পড়তে পারেন শাহরিয়ার কবিরের নতুন বই “মানবতার আমন্ত্রণে তুরস্কে”

শাহরিয়ার কবির

শাহরিয়ার কবির

লেখকের ভাষ্য

ভারতবর্ষসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইসলাম প্রচার করেছিলেন সুফী সাধকরা ভারতবর্ষে প্রথম ইসলাম প্রচারক মালিক দীনার (মৃত্যুঃ ৭৪৮ খৃঃ) ছিলেন সুফী তরিকার অত্যতম প্রধান ইমাম হাসান আল বসরির (৬৪২-৭২৮ খৃঃ) মুরিদ। তারা ছয়জন এসেছিলেন ইরাকের বসরা থেকে ভারতের কেরালায়। মালিক দিনার কেরালার থালাঙ্গানায় ৬২৯ খৃষ্টাব্দে চেরামাল জুমা মসজিদ নামে যে মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন, বহু সংস্কারের পর এটি এখন কেরালার অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ
উমাইয়া বংশের মোহাম্মদ বিন কাশিম ৭১১ খৃষ্টাব্দে সিন্ধুর রাজা দাহিরকে পরাজিত করে ভারতের মাটিতে ইসলামের প্রচারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন বটে তবে সফল হননি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তরবারির জোরে ইসলাম প্রচারের চেষ্টা সর্বত্র ব্যর্থ হয়েছে। মোহাম্মদ বিন কাশিমের পর গজনীর সুলতান মাহমুদ (৯৭১-১০৩০ খৃঃ) ও শাহবুদ্দীন মোহাম্মদ ঘোরী (১১৭৩-১২০২ খৃঃ) দিল্লীতে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে নির্বিচারে অসুমলিম নিধন করেছেন, মন্দির ধ্বংস করেছেন, বলপ্রয়োগ করে ধর্মান্তরিত করেছেন, পরে উপলব্ধি করেছেন গায়ের জোরে ধর্মপ্রচার ফলদায়ক হয় না। পক্ষান্তরে সুফী ধর্মপ্রচারকরা আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে সাধারণভাবে জবরদস্তি করেননি। তারা শান্তি, সাম্য ও সৌহার্দ্যরে কথা বলেছেন। স্থানীয় সংস্কৃতি, লোকাচার ও ধর্মকে তারা আঘাত করেননি, বরং বহু ক্ষেত্রে ইসলামকে আঞ্চলিক রূপ দিতে চেয়েছেন, মানুষের সেবা করেছেন, নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসার কথা বলেছেন, যে কারণে ভারতবর্ষে ইসলামের দ্রুত বিস্তার ঘটেছে।
ভারতবর্ষের সুফী সাধকদের ভেতর বহুল পরিচিত হচ্ছেন খাজা মঈনউদ্দিন চিশতি (১১৪১-১২৩৬ খৃঃ), যিনি দক্ষিণ এশিয়ার চিশতিয়া তরিকার জনক। আজমীরে তার মাজারে প্রতিদিন ধর্মনির্বিশেষে হাজার হাজার ভক্তের সমাগম হয়। উপমহাদেশে চিশতিয়া তরিকার পর উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মাদারিয়া, যে তরিকার প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ বদিউদ্দিন জিন্দা শাহ মাদার (মৃত্যু ১৪৩৪ খৃঃ), যিনি কুতুবউল মাদার নামে বেশি পরিচিত। তার মাজার রয়েছে ভারতের উত্তর প্রদেশের কানপুরে। এরপর রয়েছে বাগদাদের হযরত আবদুল কাদির জিলানীর (১০৭৮-১১৬৬ খৃঃ) অনুসারী, যাদের বলা হয় কাদেরিয়া। এই তিন ধারার বাইরে দক্ষিণ এশিয়ায় নকশ্বন্দী ও সুহরাওয়ার্দী তরিকার অনুসারীও আছেন, যারা তুলনামূলক রক্ষণশীল। নকশবন্দীরা গান, বাজনা, নাচকে হারাম মনে করেন। মুঘল সম্রাটদের ভেতর বাবর ও আওরঙ্গজেব নকশবন্দী সুফীদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন বিধর্মী তথা হিন্দুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য। হালে চেচনিয়া ও ইরাকে নকশন্দীরা অস্ত্র হাতে জিহাদ করছে। সুহরাওয়ার্দী ও নকশবন্দীরা শরিয়তের ওপর বেশি গুরুত্ব দেন, অন্যরা গুরুত্ব দেন মারেফত বা মরমিবাদের ওপর।
