ছোটগল্প: খোঁজা // মতিন বাঙালি

অমরাবতী

আবুল সপ্তাহের ছ দিন কাজ করলেও সপ্তম দিন অর্থাৎ সপ্তাহের শেষ দিন শুক্কুরবার কোনো কাজ করে না। সপ্তাহের অন্য দিনগুলো তার মালিকের, কেবল শেষ দিনটি অর্থাৎ শুক্কুরবার তার নিজের। অফিসে যত কাজই থাক না কেন, এ দিনটা সে ছুটি কাটাবে। ঘরে বসে নয়, বরং প্রকৃতির সান্নিধ্যে কাটাতে চায় সে এ দিনটা।
বুড়িগঙ্গার পাড়ে লঞ্চঘাটের রেলিং এর ওপর পা মেলে দিয়ে পুবমুখী হয়ে বসে আছে আবুল। বয়স ষাটের ওপর। সময়টা বিকেল। বোশেখ মাস। বেশ গরম পড়েছে। এখানে এলে অনেক বাতাস লাগে। পুব দিক থেকে অনেক বাতাস এসে গা জুড়িয়ে দিয়ে যায়।
আকাশে চতুর্দশীর চাঁদ। সূর্য ডুবলেই সে তার জোছনা ছড়ানো শুরু করবে। আজ নৃসিংহ চতুর্দশী। আকাশ মেঘমুক্ত। কখন যে আকাশ মেঘলা হয়ে উঠবে, সেটা বলা যায় না একদম। তখন এখানে বসে থাকার আর জো থাকবে না।
বাদাম নিবেন, চাচা? বাদাম।
বাদামঅলার ডাকে পেছন ফিরে দেখে আবুল। এ বাদামঅলা তার চেনা। বাড়ি শরীয়তপুর। নিজের খেতের বাদাম সে এ এলাকায় ফেরি করে বিক্রি করে। এতে তার সংসার চলে যায়। আবুল বুঝতে পারে না, কীভাবে এত উপার্জ হয় বাদাম বিক্রি করে। বাদামঅলার বয়স তিরিশ হবে। হালকা পাতলা শরীর। গায়ের রং কালো। কুচকুচে কালো নয়, তেল কালো।
কয় টাকার দেব? পাঁচ টাকা, না দশ টাকা?
পাঁচ টাকার দাও।
পাঁচ টাকার বাদাম নিয়ে আয়েশ করে চিবুতে থাকে আবুল। পাঁচ টাকার বাদাম খেতে তার পাঁচ মিনিটও লাগে না। বাদাম শেষ। পকেটে হাত দিয়ে নিরাশ হয় আবুল। কাগজের মিনি ঠোঙাটা নদীর জলে ফেলে দিয়ে হাত মুখ মোছে সে।
নদীর জলে ঠোঙাটা ফেলে দেওয়াটা ঠিক হলো কি না ভাবে সে।
কী সমস্যা? কত জনে তো কত কিছু ফেলে নদীতে। বাদামের খোসা থেকে শুরু করে মরা কুকুর বেড়াল, এমন কি মানুষের লাশও ফেলা হয় এ নদীর জলে। আর আমি তো সামান্য একটু কাগজের ঠোঙা ফেললাম। কিছু হবে না।
অদূরেই চেয়ে দেখে, তরমুজ আর বাঙির লাখো লাখো খোসা। পানের বে^াটা, সুপারির ছাল, পঁচা শশা, আরো কত কী!
