পুলিশের হাতে ৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ডের একটি ঠাণ্ডা মাথার খুন
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লয়েড হত্যায় বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে পুরো বিশ্ব
মিনেসোটা রাজ্যের মিনিয়াপোলিস শহরে পুলিশের নির্যাতনে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের (২৫ মে) মৃত্যু নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে প্রতিবাদের আগুন ছড়িয়ে পড়ার পর সেই ক্ষোভ বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত হয়েছে।
লন্ডন, আমস্টারডাম এবং স্টকহোম সহ ইউরোপের বড় বড় শহরগুলিতে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমেছে এবং দেশে এবং বিদেশে পুলিশের বর্বরতা এবং বর্ণবাদ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে।
ইইউ বলেছে যে, জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যার ফলে আমরা “শোকস্তব্ধ ও হতবাক” হয়েছি, যার মৃত্যু ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রতিনিধিত্ব করে, ইইউর পররাষ্ট্রনীতি প্রধান জোসেপ বোরেল এক সংবাদ সম্মেলনে একথা বলেন। ন্যায়বিচার ও শান্তির দাবিতে সমগ্র ইউরোপের জনতা “ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার” এবং “আমি শ্বাস নিতে পারছি না”, স্লোগান দেয়।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ৫ জুন কানাডার পার্লামেন্ট হিলে বর্ণবাদবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নিয়ে়ছিলেন এবং বিক্ষোভকারীদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে প্রকাশ্যে হাঁটু গেড়েছিলেন। ট্রুডো বলেন, “ভয় এবং ত্রাসের মধ্যে থেকে আমরা খেয়াল করছি যুক্তরাষ্ট্রে আসলে কী ঘটছে। দশকের পর দশক ধরে ধারাবাহিক অগ্রগতি সত্তে¡ও এ ধরনের অবিচারগুলো অব্যাহত রয়েছে —যা বোঝার এবং শোনার সময় এসেছে।” (দ্যা গার্ডিয়ান, ৩ জুন, ২০২০)
জার্মানির চ্যাঞ্চেলর অ্যাঞ্জেলা মের্কেল জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, “জর্জ ফ্লয়ে়ডের এই হত্যাকাণ্ড অত্যন্ত ভয়াবহ। বর্ণবাদ ভয়ঙ্কর কিছু। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ খুবই একচোখা।” (ডেইলি মেইল, জুন ৪, ২০২০)
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, “আমেরিকার জনগণের কাছে আমি এই বার্তাটাই পৌছে দেব যে, আমাদের সমাজে বর্ণবাদী সহিংশতার কোনও জায়গা নেই। ব্রিটিশ জনগণের বর্ণবাদের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করার অধিকার রয়েছে। তবে এই মুহূর্তে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে তা করা উচিৎ।” (বিবিসি, জুন ৩, ২০২০)
নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আর্ডেন জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুতে ‘আতঙ্কিত’ হয়ে়ছিলেন এবং সংহতি প্রকাশের জন্য নিউজিল্যান্ডে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকে স্বাগত জানিয়ে়ছিলেন। একইসাথে তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে, সামাজিক দূরত্বের নিষেধাজ্ঞাগুলি যেন অগ্রাহ্য না হয়। (দ্যা গার্ডিয়ান, জুন ৫, ২০২০)
এদিকে জর্জ ফ্লয়েডের নৃশংস মৃত্যুতে বিশ্বব্যাপী সৃষ্ট বিক্ষোভ অনুসরণ করে আফ্রিকান আমেরিকানদের সাথে একাত্মতায় বিবৃতি দিয়েছে ১০৫ জন আফ্রিকান লেখক। বিবৃতি তারা জর্জ ফ্লয়েড ছাড়া সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে আরও অনেক কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে তারা লেখেন—
আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বজুড়ে বিক্ষোভকে সমর্থন করি, কারণ পুলিশ বা বেসামরিক নাগরিকের দ্বারা হোক না কেন এবং যে কোনো জাতিগত হত্যার জন্য আমরা বিচার দাবি করি। আমরা বুঝতে পারছি যে, এগুলি নিরব প্রতিবাদ নয়। আমরা এ ধরনের কিছু আশা করি না এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের উচিৎ নয় এ ধরনের হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হওয়া। এটি একটি চুপচাপ হত্যাকাণ্ড নয়। পুলিশ বর্বরতা এবং রাষ্ট্রীয় অনুমোদিত হত্যাকান্ডগুলি সবসময়ই ঘটেছে সাড়ম্বরে কোনো ধরনের বিচারের মুখোমুখি হবার ভয় না পেয়ে।
ফ্লয়েডের মৃত্যুর এক সপ্তাহের মাথায় (২ জুন) আসা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেভাবে তার মৃত্যু হয়েছে, সেটা ‘হত্যাকাণ্ড’।
