো একটা ডিপার্মেন্টকে নষ্ট করি। সিনিয়র ভাইদের সাথে ঘুরে ঘুরে স্যারদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করি।

কাল সারা রাত অনেক ভাবলাম বুঝলে। সত্যি বলতে কী, আমার এখন মনে হচ্ছে আমরা এই “যুক্তিবাদী বেয়াদবেরা” আসলেই তোমার ক্ষতি করছি। পদ্মা ব্রিজ হচ্ছে। দেশে কর্মসংস্থান বাড়ছে, আধুনিকায়ন হচ্ছে। সুশাসন এবং আইন ব্যবস্থায় গুম, হত্যা, সংখ্যালঘু নির্যাতন হচ্ছে। কোটি কোটি টাকা লোপাট হওয়ার পরও মন্ত্রী মহোদয় সেটা হাতের ময়লার মতো উড়িয়ে দেন। প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। দলীয় এবং নিয়োগ বাণিজ্যের কল্যাণে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকেরা বিশাল সংখ্যক ডিপ্রেসড শিক্ষার্থী তৈরি করছেন। গর্ব করার জন্য বহির্বিশ্বে তোমার বংশদ্ভূত সন্তানেরা রয়েছেন যারা নিজেদের উন্নতির স্বার্থে তোমাকে ত্যাগ করে অন্য দেশকে আপন করে নিয়েছেন।

তোমার মেরুদণ্ডহীন বিদ্বান সূর্য-সন্তানেরা তোমার এত উন্নতি করছে সেখানে আমি তোমার কি উপকার করছি বলো? তোমার টাকায় পড়ে-খেয়ে তোমার সিস্টেমের বিরোধিতা করছি, তোমার সাথে বেঈমানি করছি। দেখে নিও, আর করব না। সেদিন ভিসি স্যার এবং চেয়ারম্যান স্যারের কাছে মাফ চাইনি। আজ তোমার কাছে মাফ চাইছি।তোমার আর কোনো ক্ষতি করব না। আর তোমার বিরোধিতা করব না। সোজা হওয়া এই মেরুদণ্ড ভেঙে নোয়াতে পারব না। সেটা আমার দাঁড়া হবে না। সেজন্য অন্য পথটা বেছে নিলাম।

ভয় পেয়ো না। ধর্মান্ধতায় অন্ধ, ক্ষমতাবলে ভীত, অর্থ মোহে ঘুমন্ত এই বালির নিচে মাথা ঢুকিয়ে থাকা উঠপাখি সদৃশ জাতি কোনোদিনও তোমার ভেঙে পড়ে থাকা মেরুদণ্ড সোজা করার চেষ্টা করে তোমাকে যন্ত্রণা দিবে না। আমার মতো যেসব “বেয়াদবেরা” তোমার সিস্টেম বাগের কারণে ভুল করে জন্মেছে, তারাও আস্তে আস্তে তোমার সিস্টেমের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে। আশা করি পৃথিবীতে তুমি তোমার উন্নতির ধারা বজায়ে রাখবে।

ভাল থেকো।

ইতি
যুক্তিবাদী বেয়াদব


অর্ঘ্য বিশ্বাস
অর্ঘ্য বিশ্বাস

আমরা ভয়াবহ দুর্নীতিগ্রস্থ একটি প্রশাসনিক ব্যবস্থা, উড়ে আসা সংস্কৃতি এবং সংস্কারহীন একটি সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে বাস করছি। ক্ষমতাপ্রাপ্ত এবং সুযোগপ্রাপ্ত বেশিরভাগ লোক দুর্নীতগ্রস্থ এ ব্যবস্থার অংশীদার, কোনোভাবেই সুযোগপ্রাপ্ত বেশিসংখ্যক লোককে ‘ভালো লোক’ বলার সুযোগ নেই—তাহলে এ সমাজটির চিত্র এমন হতো না। সুযোগটি এখানে যোগ্যতার ভিত্তিতে নির্ণীত হয় না, যোগ্য ব্যক্তিকে ডেকে নেয়া হয় না। কেউ তোষামোদ করে, কেউ কৌশলে, কেউ টাকা দিয়ে সুযোগ করে নেয়। ফলে ভালো মানুষ সিস্টেমের পরিচালক এবং পরিচারক হিসেবে কিছু থাকলেও তাঁদের সংখ্যা হাতে গোনা।

দরদী মানুষ ক্ষমতাসীন নয়। ফলে কখন কোথায় কোন তারা খসে গেলে এটা তাঁরা খেয়াল করার প্রয়োজন বোধ করে না। ঝরা পাতা মর্মর করে মাড়িয়ে যাওয়াই বরং তাঁদের অভ্যেস। তাই একজন তরুণ, একজন রাব্বী এবং একজন অর্ঘ্য বিশ্বাসের ঝরে যাওয়া আমাকে ব্যথীত করে, অামাকে দায়ী করে। 


দিব্যেন্দু দ্বীপ