কিছ দিন আগে এ এলাকায় অভিযান চালিয়ে নতুন মেয়র অনেক আশা নিয়ে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করিয়েছেন। এখন পরিষ্কার। আগে এখানে ছিল পানের আরত, বাঙি, তরমুজ, বেল, কদবেল ইত্যাদি ফলের আড়ত। আজ সেখানে কিছুই নেই। মানুষ শান্তিতে চলাফেরা করতে পারছে। দূর থেকে আসা লঞ্চের যাত্রীরা যে যার ইচ্ছেমতো যেদিকে খুশি সেদিকে যেতে পারছে। আসলে সরকার চেষ্টা করলে আর প্রশাসন সহযোগিতা করলে কী না হয়। এ অবৈধ দখলদারদের তুলে দেওয়া যে যাবে এ কথা কেউ বিশ্বাসই করতে চায় নি।
সরকার সম্প্রতি এ এলাকাকে সিঙ্গাপুরের মডেলে সাজাবার পরিকল্পনা করেছে। নদীর পাড় ধরে পোস্তগোলা থেকে সদরঘাট হয়ে রায়ের বাজার হয়ে গাবতলী পর্যন্ত বাস চলাচল করা শুরু হবে শিগগিরই। নদীর পাড় ঘেঁষে পুরো এলাকা জুড়ে লাগানো হবে নারকোল গাছ ও অন্যান্য গাছ। মাঝে মাঝে পার্ক গড়ে তোলা হবে। থাকবে খাবারের ভালো হোটেল আর বিদেশিদের জন্যে থাকবে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। আবুল বসে বসে এসব ম্বপ্ন দেখে।
যখন অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ শুরু হয়, তখন সবাই বলেছে, আরে রাখেন, ভায়া। ক দিন পর দেখবেন, সব ঠিক হয়ে গেছে। পুশিশ আর প্রশাসনকে ম্যানেজ করা কোনো ব্যাপারই নয়। যুগ যুগ ধরে তো এটাই দেখে আসছি। কতবার এদের তুলে দেওয়া হলো। বড় জোর, এক দিন। তার পর সব আগের মতো।
সকল মানুষের সকল জল্পনা-কলপনার অবসান ঘটিয়ে মেয়র আর তার সহযোগীরা মিলে এবারে আর কোনো অবৈধ দখলদারকে পাত্তা দেয় নি। অবশ্য দখলদারেরা টার্মিনাল চত্বরের মাঝখানে কাপড়ের ব্যবসায় ফাঁদিয়ে বসেছিল। কিন্তু টিকতে পারে নি।
আবুলের বয়স হয়েছে। অনেকগুলো দাঁত পড়ে গেছে। বাকি দাঁতগুলো পড়বে পড়বে ভাব। আগে যে আবুল মুরগির মাথা, হাঁসের মাথা, কৈ মাছের মাথা চিবিয়ে খেত, এখন আবুল সে সব কথা ভাবতে পারে না। এখন বাদাম খেলে বাদাম ভাঙা আর ছিদ্র হয়ে যাওয়া দাঁতের ফাঁকে গিয়ে আশ্রয় নেয়। জিভের মাথা দিয়ে দাঁতের ফাঁক থেকে বাদামের কণাগুলো বের করে ফেলে দেয় আবুল।
হঠাৎ লাফ দিয়ে নেমে পড়ে পুলে নিচের ময়লা স্তুপে। কী যেন খুঁজতে থাকে আবুল আনমনে। মাথা নিচু করে খুঁজতে থাকে সে। খালি চোখে ভালো দেখে না সে। চোখে চশমা পরে নেয়। চশমার পাওয়ার পাল্টানো হয় নি অনেক দিন। ফলে এ চশমায় ভালো কাজ করে না। তারপরও খুঁজতেই হবে।
আশেপাশের লোকজন দেখে আবুলকে। একজন ষাটোর্ধ ব্যক্তি চোখে চশমা এঁটে কী খোঁজে অমন করে। সবার মনে প্রশ্ন জাগে। কী হবে। টাকা? কত টাকা হতে পারে? এক শ, পাঁচশ? তাই বলে এত খোঁজা? দু একজন করে করে এক পা দু পা করে এগিয়ে যায় লোকজন।
কী খোঁজেন, চাচা? কেউ কেউ দাদুও বলে।
চাচা সম্বোধন না হয় মানা যায়, তাই বলে দাদু? কী বা এমন বয়স তার?