ভারতবর্ষের সুফীদের প্রধান তিনটি তরিকা— চিশতিয়া, কাদেরিয়া ও মাদারিয়াদের ওপর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে ইরানের জালালউদ্দনি রুমির (১২০৭-১২৭৩), যার মাজার তুরস্কের কোনিয়া শহরে। মধ্যযুগে রুমির শিষ্য ও অনুসারী দরবেশরা সিরিয়া, মিশর, ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান হয়ে ভারতবর্ষ পর্যন্ত এসেছিলেন ধর্ম প্রচারের জন্য। বাংলাদেশে যে সুফী সাধকরা ইসলাম প্রচার করেছেন তাদের ভেতর সর্বাগ্রগণ্য হচ্ছেন সিলেটের হযরত শাহজালাল, যিনি ছিলেন রুমির ভাবশিষ্য, যার জন্মস্থান তুরস্কের কোনিয়া। পূর্ব ভারতের জনপদ সিলেটে তার আগমন ঘটেছিল ১৩০৩ খৃষ্টাব্দে। জনশ্রুতি হচ্ছে রুমির নির্দেশে তিনি ইসলাম প্রচারের জন্য ভারতবর্ষে এসেছিলেন।
রুমির অনুসারীদের দরবেশ বলা হয়, যারা নাচ ও গানের ভেতর স্রষ্টার মাহাত্ম্য বর্ণনার মাধ্যমে তার নৈকট্য অর্জন করতে চান। তুর্কি ও পারসিক ইসলামী চিন্তাবিদদের উল্লেখ করে সৈয়দ মুজতবা আলী মন্তব্য করেছিলেন, আরবি ভাষায় যদি কোরাণ অবতীর্ণ না হতো তাহলে রুমির ‘মসনবী’ হত মুসলমানদের কোরাণ। ২০০১-এর ৯/১১-এ যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে জঙ্গী মৌলবাদীদের ভয়ঙ্কর হামলার পর সেখানে রুমির মানবিক ইসলাম সম্পর্কে কৌতুহল এমনই বেড়েছে, বছরের পর বছর রুমির গ্রন্থ ছিল বিক্রয় তালিকার শীর্ষে।
বাংলাদেশে বা এই উপমহাদেশে মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জনকারীদের সর্বত্র মওলানা সম্বোধন করা হলেও তুরস্কে মওলানা (তুর্কি ভাষায় মেভ্লানা) একজনই আছেন, তিনি জালালউদ্দিন রুমি। রুমির গুরু ছিলেন সুফী সাধক শামস তাবরেজি (১১৮৫-১২৪৮ খৃঃ), রুমির মতো পারস্যে জন্মগ্রহণ করলেও মৃত্যুবরণ করেছেন তুরস্কে। কোনিয়ায় রুমির মাজারের কাছেই তার মাজার। শামস-এর একটি বহুল প্রচারিত কালাম হচ্ছে ‘কখনও ভবিষ্যতের স্বর্গ বা নরকের সন্ধান করো না। যখনই তুমি কোনও প্রত্যাশা, হিসেবনিকেষ, দরদস্তুর ছাড়া কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে— অবশ্যই স্বর্গসুখ অনুভব করবে। যখনই তুমি সংঘাতে লিপ্ত হবে, ঘৃণা করবে— তুমি নরক অনুভব করবে। তার আরেকটি বাণী হচ্ছে— আমাদের প্রত্যেকের নাম, চেহারা, চরিত্র ভিন্ন। স্রষ্টা যদি সবাইকে এক রকম চাইতেন, তবে তিনি তা-ই করতেন।’ তার মানবপ্রেম ও বহুত্ববাদী সমাজের বোধ বিকশিত হয়েছে রুমির রচনায় এবং পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের বহু সুফী সাধকের রচনায়
বাংলাদেশের লালন ফকির (১৭৭২-১৮৯০ খৃঃ) দেড়শ বছর আগে লিখেছিলেন, ‘সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে/ লালন বলে জাতের কী রূপ দেখলাম না এই নজরে।’ কিংবা— ‘সবে বলে লালন ফকির হিন্দু কি যবন/ লালন বলে আমার আমি না জানি সন্ধান।’
লালনের শিষ্য ফকির দুদ্দু শাহ (১৮৪১-১৯১১ খৃঃ) আরও স্পষ্ট করে লিখেছেন, ‘আগে মানুষ পরে ধর্ম জাতির নির্ণয়/ ধর্ম জাতি আগে হলে, শিশু বালক কে না জানতে পায়।/ দর্শন শ্রবণ পারিপাশ্বিক অবস্থার গুণে/ শেখে শিশু হিন্দু, যবন আর খ্রিষ্টানে বিচার আচার/ হিংসা ঘৃণা উদয় হয় মনে, জাতি জন্মগত নয়,\ সৃষ্টির ভেতর স্রষ্টাকে অনুসন্ধানের সুফীবাদের কথা দুদ্দু শাহ সহজ ভাষায় প্রকাশ করেছেন— ‘যে খোঁজে মানুষে খোদা সেই তো বাউল/ বস্তুতে ঈশ্বর খুঁজে, পায় তার উল\ পূর্ব পুনর্জন্ম না মানে চক্ষু না দেয় অনুমানে/ মানুষ ভজে বর্তমানে, হয়রে কবুল।
