২৮ এপ্রিল কল্যাণপুর গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের দোসররা রাজধানীর কল্যাণপুরে শত শত মানুষকে পশুর মতো জবাই করে হত্যা করেছিল। ঘটনার দিন ভোর থেকেই মিরপুর ও মোহাম্মদপুর থেকে আগত বিহারিরা এবং তাদের কিছু দোসর কল্যাণপুরে এসে বাঙালি নিধন ছাড়াও তাদের ঘরবাড়ি লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, হত্যা ও নারী নির্যাতন শুরু করে। এ গণহত্যাকে ‘কল্যাণপুর গণহত্যা’ বলা হলেও এর বিস্তার ছিল পাইকপাড়া, পীরেরবাগ, আহম্মদনগর, শ্যামলী, টেকনিক্যাল, গাবতলী থেকে গৈদ্দারটেক পর্যন্ত।
ভুক্তভোগীদের জবানবন্দী নিয়ে কল্যাণপুর গণহত্যার ওপর আমি একটি বই রচনা করি। ভুক্তভোগীদের একজন ছিলেন প্রকৌশলী হায়দার আলম চৌধুরী স্বপন, যিনি তার পিতার বিভৎস মৃত্যু দৃশ্য সচক্ষে দেখেছেন। সে সময় তার বয়স ছিল ১২ বৎসর। কলাবাগান লেক সার্কাস স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়তেন তিনি। গত বছর হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন স্বপন। তার জবানবন্দীর অনুলিখন নীচে দেওয়া হলো—
কল্যাণপুরের ১২ নম্বর রোডের ২ নম্বর বাড়িটি আমাদের। ’৭১ সালের ২৮ এপ্রিল ভোর বেলায় আমি নীচ তলায় বসে ছিলাম। হঠাৎ বাড়ির বাইরে শোরগোল ও মানুষের দৌড়াদৌড়ির শব্দ শুনতে পেলাম। প্রতিবেশী কিছু লোকজন দৌড়ে আমাদের বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল। তারা বাবাকে বললো বিহারীর ও পাকিস্তানি আর্মিরা কল্যাণপুর আক্রমণ করেছে। বাঙালিদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে। বাঙালি পেলেই হত্যা করছে। আমাদের বাড়িটি পাকা এবং দোতালা ছিল। তাই আশপাশের লোকজন নিরাপদ ভেবে আমাদের বাড়িতে জড়ো হতে লাগলো। বাবা ছিলেন পাকিস্তান অবজারভারের প্রেস ম্যানেজার। তিনি ছিলেন জনদরদী ও সমাজসেবক। বাড়িটি তিনি বিপন্ন মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দিলেন।
দেখতে দেখতে আমাদের বাড়ির ভেতর লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল। ভেতর থেকে বাড়ির মূল দরজাটি বন্ধ করে দেওয়া হলো। সবাই মৃত্যু ভয়ে উৎকন্ঠিত ছিল। অনেকে দোয়া দরূদ পড়তে লাগলেন। এমন সময় ঘাতকেরা দরজায় কড়া নাড়তে লাগলো। পড়ি কি মরি বাড়ির ভেতর যে যেখানে পারলো লুকাতে শুরু করলো। আমিও ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে বেড রুমের খাটের নীচে লুকালাম। ঘাতকেরা দরজা ভেঙ্গে হৈ হৈ রৈ রৈ করে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়লো। কয়েকজন বিহারীরা লাঠিসোটা নিয়ে আমি যে রুমে লুকিয়েছিলাম সেই রুমে প্রবেশ করলো। তারা হাতুড়ি শাবল দিয়ে আলমারী ও বাক্স ভেঙ্গে লুটপাট করতে লাগলো। আমি ভয়ে খাটের নীচে গুটিসুটি হয়ে রইলাম। লুটপাট শেষে বিহারীগুলো আমার রুম থেকে বের হয়ে গেল। আমিও খাটের নীচ থেকে বের হয়ে এলাম।