আবুল কারো প্রশ্নের কোনো জবাব দেয় না। কেবল খুঁজতে থাকে। কাউকে কোনো কিছু বলে না সে। এটা না হলে সে কাউকে মুখ দেখাতে পারবে না। এমনিতেই তাকে বুড়োর মতো লাগে। তার ওপর, —-
ভাবেত পারে না আবুল।
ফোন করে ডাকে তার নাতির বয়সী ছেলেকে। ছেলে আসে বাবার ডাকে।
এসে বাবাকে দেখে জিজ্ঞেস করে, কী আব্বু, কেন ডেকেছ?
আবুল ছেলেকে পুলের নিচে নামতে বললে ছেলে নামে না। সে চলে যায়।
আবুল বোঝে, ছেলে এখানে আসতে লজ্জা পাচ্ছে।
আসলে বুড়ো বয়সের ছেলেরা বাবার কথা শোনে না। তাদের জগতটা আলাদা।
ইতোমধ্যে অনেক লোক জড়ো হয়ে গেছে। অনেকেই খঁজছে। কিন্তু কী খুঁজছে, কেন খুঁজছে কেউ তা জানে না।
দুটো টোকাই ছেলে এগিয়ে আসে। ওরা খুঁজছে টাকা। টাকা পেলে আজ ওদের পেট পুরে খাওয়া হবে। ওরা সব দিন পেট পুরে খেতে পারে না। ওরা যদি আজ একশ টাকা পেয়ে যায়, তাহলে মন্দ হয় না।
টোকাই ছেলেদের চোখ এক সময় ঝলমলে হয়ে ওঠে। ওরা একটা পাঁচ টাকার কয়েন পেয়েছে। এতে পুরি খাওয়া যাবে। দুজন মিলে একটা পুরি ভাগ করে খাওয়া যাবে। অবশ্য কারো কাছে আর পাঁচ টাকা চেয়ে নেওয়া যেতে পারে। আর না হয় দোকানে বাকি রাখলেও চলবে। দোকানদান অবশ্য বাকি দিতে চায় না। কারণ সে বাকি টাকা ফেরত পাওয়ার আশা করতে পারে না। অনেক দিন বাকি দিয়ে ঠকেছেন তিনি।
কিন্তু এ কয়েনটা তো বুড়োর নয়। হলে তো উনি হাত বাড়িয়ে নিতেন বুড়ো।
ওরা কয়েনটা নিয়ে চলে যায়।
পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন এক সিন্দুর-পরা ভদ্রমহিলা। সঙ্গে তার স্বামীও রয়েছেন। তার মনে পড়ে যায় গত বছর এখানে তিনি নাকের ফুল হারিয়ে ফেলেছিলেন। হঠাৎ নাকে হাত লেগে ফুলটা পড়ে গিয়েছিল জলে। তিনি তার অনুগত স্বামীকে কাজে লাগান।
চল তো, খুঁজে দেখি, আমার হারিয়ে যাওয়া নাকের ফুলটা যদি পাই। জান, নাকের ফুলটা হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে আমার দিনকাল ভালো যাচ্ছে না। আসলে কী, ওটা তো তোমার দেওয়া বিয়ের নাকফুল।
কী শুরু করলে? স্বামী রেগে গিয়ে বলেন।
আরে, আস না একটু। খুঁজে দেখি।
স্বামী রেগে গেলেও তার না বলবার সাহস নেই। তারা দুজনে মিলে খুঁজতে থাকেন।
হোটেল বয়, আড়তের কর্মচারি, মুদি দোকানদার, রিকসাঅলা, রাজনৈতিক দলের পাতিনেতারা -সবাই নদীর পাড়ে পুলে নিচে।