দুদ্দু শাহ্ গুরু লালনও লিখেছেন, ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।/ মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই সব হারাবি।’ কিংবাসহজ মানুষ ভজে দেখ না রে মন দিব্যজ্ঞানে/ পাবি রে অমূল্য নিধি বর্তমানে।’
বাংলার লালন ও দুদ্দু’র ছয়শ বছর আগে পারস্যের জালালউদ্দিন রুমি লিখেছেন, ‘হে মুসলিম, আমি কী করব? আমি তো নিজেকে জানি না/ আমি খৃষ্টান নই, ইহুদি নই, অগ্নিউপাসক নই, মুসলমানও নই।/ আমি পুবেরও নই, পশ্চিমেরও নই, জলের নই, স্থলের নই/… আমি ভারতের নই, চীনের নই, বুলগারের নই সাকসিনেরও নই/ আমি এই পৃথিবীর নই, পৃথিবীর বাইরেরও নই/ স্বর্গের নই, নরকেরও নই/ স্থানহীনতা আমার স্থান, চিহ্নহীনতা আমার চিহ্ন/ আমার শরীর নেই, আত্মা নেই, আমি সকল আত্মার আত্মা/… আমি একজনকে চাই, একজনকে জানি, একজনকে দেখি, একজনকে ডাকি/ সে প্রথম, সে-ই শেষ, সে বাইরের, সে ভিতরের/ তাকে ছাড়া আমি আর কাউকে জানি না।’
রুমির বহুল প্রচারিত আরেকটি কালাম হচ্ছে— ‘সব ধর্মেই ভালবাসার কথা আছে/ ভালবাসার কোনও ধর্ম নেই/ আমার কোনও ধর্ম নেই/ ভালবাসাই আমার ধর্ম/ প্রতিটি হৃদয় আমার উপাসনাস্থল।’ রুমি লিখেছেন— ‘আমি স্রষ্টাকে খুঁজেছি খৃষ্টানদের ক্রস-এ, তিনি সেখানে ছিলেন না।/ আমি মক্কায় মুসলমানদের কাবায় গিয়েছি, তিনি সেখানেও ছিলেন না/ আমি ইহুদিদের সিনেগগ-এ গিয়েছি, হিন্দুদের প্রতিমার মন্দিরে গিয়েছি/ কিন্তু কোথাও আমি স্রষ্টার অস্তিত্ব খুঁজে পাইনি/ আমি প্রশ্ন করেছি জ্ঞানী ও দার্শনিকদের, কিন্তু স্রষ্টা ছিলেন তাদের উপলব্ধির অতীত/ এরপর আমার হৃদয়ের গভীরে তাকে খুঁজেছি, তিনি সেখানেই বিরাজ করেন।’
একই কথা লালন বলেছেন, ‘আদি মক্কা এই মানব দেহে/ দেখ না রে মন ভেয়ে।/ দেশ দেশান্তর দৌড়ে এবার মরছ কেন হাঁফায়ে।’ কিংবা— ‘ধড়ে কোথায় মক্কা মদিনে/ চেয়ে দেখ নয়নে\ ধড়ের খবর না জানিলে ঘোর যাবে না কোন দিনে।’
নিজেকে জানার ভেতর স্রষ্টাকে জানা এবং তার নৈকট্যলাভের সাধনা করেছেন সুফীরা। রুমির প্রভাব দক্ষিণ এশিয়ার সকল সুফীর ভেতর লক্ষ্য করেছি। বাংলাদেশের মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী তার ভাষণে রুমির একটি বহুল প্রচারিত উক্তি উদ্ধৃত করতেন— ‘হাজার কাবার চেয়ে একটি হৃদয় বড় জেনো।’ পাঞ্জাবের সুফী সাধক বুল্লে শাহ (১৬৮০-১৭৫৭ খৃঃ) আরও স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘মসজিদ ধ্বংস কর, মন্দির ধ্বংস কর, ধ্বংস কর সব কিছু যা তোমার ইচ্ছা, ক‘ কখনও মানুষের হৃদয়ে আঘাত কোরো না, কারণ স্রষ্টা সেখানে বিরাজ করেন।’
বুল্লে শাহও রুমি আর লালনের মতো বলেছেন, ‘বুল্লা আমি জানি না আমি কে/ আমি মসজিদের মুসল্লি নই, হিন্দুদের আচারনিষ্ঠায়ও আমি নেই/ আমি অশুদ্ধের ভেতরের শুদ্ধও নই।/… আমি আরবের নই, লাহোরের নই, ভারতের নাগোর শহরেরও নই,/ হিন্দুও নই, পেশোয়ারের তুর্কিও নই,/ আমি ধর্মের ভেতর পার্থক্য করিনি, আমি আদম হাওয়াকেও সৃষ্টি করিনি, আমি আমার নামকরণও করিনি/… আমি মুসা নই, আমি ফেরাউনও নই, আমি অগ্নি অথবা বায়ু নই/ আমি নিষ্পাপদের নগরের বাসিন্দাও নই, বুল্লে শাহ, কে তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে?’