এমন সময় কেউ একজন আমার পাঁচ ছয় মাসের ছোট বোন রিতাকে এনে আমার কোলে দিয়ে গেল। এত লোকের হট্টগোল চেঁচামেচিতে ভয় পেয়ে সে কাঁদছিল। আমি রীতাকে কোলে নিয়ে পাশের রুমে দৌড়ে ঢুকে গেলাম। রুমটা ভর্তি লোক, পনেরো বিশ জনের কম হবে না। আমি ঢোকার সাথে সাথে কেউ একজন রুমের দরজা বন্ধ করে দিল। সঙ্গে সঙ্গে বাইরে থেকে বিহারীরা দরজায় আঘাত করতে লাগলো। তারা দরজা ভাঙার চেষ্টা করছিল। কিন্তু ভাঙতে পারছিল না। আমি রুমে দৌঁড়ে ঢোকার সময় ওরা আমাকে দেখেছিল। তাই ওরা বলতে লাগলো, ‘এই খোকা দরজা খোল, তোমাকে আমরা কিছু বলবো না।’
কয়েকবার বলার পর আমি ভয়ে দরজা খুলে দিয়ে ছোট বোনকে কোলে নিয়ে বের হয়ে আসলাম। রুমের ভেতর এত বাঙালি একসাথে পেয়ে তারা উল্লাসে ফেটে পড়লো। হত্যাকে উৎসব ভেবে এসব নরপিশাচেরা রুমের ভেতরের অসহায় লোকগুলোকে আদিম হিংস্রতায় খুন করতে লাগলো। চিৎকার, আহাজারি ও ক্রন্দনে এক বর্ণনাতীত হৃদয়বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হলো। ঘাতকেরা কাউকে বর্ষা ও শাবল দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আবার কাউকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে আধমরা করে মেঝেতে ফেলে পশুর মতো জবাই করতে লাগলো। রক্তে আমাদের মেঝে ভেসে যাচ্ছিল। এ সময় অন্যান্য রুম থেকেও ধস্তাধস্তি ও মৃত্যু চিৎকার ভেসে আসছিল। বোঝা যাচ্ছিল সেখানেও চলছিল মানুষ হত্যার বিভৎসতা।
এই ভীতিকর দৃশ্য দেখে আমি বোধশক্তি হারিয়ে ফেললাম। কতক্ষণ আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম বলতে পারব না। একসময় সবগুলো রুমেই মানুষের আর্তচিৎকার থেমে গেল। বোঝা গেল কোনো রুমেই আর কোনো জীবিত মানুষ নেই। খুন করা শেষ করে ঘাতকরা রক্তাক্ত ধারালো অস্ত্র নিয়ে ক্ষিপ্র গতিতে বের হয়ে যেতে লাগলো। কিন্তু তখনো বিভিন্ন রুম থেকে মানুষের গোঙরানোর শব্দ ভেসে আসছিল। ঘাতকরা একে একে সব বের হয়ে গেলে আমিও দুরু দুরু বক্ষে আমার বোনকে কোলে নিয়ে বাড়ির বাইরে বের হয়েই দেখি এক করুণ ও হৃদয়বিদারক দৃশ্য। আমার বাবা মাটিতে পড়ে গোঙরাচ্ছেন। কোনো কিছু দিয়ে তার মাথা থেতলে দেওয়া হয়েছে। মাথা থেকে ঘিলু বের হয়ে গেছে। বাবার অদূরে পড়ে আছেন আমার মহিউদ্দিন মামা (জালাল নানার ছেলে)। মামার পেট কাঁটা। ওনাকে জবাই করা হয়েছে। উনিও গোঙরাচ্ছেন জবাই করা গরুর মতো। সে এক বিভৎস দৃশ্য।