পাশে দিয়ে যাচ্ছিল পুলিশের ভ্যান। পুলের নিচে লোকজন দেখে পুলের কাছে থামে পুলিশের ভ্যান। দুজন সদস্য এগিয়ে যায় সেখানে। তারাও খুঁজতে থাকে পুলিশের চোখ দিয়ে।
দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। রাস্তার আলো জ্বলে উঠে। থালাবাসন, চায়ের কাপ, চা চামুচ, বটি, খুন্তি -আরো কত কিছু পাওয়া গেল।
হঠাৎ আবুলের চোখ আনন্দে জ্বলজ্বল করে ওঠে। সে তার কাঙ্খিত ধন কুড়িয়ে পেয়েছে। হাতের মধ্যে কী যেন নিয়ে সে মুছতে থাকে জামার আস্তিনে। ইতোমধ্যে তাতে চোখ আটকে যায় রাজনৈতিক পাতিনেতাদের। ওরা দৌড়ে আসে আবুলোর কাছে। ভাগ বসাতেই হবে। সব কিছুতেই ভাগ বসানো স্বভাব ওদের।
দেখি, হাতে কী? দেন ওটা আমাকে।
এ কথা বলে হাত বাড়ায় আলহাজ মাহিন। দলের ইউনিয়ন পর্যায়ের সাহিত্য সম্পাদক সে। সাহিত্য অর্থ কী সেটা সে জানে না। তার কাজ কী তাও সে জানে না। তবুও সে দলের ইউনিয়ন পর্যায়ের সাহিত্য সম্পাদক। গত বছর মানুষের পকেট থেকে এক রকম জোর করে টাকা কেড়ে নিয়ে হজ করে এসেছে সে। আজকাল নেতাদের মধ্যে আলহাজ পদবিটা খুব দরকারি হয়ে গেছে।
জিনিসটা হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে চেপে ধরে আবুল। কাউকে দেবে না সে। জীবন দিয়ে হলেও আগলে রাখবে। আলহাজ মাহিনও ছাড়বার পাত্র নয়। চুরি-চামারি, ছিনতাই-ডাকাতি, অন্যের জমি দখল, ভাড়ায় মারামারি খুনাখুনি পর্যন্ত সে করে। তার কাছে এ আবুল কোনো বিষয় নয়। সে জাপটে ধরে আবুলকে।
তার আগেই আবুল মুখে খইনি লাগানোর মতো সেই জিনিসটা মুখে লাগিয়ে দেয়। এবার তার আত্মসমর্পণ করবার পালা। আলহাজ মাহিনের দল পাঁজকোলা করে তাকে নিয়ে যায় ইলেকট্রিক বাতির আলোতে। মুখ হা করে দেখে ওরা। না, মুখে তো কোনো কিছু নেই। তাহলে কি ব্যাটা গিলে ফেলল মূল্যবান জিনিসটা। নিশ্চয়ই স্বর্ণ হবে। প্রথমে হুমকি-ধমকি, তারপর ধস্তাধস্তি, তারপর ধাক্কাধাক্কি। না কোনো ওষুধে কাজ হচ্ছে না।
শুরু হলো প্রহার। বিরোধী দলের নেতাকর্মী হলে দু ঘা খেত আবার দু ঘা বসিয়ে দিত। কিন্তু আবুলের সে অভ্যেস নেই। ফলে অল্পেই আবুল কাবু হয়ে গেল। সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। ইতোমধ্যে রক্তারক্তি অবস্থা। মুখে, পিঠে, পেটে, মাথায় ঘুষি আর লাথি।
আবুলের নিথর দেহের ওপর চলছে ওদের পাশবিকতা। তার মুখ থেকে একসময় সবাইকে চমকে দিয়ে একটা বস্তু বের হয়ে এল। সবাই খুশি ওরা।
জিনিসটি নেতার হাতে এল।
প্লাস্টিকের একটা নকল দাঁত।