জালালউদ্দিন রুমির প্রভাব শুধু দক্ষিণ এশিয়ার সুফীদের ওপর পড়েনি, হিন্দু ভক্তিবাদের অনুসারীরাও রুমির আত্ম-অনুসন্ধানের দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, যে দর্শনের মূল প্রোথিত রয়েছে ভারতীয় উপনিষদে। ভক্তিবাদের সবচেয়ে খ্যাতিমান সাধক কবীরের (আনুমানিক ১৪৪০-১৫১৮ খৃঃ) একটি বিখ্যাত দোঁহা হচ্ছে— ‘মোকে কাঁহা ঢুন্ডেরে বান্দে।’ বাংলা অনুবাদ হচ্ছে— ‘আমাকে কোথায় খুঁজছো? আমি তো তোমারই ভেতর/ আমি কোনও তীর্থে নেই, কোনও প্রতিমায়ও নেই/ কোনও নির্জনতায় নেই, কোনও মন্দিরে নেই, মসজিদেও নেই, কাবা কিংবা কৈলাশেও নেই/ হে মানব আমি তোমারই ভেতর বিরাজ করি।’
ভক্তিযুগের বাঙালি কবি চন্ডীদাস (১৩৩৯-১৩৯৯ খৃঃ) মানবতার যে জয়গান গেয়েছেন সেটি বাংলা সাহিত্যে প্রবাদে পরিণত হয়েছে। মূল পদে চন্ডীদাস লিখেছেন, ‘স্বরূপ বিহনে রূপের জনম কখন নাহিক হয়/ অনুগত বিনে কার্যসিদ্ধি কেমনে সাধকে কয়\/ কে বা অনুগত কাহার সহিত জানিবে কেমনে শুনে/ মনে অনুগত মঞ্জুরি সহিত ভাবিয়া দেখহ মনে\/ দুই চারি করি আটটি আখরে তিনের জনম তায়/ এগার আখরে মূল বস্তু জানিলে একটি আখর হয়\/ চন্ডীদাস কহে শুনহ মানুষ ভাই/ সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই\’
ভক্তি ও সুফী সাধকরা মানুষকে কখনও ধর্ম, বর্ণ, জাতি গোত্রের নামে বিভক্ত করেননি। লালন স্বপ্ন দেখেছেন— ‘এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে/ যে দিন হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃষ্টান/ জাতি গোত্র নাহি রবে।’
রুমি ইসলামের ভেতর মানবতাকে খোঁজার চেষ্টা করেছেন। তার মানবতাবোধ আচারধর্মের বাইরে নয়। অন্যদিকে লালনের মানবতাবোধ অনেক সময় আচারধর্মকে অতিক্রম করেছে। ‘জাত’ বলতে লালন আচারধর্ম বুঝিয়েছেন। মানবতার বোধ ধর্মে আছে, ধর্মের বাইরেও আছে— যুগে যুগে এটি সুফী সাধকরা প্রচার করেছেন।

জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমি

দুই
সুফীদের শান্তি, সহমর্মিতা ও ভালবাসার বিপরীতে অবস্থান করছে ওহাবি-সালাফি-মওদুদিবাদীদের কট্টর জিহাদি ইসলাম, যারা ক্ষমতায় যাওয়া বা থাকার জন্য হত্যা-ধর্ষণ-নির্যাতন সহ যাবতীয় মানবতাবিরোধী অপরাধকে ইসলামের নামে জায়েজ করতে চায় জিহাদের কথা বলে। ওহাবিদের আক্রমণের লক্ষ্য ভিন্নধর্ম-ভিন্নমত-ভিন্নজীবনধারায় বিশ্বাসী মানুষ। মানুষ স্রষ্টার সেরা সৃষ্টি এটা তারা বিশ্বাস করে না। তারা বিশ্বাস করে তাদের মতানুসারীরাই খাঁটি মুসলমান, বাকিরা নাস্তিক, মুরতাদ, কাফের– অতএব হত্যার যোগ্য। ইমাম ইবনে তায়মিয়া থেকে আবুল আলা মওদুদি এবং অতি সাম্প্রতিক আবু বকর আল বোগদাদী এই ফতোয়াই দিয়েছেন।
শান্তির ধর্ম ইসলামকে এভাবে তারা সন্ত্রাসের সমার্থক বানাতে চেয়েছে, যা পশ্চিমে ইসলাম বিদ্বেষের পাশাপাশি অন্য ধর্মে উগ্রতার ক্ষেত্র তৈরি করেছে। যুদ্ধ-সন্ত্রাস-ঘৃণা-বৈষম্যলাঞ্ছিত বর্তমান পৃথিবীতে সুফী বাউলদের মানবিকতার আমন্ত্রণ আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে।
ওহাবি-সালাফিরা সুফীদের শান্তি ও সম্প্রীতির ইসলাম পছন্দ করে না। কট্টর জিহাদপন্থীরা যখনই সুযোগ পেয়েছে তখনই সুফীদের উপর হামলা করেছে, তাদের আবাস ও মাজার ধ্বংস করেছে। ওহাবি-সালাফি এবং তাদের পূর্ব ও উত্তরসূরিরা সঙ্গীত, নৃত্য ও চারুকলা সহ যা কিছু মানুষের সুকুমার প্রবৃত্তির বিকাশ ঘটায় সব হারাম ঘোষণা করেছে। তাদের রাজনৈতিক ইসলাম ও ধ্বংসাত্মক জিহাদের কারণে মানব সভ্যতার বহু স্মারক ধ্বংস হয়েছে। সাম্প্রতিককালে আমরা দেখেছি— খিলাফৎ প্রতিষ্ঠার নামে ‘আইএস’-এর ওহাবিবাদী জঙ্গীরা কীভাবে ইরাক ও সিরিয়ায় মানবসভ্যতার শ্রেষ্ঠ নিদর্শনসমূহ ধ্বংস করেছে।
