ভরা আমের মৌসুমে সামাদ গাজীর এক কেজি আম কেনার কথা কখনো মনে আসেনি। আসবে কী করে? বয়স পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। তার দুই বউ, সাত সন্তান। প্রথম বউয়ের পাঁচ সন্তান। দ্বিতীয় বউয়ের দুইজন।
প্রথম বউয়ের সন্তানেরা সবাই কাজে যোগ দিয়েছে। বড় দুই ছেলে বিয়ে করে ঘর সংসারও পেতেছে। মেয়েটারও বিয়ে হয়েছে। বড় বউয়ের ছোট দুই ছেলের একজন রিক্সা চালায়, আরেকজন মাদ্রাসায় পড়ে।
গাজী দ্বিতীয় বিয়ে করেছে, তাও প্রায় দশ বছর হয়ে গেল। এ বউয়ের প্রথম সন্তানটিও ছেলে, বয়শ আট বছর। দ্বিতীয় সন্তানটি মেয়ে, তিন বছর বয়স। গাজীর দ্বিতীয় বউ জন্ম নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। বউয়ের প্রচেষ্টায় গাজীর সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা আর নেই।
দুই সন্তান এক বউ নিয়ে গাজীর সংসার এখন। আগে সে হোটেল ব্যবসা করত। ছেলেরা একটু বড় হলেই সবাইকে কাজে লাগিয়েছে, ফলে উপার্জন সব ঘরেই থেকেছে। তবে ছেলেরাও এখন এক একটা গাজী হওয়াতে বাপ গাজীর কপাল পুড়েছে।
বড় হওয়ার পর ওরা টাকা ভাঙতে শুরু করে, কাজেও মনোযোগ কমাতে থাকে। দ্বিতীয় বিয়ে করার পর বাপকে ভাগিয়ে বড় দুই ছেলে ভাতের হোটেলের দখল নিয়েছে। পরে দুই ভাই ক্যাচাল করে হোটেলটা দুইভাগ করে নেয়।
দুটি হোটেলই এখন ভাল চলে। ওদের অভাব নেই, কিন্তু বাপের দিকে ওরা তাকায় না। বাপকে ওরা ঘৃণা করে। ছোট দুইভাইকে মাঝে মাঝে কিছু দিতে চায়, ওরা নেয় না। ওরা জানে হোটেল ওদের পৈতৃক সম্মত্তি, তাই প্রাপ্য থেকে দান নিতে ওরা ইচ্ছুক নয়।
গাজী এখন নিরুপায় হয়ে রিক্সা চালায়। বউ বাসাবাড়িতে কাজ করে। সৌভাগ্যের কথা এই যে যৌবনহীনা প্রথম বউ গাজীর সাথে থাকে না। বড় ছেলে ওর মাকে সাথে রেখেছে, তবে খুব একটা আদর যত্নে রাখতে পারেনি।
বিয়ের পরে মাকে নিয়ে রেখেছিল মূলত বউ পাহারা দেবার জন্য। এখন আর পাহারার প্রয়োজন হয় না। কুলসুম বিবি সম্প্রকি একটা বাসা বাড়িতে কাজ নিয়েছে, তাই ছেলের উপর সে নির্ভরশীল এখন একথা বলা যায়ও না।
গাজী এ পক্ষের বড় ছেলেটাকে এখনই কাজে লাগানোর চিন্তাভাবনা করছে। ছেলেটা নারিন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। সাবেরা ছেলেকে পড়াতে চায়। কিন্তু সামাদ গাজীর সেদিকে ঝোঁক নেই।
অভিজ্ঞতা থেকে সে জেনেছে, ছেলে-মেয়ে ছোট থাকতেই তাদের কাজে লাগাতে হবে, তাহলে উপার্জনের পুরোটা সে পাবে। ওরা খেলার ছলে মনোযোগের সাথে কাজ করে, কাজটাই ওদের খেলা হয়ে যায়। ছেলের সুঠাম দেহ এবং সুস্থতা দেখে গাজীর চোখ চকচক করে।
বউয়ের ভয়ে কথাটা এখনই সে পাড়তে পারছে না। সাবেরা যথেষ্ট রসবতী, তাই নির্লজ্জ কামুক স্বামীর উপর কিছু নিয়ন্ত্রণ সে এখনো রাখতে পেরেছে। কিন্তু মানুষ পশু হলে তাকে বেঁধে রাখা যায় কতক্ষণ?