বাবার এই করুণ পরিণতির বিবরণ পরে মায়ের কাছে শুনেছি। বিহারীরা যখন দরজা ধাক্কাচ্ছিল তখন বাবা দরজা খুলে দিয়েছিলেন। বিপদ টের পেয়ে মা তখন বাবার পাশেই ছিলেন। দরজা খুলে দিয়ে বাবা বিহারীদের বলেছিলেন, ‘তোমরা আমার বাসার যা আছে সব নিয়ে যাও। কিন্তু এসব নিরীহ মানুষ মেরো না। মানুষ মারা ভালো না।’ কথা শেষ না হতেই একজন বিহারী বাবার সার্টের কলার ধরে হিড়হিড় করে ঘরের বাইরে টেনে নিয়ে গেল। আরেকজন বিশালাকৃতির শাবল দিয়ে বাবার মাথায় প্রচণ্ড আঘাত করলো। আঘাতে বাবার মাথার ঘিলু ছিটকে বের হয়ে গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে বাবা মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিলেন।
আমাদের বাড়ির সকল যুবক এবং বয়স্ক বাঙালিদের হত্যা নিশ্চিত করে বিহারীরা চলে যাবার পর মা আমাদের কাজের ছেলে নুরুজ্জামানকে পানি আনতে বললেন। নূরুজ্জামান পানি আনলে মা বাবার মাথায় পানি ঢালতে লাগলেন। দূর থেকে কয়েকজন বিহারী মায়ের পানি ঢালার দৃশ্য দেখে আবারো রুদ্রমূর্তি ধারণ করে ছুটে আসলো। তারা বাবাকে আবার আঘাত করতে উদ্যত হলো। মা তাদের হাতেপায়ে ধরে বিরত করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু নরপিশাচদের হৃদয় কিছুতেই গলাতে পারলেন না। একজন ঘাতক গরু জবাইয়ের একটা ছুরির মাথা বাবার বাম পাঁজরে চাপ দিয়ে ধরে পুরো ছুরিটাই বুকের ভিতর ঢুকিয়ে দিল। বাবার বুক থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে মায়ের শাড়ি ও সমস্ত শরীর ভিজিয়ে দিল। বাবার বুকের ভেতর ছুরি ঢোকানোর নির্মম দৃশ্য আমি কখনো ভুলতে পারি না।
এ সময় একজন বয়স্ক লোক বিহারীদের ধাওয়া খেয়ে আমাদের সিঁড়ির কাছে লুকিয়ে ছিলেন। বর্তমান কল্যাণপুর গার্লস স্কুল এন্ড কলেজের কাছে তার একটি দোকান ছিল। বাবার বক্ষপিঞ্জরে ছুরি চালিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করার পর পরই ঘাতকেরা বৃদ্ধ লোকটিকে দেখে ফেললো। ঘাতকদের কয়েকজন দৌঁড়ে যেয়ে বৃদ্ধ লোকটিকে ধরে এনে আমাদের বাড়ির সামনে উপুড় করে ফেলে দিল। তারপর দুজন বিহারী একটা শাবলের দুমাথা দুদিক থেকে ধরে বৃদ্ধের ঘাড়ে এমন অভিনব কায়দায় সজোরে চাপ দিল যে ঘাড়টি মট করে ভেঙ্গে গেল। তারপর আরেকজন বড় একটা হাতুড়ি দিয়ে বৃদ্ধের মাথায় তীব্র আঘাত করলো। আঘাতে মাথা ফেটে ঘেলু বেরিয়ে গেল। বৃদ্ধ লোকটি গোঙরাতে লাগলেন।
এমন সময় একটা পনেরো ষোলো বৎসরের ছেলে আমাদের করিডোর দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ করে তার লুঙ্গিটা খুলে গেল। বিহারীরা দৌড়ে মুরগী ধরার মতো ছেলেটিকে ধরে ফেললো। তারপর ছেলেটির পুরুষাঙ্গটি কেটে দিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। একটার পর একটা রোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড দেখে মৃত্যু ভয়ে আমি কাঁপছিলাম। মনে হলো ওরা যেকোন সময় আমাকেও মেরে ফেলবে। আমার বড় ভাই সারোয়ার আলম চৌধুরী পবন বাবার রক্তাক্ত দেহের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল। তখন তার বয়স ছিল তেরো চৌদ্দ বছর। এই