পাকিস্তানে রাজনৈতিক ইসলামের ধ্বজাধারী সামরিক বাহিনী এবং তাদের রাজনৈতিক দোসর ওহাবিবাদী জামায়াতে ইসলামী ১৯৭১ সালে ইসলামের দোহাই দিয়ে ৩০ লক্ষ নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে। তাদের এই গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ থেকে মসজিদে ইবাদতরত মুসলমানরাও রেহাই পায়নি।
ধর্মের নামে হত্যা, সন্ত্রাস ও ধ্বংসযজ্ঞের অবসান ঘটানোর জন্য স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে সাংবিধানিকভাবে ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। বাংলাদেশের মূল সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। স্বাধীন বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারো নাই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কারো বাধা দেয়ার ক্ষমতা নাই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, খৃষ্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হল এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না।’
বঙ্গবন্ধু ধর্মের বিরুদ্ধে ছিলেন না। তিনি ধর্মের নামে হত্যা, নির্যাতন, সন্ত্রাস বন্ধ করার পাশাপাশি ধর্মের পবিত্রতা রক্ষার জন্য ধর্মকে রাজনীতি ও রাষ্ট্র থেকে পৃথক রাখতে চেয়েছিলেন। সুফী ইসলামের সার কথাও তাই।
স্বাধীনতাবিরোধীরা ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মতো মৌলবাদী, সন্ত্রাসী ব্যর্থ রাষ্ট্র বানাবার জন্য নৃশংসভাবে হত্যা করছিল বঙ্গবন্ধু এবং তার প্রধান সহযোগীদের যাদের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়েছে, যারা প্রণয়ন করেছিলেন ১৯৭২-এর অনন্যসাধারণ সংবিধান। ’৭১-এর গণহত্যাকারীদের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলো বঙ্গবন্ধুর সরকার সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে ইসলামের নামে গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের সহযোগীদের আবার পাকিস্তানের মতো ধর্মের নামে রাজনীতি করার সুযোগ দিয়ে বাংলাদেশে ধর্মের নামে সন্ত্রাসের বিষবৃক্ষ বপণ করেছেন, যার বিষাক্ত ফল এখনও আমরা ভোগ করছি।
ধর্মের নামে রাজনীতি করার ভয়ঙ্কর পরিণাম হচ্ছে পাকিস্তান। জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা আবুল আলা মওদুদীর রাজনৈতিক জিহাদী ইসলাম পাকিস্তানকে আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে। ধর্মের নামে রাজনীতি করতে গিয়ে পাকিস্তান যে তালেবান ও আল কায়দাদের মদদ দিয়েছে তারা আজ পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে চাইছে। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে তারা পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের সেওয়ান শরীফে সুফীসাধক শাহবায কলন্দরের মাজারে আত্মঘাতী বোমা হামলা করে শতাধিক ধর্মপ্রাণ নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে, যাদের অধিকাংশ ছিল নারী ও শিশু।
২০০৪ সালে জামায়াত-বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে তাদের পোষা জঙ্গীরা সিলেটে হযরত শাহজালালের মাজারে ভয়াবহ বোমা হামলা চালিয়েছিল, যে সুফীসাধক বাংলাদেশে এসেছিলেন রুমির শান্তি ও সহমর্মিতার ইসলাম প্রচার করার জন্য। এই হামলা চালিয়ে জঙ্গীরা জেয়ারতে আসা বৃটিশ রাষ্ট্রদূত আনোয়ার চৌধুরীকে হত্যা করতে চেয়েছিল। হামলায় দুজন ভক্ত নিহত হয়েছিলেন এবং বৃটিশ রাষ্ট্রদূত গুরুতর আহত হয়েছিলেন। ২০১৬ সালের জুলাইয়ে তাদের অনুসারীরাই বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার গুলশানের একটি কাফেতে আত্মঘাতী হত্যা চালিয়ে ২৭ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে, যাদের অধিকাংশ ছিলেন বিদেশী।