অবশেষে গাজী রুহুলকে কাজে পাঠিয়েছে। মাসে পনেরো শো টাকা বেতন এবং এক বেলা খাওয়া হিসেবে রুহুল এখন একটা মুদি দোকানের কর্মচারী।
ওরা টিনশেডের দু’টি রুমে থাকে। সারি দেওয়া দশটি ঘরে আটটি পরিবার, সবার সাথে সবার মাখামাখি, ঝগড়ঝাটিও।
পাশের ঘরের ছেলেটির হাতে আম দেখে মেয়েটি “হাম হাম” করে আম খাওয়ার জন্য কান্না জুড়েছে। সামাদ দেখেও না দেখার ভাণ করে চলে যায়।
সাবেরা কাজ করলে কী হবে টাকা নিজের কাছে রাখতে পারে না, মাইনে হাতে পাওয়ার সাথে সাথে সামাদ ছোঁ মেরে নিয়ে যায়।
সারা ঘর কুড়িয়ে বাইশ টাকা পেয়েছে সাবেরা। ঐ বাইশ টাকা নিয়ে রুহুলের কাছে দিয়ে এসেছে, আম কিনতে বলেছে। দোকানের মালিক বিষয়টি দেখেছে, কিন্তু সে এমনভাবে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে যেন সে কিছুই শুনছে না।
বাইশ টাকায় আম হয় কিনা রুহুলের জানা নেই। সে তার আট বছরের জীবনে পাঁচ টাকার বেশি হাতে পায়নি কখনো। এখন সে পনেরো শো টাকা মাইনে পায়, কিন্তু টাকাটা সে নিজ হাতে পায় না।
দোকানদার তার বাপের কাছে টাকাটা দেয়। দাস ব্যবসা, মানব পাচারের কথা খবর হয়, কিন্তু পিতার কাছে এদেশে কত শিশু সন্তান দাস হয়ে রয়েছে সে খবর কে রাখে?
রহুল আম কিনতে বেরিয়ে ভালই বিপদে পড়ে। অবশেষে একটা ভ্যানের উপর চল্লিশ টাকা কেজি দরে ন্যাতানো কিছু আম বিক্রী হচ্ছে দেখে এগিয়ে যায়।
কিন্তু দোকানদার কিছুতেই হাফ কেজি আম বিক্রী করবে না। ছোট্ট একটা ছেলেকে দেখেও তার কোনো মায়া হয় না।
সে অনড়, হাফ কেজি আম বিক্রী করবে না। আট বছর মাত্র বয়স, আম খাওয়ার ইচ্ছে ওরও হয়েছে, এতক্ষণ ভেবেছে, বাসায় গিয়ে বোনের সাথে সেও আম খেতে পারবে।
অবশেষে রুহুল একটা বুদ্ধি বের করে। বলে, আপনি বাইশ টাকার আম দেন, মাপা লাগবে না। “বাইশ টাকার আম” শুনে দোকানদার সাথে সাথে খেই হারিয়ে পুনরায় ধাতস্থ হয়ে একটি পঁচা এবং একটি মোটামুটি খাওয়ার উপযোগী -দুটি আমা ওর হাতে দেয়।
রুহুল আম দুটি নিয়ে দৌঁড় দেয়। অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে, মালিক গালি দেবে, মাঝেমাঝে মাইরও দেয়। মায়ের হাতে কোনমতে আম দুটি দিয়ে দৌঁড়ে আবার দোকানে চলে আসে ও।