সময় সতেরো আঠারো বছরের কয়েকটি বিহারী ছেলে তাকে ছুরি মারতে যাচ্ছিল। কিন্তু আমাদের পাড়ার কয়েকজন বিহারী বয়স্ক ব্যক্তির হস্তক্ষেপে সে বেঁচে যায়। নুরুজ্জামান ছাড়াও আরোও একজন কাজের ছেলে আমাদের ছিল। ওরা দুজন এ সময়ে বাড়ির ভেতর পালিয়েছিল। ঘাতকরা বাড়ির ভেতর যেয়ে তাদেরকেও হত্যা করলো। আমাদের বাড়ির ভেতর এবং বাইরের সকল যুবক ও বয়স্ক বাঙালির মৃত্যু নিশ্চিত করে ঘাতক বিহারীরা খুনের নেশায় অন্যত্র ছুটলো।
ঘাতক বিহারীরা চলে গেলে পাড়ার একজন পরিচিত বিহারী কসাই আমাদের সাহায্যে এগিয়ে এলো। সে বললো, তোমাদের জন্য এ জায়গা নিরাপদ নয়। তোমরা আমার সাথে চলো। সে আমাদের কল্যাণপুর জামে মসজিদে নিয়ে গেল। সেখানেও একজন পরিচিত বিহারী নাপিত ছিল। তারা দুজনে মসজিদের ভেতর আমাদের ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে তালা মেরে দিল। মসজিদের ভেতর ঢুকেই দেখি অসংখ্য মানুষ সেখানে আশ্রয় নিয়েছে। মিরপুর এবং মোহাম্মদপুরের বিহারীরা তালা দেখে যেন মনে করে মসজিদের ভেতর কেউ নেই সেজন্য তারা এ ব্যবস্থাটি করেছিল।
আমার পাঁচ ছয় বছরের বোনটি যাতে কান্নাকাটি না করে সেজন্য দুধ দিয়ে শান্ত রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কল্যাণপুরে ই.পি.আর.টি.সি (বর্তমান বি.আর.টি.সি)-র বাস ডিপো হওয়াতে মসজিদের ভেতর তৎকালীন ই.পি.আর.টি.সি-র বহু বাঙালি ড্রাইভার, কন্ডাক্টর ও কর্মচারীরা বিহারীদের হাত থেকে বাঁচার জন্য আশ্রয় নিয়েছিল। দুপুরের দিকে বিহারী নাপিতটি মসজিদের দরজার তালা খুলে দিয়ে জানালো বিহারীরা চলে গেছে। সে আমাদের সবাইকে দ্রুত সরে পড়ার পরামর্শ দিল। কল্যাণপুরে বসবাসকারী বেশীরভাগ বিহারী লুটতরাজ ও বাঙালি নিধনে অংশগ্রহণ করলেও কসাই ও নাপিতের মতো দুএকজন বিহারী আমাদের জীবন রক্ষার্থে এগিয়ে এসেছিল।
মসজিদ থেকে বের হয়ে বেশীরভাগ লোকজন ই.পি.আর.টি.সি-র বাস ডিপোর দিকে ছুটলো। আমাদের পরিবারের বিপর্যস্ত অবস্থা দেখে কিছু ই.পি.আর.টি.সি-র কর্মচারী আমাদের বাস ডিপোতে নিয়ে গেল। বাস ডিপো থেকে ই.পি.আর.টি.সি-র কর্মচারীরা একটা বাস বের করে আমাদের সহ উপস্থিত সব বাঙালি তুলে নিল। দ্রুত গতিতে বের হয়ে যাবার সময় বাসটিকে কিছু বিহারী ধাওয়া করলো। কিন্তু তারা বাসটি থামাতে ব্যর্থ হল। ই,পি.আরটিসি-র বাসটি আমাদের মহাখালীর কাছাকাছি কোথায়ও এক জায়গায় নামিয়ে দিয়েছিল। আমার মায়ের শরীরে তখনও বাবার রক্তমাখা শাড়ীটি ছিল। এই অবস্থায় আমরা রিকসায় চড়ে মহাখালীর টি.বি হাসপাতালের কলোনীতে মায়ের মামার বাসায় গেলাম। আমরা কটি ভাই বোন এবং মা যতদিন বেঁচে আছি ততদিন আমাদের একাত্তর সালের ২৮ এপ্রিলের দুঃসহ স্মৃতি বয়ে বেড়াতে হবে।
লেখক: সাংগঠনিক সম্পাদক, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।