বাংলাদেশে জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাসের ধর্মপিতা হচ্ছে ওহাবি-সালাফিবাদের অনুসারী জামায়াতে ইসলামী— যারা ভিন্নমত, ভিন্নধর্ম, ভিন্ন জীবনধারায় বিশ্বাসীদের ইসলামের নামে হত্যা করা ইমানি কর্তব্য মনে করে।
২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে ক্ষমতার শরিক ছিল জামায়াতে ইসলামী। বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বদান্যতায় জামায়াতের দুই শীর্ষ নেতা, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালের দুই প্রধান গণহত্যাকারী মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। যে বাংলাদেশকে তারা জন্মকালে আঁতুড়ঘরে হত্যা করতে চেয়েছিল, যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করতে গিয়ে তারা ৩০ লক্ষ স্বাধীনতাকামী বাঙালিকে হত্যা করেছিল, ক্ষমতায় এসে তারা বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মতো ব্যর্থ সন্ত্রাসী মৌলবাদী রাষ্ট্র বানাবার উদ্যোগ নিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অনুসারী ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের পাশাপাশি মুক্তচিন্তার বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতি কর্মী এবং সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করে বাংলাদেশকে জেনারেল জিয়াউল হকের পাকিস্তান ও মোল্লা উমরের আফগানিস্তানের জঙ্গী ইসলামী রাষ্ট্র বানাবার উদ্যোগ নিয়েছিল। তখন বাংলাদেশের তিন লক্ষাধিক হিন্দু নাগরিক ১৯৭১-এর মতো সর্বস্ব হারিয়ে প্রতিবেশী ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন।
২০০৮ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ৩টি জাতীয় নির্বাচনে এ দেশের জনগণ জামায়াত-বিএনপির নেতৃত্বাধীন মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক-যুদ্ধাপরাধী অধ্যুষিত জোটকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। কারণ ক্ষমতায় থাকাকালে বাংলাদেশকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়েছিল। এই পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য জামায়াত-বিএনপি জোট আরও সাধারণ মানুষকে হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। কখনও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়িয়ে, কখনও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ভণ্ডুল করার জন্য, কখনও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের নামে তারা নিরীহ মানুষকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মেরেছে, ধর্মীয় সংখ্যালঘু স¤প্রদায়ের হাজার হাজার বাড়িঘর, ধর্মীয় ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছে, ভিন্ন ধর্মের পুরোহিত, যাজক, ভিক্ষুদের হত্যা করেছে। ভিন্নমতের লেখক প্রকাশক এমনকি বিদেশী নাগরিকদের হত্যা করে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের ধারা অবরুদ্ধ করার পাশাপাশি বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত করেছে।
বাংলাদেশের মানুষ সন্ত্রাস নয়, শান্তি চায়, ৩০ লক্ষ শহীদের স্বপ্নের বাংলাদেশ দেখতে চায়— যেখানে ধর্মের নামে হানাহানি থাকবে না, যেখানে ধর্ম-বর্ণ-জাতিসত্তা নির্বিশেষে সকল মানুষ সমান অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে বাস করবে, যে দেশ বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হবে।
বাংলাদেশের মতো রুমির দেশ তুরস্কেরও সাধারণ মানুষ ধর্মের নামে হত্যা, সন্ত্রাস, ধ্বংস পছন্দ করে না। তুরস্কের মানবতাবাদী সুফীসাধক হযরত জালালউদ্দিন রুমির উপর ২০১৮ সালে ‘মিথাতের স্বপ্ন’ নামে যে প্রামাণ্যচিত্র বানিয়েছি সেখানে শান্তি ও মানবতার কথাই বলা হয়েছে। সময় যত অতিবাহিত হচ্ছে— অশান্ত সংঘাতময় বিশ্বে রুমির সর্বজনীন মানবতার দর্শন আরও প্রাসঙ্গিক হচ্ছে।
মুসলিম বিশ্বের তরুণদের একটি অংশের চেতনায় ওহাবি, সালাফী মৌলবাদ আধিপত্য বিস্তার করেছে। আমরা আশা করি একদিন এই বিভ্রান্ত তরুণরা ইসলামের সন্ত্রাস ও উন্মাদনার আচ্ছন্নতা থেকে মুক্ত হবে। কোনিয়ার তরুণ দরবেশ মিথাতের মতো ধর্মের ভেতর শান্তি, সম্প্রীতি ও সর্বজনীন মানবপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে।

লালন সাঁইজি

তিন
বর্তমান বিশ্বে যে কটি জাতি ও দেশ কয়েক সহস্রাব্দের মানব সভ্যতার ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন রেখেছে এর অন্যতম হচ্ছে তুর্কী জাতি। ১৯২৩ সালে তুরস্ক প্রজাতন্ত্র নামকরণের আগে দেশটি অটোমান স্টেট নামে পরিচিত ছিল প্রায় চারশ বছর।
তার আগে ছিল বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য এবং তারও আগে খৃষ্টপূর্ব ১৬০০ থেকে ১১৮০ সাল পর্যন্ত এই ভূখন্ড ছিল হিট্টাইট সাম্রাজ্যের অংশ যা আনাতোলিয়া নামেও পরিচিত।
সভ্যতার উষালগ্ন থেকে এশিয়া ও ইউরোপের সংযোগকারী এই দেশটি বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষদের আকৃষ্ট করেছে বিভিন্ন কারণে। এখনও তুরস্কের প্রধান নগর ইস্তাম্বুল বিশ্বের তাবৎ পর্যটকদের পছন্দের শীর্ষে অবস্থান করছে। শুধু ইস্তাম্বুল নয়, তুরস্কের কোনিয়া, কাপাদোকিয়া, ইজমির, বুরসা, চানাক্কালে, সানউরফা, আনতালিয়া, আঙ্কারা, মারদিন প্রভৃতি শহরে ভ্রমণানুরাগীদের ভিড় চোখে পড়ার মতো।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর সুফী কবি জালালউদ্দিন রুমি, তুরস্কের মানুষ যাকে শ্রদ্ধাভরে ‘হযরত মেভলানা’ সম্বোধন করেন, জীবনের শেষ ৫০ বছর কাটিয়েছেন মধ্যযুগের সেলজুক সুলতানদের রাজধানী কোনিয়ায়— বর্তমানে তুরস্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ নগর। রুমি এবং তার বন্ধু ও পথপ্রদর্শক শামস-এর মাজারও এই কোনিয়ায়।
তুরস্কের প্রতি আমার আকর্ষণের প্রধান কারণ রুমি ও শামসের মানবতার আমন্ত্রণ, যাদের দরজা ধার্মিক-অধার্মিক সব মানুষের জন্য উন্মুক্ত। মানবতার এই আমন্ত্রণে বার বার তুরস্ক গিয়েছি। পরিচিত ও বন্ধুর সংখ্যা ক্রমশঃ বেড়েছে। কাজের প্রয়োজনে, কখনও কাজের ফাঁকে তুরস্কের বিভিন্ন জনপদ ঘুরেছি, কথা বলেছি রাজনৈতিক নেতা, ধর্মীয় নেতা, শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবী সহ শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের সঙ্গে। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। ভ্রমণে তৃষ্ণা মেটানোর পাশাপাশি জানতে চেয়েছি সুফীবাদের মানবিক অভিব্যক্তি।
২০১৩ সালের জুন থেকে ২০২০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত অন্ততপক্ষে পনের বার তুরস্ক সফর করেছি। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে লিখেছি। বর্তমনা গ্রন্থে পুরনো ও নতুন সব লেখাই আছে। তুরস্কের সুফীসাধক জালালউদ্দিন রুমিকে নিয়ে ২০১৮ সালে ‘মিথাতস ড্রিম’ নামে যে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলাম সেটি নির্মাণের কাহিনীও এই গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। ভ্রমণের আনন্দ ছাড়াও সুফীদের মানবতাবাদ কেন এখনও প্রাসঙ্গিক এ প্রশ্নের জবাব আশা করি এ গ্রন্থে পাওয়া যাবে।
আমার বিদেশ ভ্রমণ এবং লেখালেখির সূচনা ঘটেছে ১৯৬৭ সালে। এরপর একে একে পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। প্রায় পঞ্চাশটি দেশ সফর করেছি। এখন জীবন সায়াহ্নে এসেও ভ্রমণের তৃষ্ণা মেটেনি। তবে এখন আর নিছক ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বিদেশ যাওয়া হয় না। দেশের বাইরে যেতে হয় কাজের সুবাদে। তবে যতো কাজই হোক ফাঁক পেলেই ভ্রমণের তৃষ্ণা মেটানোর চেষ্টা করি।
২০১৯ সালের বইমেলায় প্রকাশকের আগ্রহে আমার বিদেশভ্রমণকেন্দ্রিক নয়টি গ্রন্থ ‘ভ্রমণসমগ্র’ শিরোনামে দুই খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। তখন মনে হয়েছিল আমার ভ্রমণকাহিনী লেখার ইতি ঘটেছে। ভ্রমণসমগ্র প্রকাশের পর ভ্রমণ বন্ধ না হলেও আবার ভ্রমণ কাহিনী লিখব তখন ভাবিনি। গত সাত বছর ধরে নানা কারণে তুরস্ক যাচ্ছি। বিদেশে আমার প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে মানবসভ্যতা এবং সংস্কৃতি। অনুষঙ্গ হিসেবে ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সাহিত্য, দর্শন সহ কিছুই থাকে, তবে সবার ওপরে মানুষ।
যে সব পাঠক আমার ভ্রমণ কাহিনীর সঙ্গে পরিচিত তারা নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন আমি মানুষের সঙ্গে কথা বলতে ভালবাসি। পরিচিতজনরা জানেন আমি একজন মনোযোগী শ্রোতা। আমি লক্ষ্য করেছি দেশ, কাল নির্বিশেষে সর্বত্র মানুষ ভালোবাসার কাঙাল। তুরস্কের সুফীসাধক জালালউদ্দিন রুমি ও ইরানের শামস তাবরিজি থেকে আরম্ভ করে বাংলাদেশের লালন শাহ সবাই নিঃস্বার্থভাবে মানুষকে ভালোবাসার কথা বলেছেন। আমার বার বার তুরস্ক যাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে রুমির জন্য ভালোবাসা।
আমার মনে হয়েছে— রুমির মানবতাবাদী দর্শন তুরস্কের সাধারণ মানুষের চেতনাকে যেভাবে আলোকিত করেছে একইভাবে আকৃষ্ট করেছে গোটা পৃথিবীর মানবতাবাদীদের। ইসলামের নামে জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাসের পাল্টা বয়ান হতে পারে রুমি সহ সুফীসাধকদের মানবতার ইসলাম— এই ধারণা বিধৃত হয়েছে তুরস্কের হযরত জালাল উদ্দিন রুমির উপর নির্মিত আমার ‘মিথাতের স্বপ্ন’ ও ‘হাকানের শান্তিযাত্রা’ শীর্ষক দুটি প্রামাণ্যচিত্রে।
২০১৩ সাল থেকে আমার তুরস্ক ভ্রমণ আরম্ভ হয়েছে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে যখন তুরস্ক ভ্রমণ কাহিনীর ভূমিকা লিখছি তখন হিসেব করে দেখেছি এ বছর আরও তিন বার আমাকে তুরস্কে যেতে হবে। ইউরোপের যে কোনও দেশে কোনও অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পেলে হাতে যদি সময় থাকে যাওয়া কিংবা আসার বেলায় টুপ করে ইস্তাম্বুল নেমে পড়ি। তুরস্কে আমার বাম, ডান, মধ্যপন্থী সব ধরনের বন্ধু আছে। বন্ধুরা যদি দু মাস আগেও জানতে পারে আমাকে কেন্দ্র করে যে যার মতো অনুষ্ঠান পরিকল্পনা করবে। কখনও লণ্ডন যাওয়ার সময়, কখনও প্যারিস, জেনেভা, ব্রাসেলস, আমস্টার্ডাম কিম্বা স্টকহোম যাওয়া-আসার পথে তুরস্কের বন্ধুরা আমন্ত্রণ জানাবার উপলক্ষ্য খোঁজেন।
আগামীতে হয়তো আরও বহুবার তুরস্কে যাব। আরও নতুন মানুষের সঙ্গে দেখা হবে। এ গ্রন্থের পরবর্তী সংস্করণের কলেবর আশা করি আগামীতে আরও বাড়বে। মানবতার এই যাত্রা কখনও শেষ হওয়ার নয়। আমরা না থাকলেও আমাদের উত্তরসূরিরা এ যাত্রা অব্যাহত রাখবে। 

https://youtu.be/bAk0f4Vr0Os?t=21