তাতে পরিষ্কার বলা হয়েছে, হাঁটু দিয়ে তার গলা চেপে ধরেছিল পুলিশ। এর ফলে শ্বাসকষ্ট শুরু হয় জর্জ ফ্লয়েডের। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় তার। এটা খুনের ঘটনা।
এর আগে, জর্জ ফ্লয়েডের পরিবারের তরফে আলাদা করে ময়নাতদন্ত করা হয়েছিল। তাতেও গোটা ঘটনাকে খুন বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। শরীরে অক্সিজেন পৌঁছতে না পারায় তার মৃত্যু হয়েছিল বলে জানানো হয়।
যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ ছড়িয়ে দেওয়া এ ঘটনার সূত্রপাত ২৫ মে মিনিয়াপোলিসের স্থানীয় সময় সন্ধ্যায়।
এক খাবারের দোকানের কর্মচারী ৯১১ এ কল করে অভিযোগ করেন, এক ক্রেতা সিগারেট কেনার পর ২০ ডলারের জাল নোট দিয়েছে। পুলিশ এসে ওই অভিযোগে ৪৬ বছর বয়সী জর্জ ফ্লয়েডকে গ্রেপ্তার করে।
নিউ ইয়র্ক টাইমস এক প্রতিবেদনে বলেছে, ঘটনাস্থলে পুলিশের গাড়ি আসার ৭২ মিনিট পর রাস্তায় তিন পুলিশের নিচে চাপা পড়ে থাকা ফ্লয়েড অচেতন হয়ে ছিলেন, তার মধ্যে প্রাণের কোনো লক্ষণ ছিল না।
পথচারীদের মোবাইলে ধারণ করা ভিডিও, সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ এবং দাপ্তরিক নথি পর্যালোচনা করার পাশাপাশি বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে ওই সময়ের ঘটনাগুলো জোড়া দিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছে নিউ ইয়র্ক টাইমস।
তাদের ভিডিও দেখিয়েছে, ঘটনার শুরু থেকে পুলিশ কর্মকর্তারা ধারাবাহিকভাবে যেসব আচরণ করেছেন, তাতে মিনিয়াপোলিস পুলিশ বিভাগের নিয়ম লঙ্ঘন হয়েছে।
শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক কাকুতি-মিনতি করেছিলেন ফ্লয়েড। প্রত্যক্ষদর্শীরা তাকে সাহায্য করার অনুরোধ জানালেও পুলিশ তাতে সাড়া দেয়নি।
ফ্লয়েডের মৃত্যুর পরদিন ২৬ মে ওই ঘটনায় জড়িত চার পুলিশ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করে পুলিশ বিভাগ।
এরপর শুক্রবার হেনেপিন কাউন্টি অ্যাটর্নি মাইক ফ্রিম্যান বরখাস্ত পুলিশ কর্মকর্তা ডেরেক শভিনের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনেন।
বিভিন্ন ভিডিওতে পরিষ্কারভাবে এই শভিনকেই ফ্লয়েডের ঘাড়ে হাঁটু তুলে দিয়ে রাস্তার সঙ্গে চেপে ধরে রাখতে দেখা যায়।
তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগে বলা হয়েছে, শ্বেতাঙ্গ ওই পুলিশ সদস্য ফ্লয়েডের ঘাড়ে হাঁটু দিয়ে ৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড ধরে চেপে রেখেছিলেন।
ভিডিওতে দেখা গেছে, ফ্লয়েড অচেতন হয়ে যাওয়ার পরও শভিন তার হাঁটু সরাননি। চিকিৎসাকর্মীরা ঘটনাস্থলে আসার পরও পুরো এক মিনিট ধরে ফ্লয়েডের ঘাড় চেপে ধরে রেখেছিলেন তিনি।
ঘটনার সময় সেখানে আরও তিন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন, তারা হলেন টমাস লেইন, জে. আলেকজান্ডার কুয়ং ও টু থাও। ফ্লয়েডের মৃত্যুর ঘটনায় তাদেরও বরখাস্ত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে।
পুলিশের গুলিতে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রে এটা নতুন নয়। ২০১৩ থেকে ২০১৯ -এই ৬ বছরে আমেরিকায় পুলিশের হাতে মৃত্যু হয়েছে ৭৬৬৬ জন কৃষ্ণাঙ্গের। আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ মোট জনসংখ্যার ১৩ শতাংশ। পুলিশি অত্যাচার তাদের উপরই বেশি বলে সবসময়ই অভিযোগ রয়েছে। তবে জর্জের হত্যার প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন সব বর্ণের মানুষ। (বাংলাদেশ প্রতিদিন, জুন ৩, ২০২০)
আদিবাসী নিধন, দাসপ্রথা এবং বর্ণবাদের করুণ সাক্ষী আজকের এই প্রভাবশালী যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্রে দাসপ্রথা এবং বর্ণবাদের শুরুর দিকের সাথে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। আমেরিকা স্বাধীন হবার পর যেটি তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ক্রিস্টোফার কলম্বাসের স্পেনীয় সমুদ্রযাত্রার ১৪৯২ সালের আগে আমেরিকার আদিবাসীদের জনসংখ্যার সঠিক সংখ্যাটি প্রতিষ্ঠা করা তাই কঠিন প্রমাণিত হয়েছে। পণ্ডিতেরা সব সময়ই ঔপনিবেশিকদের দেওয়া উপাত্ত থেকে উপসংহারে পৌছুতে চেয়েছে। তারপরেও ধারণা করা হয় যে, কলম্বাস আমেরিকায় যখন পৌছাই তখন আটলান্টিকের তীরে উত্তরের এ ভূখণ্ডে আদিবাসীদের সংখ্যা ছিল পাঁচ কোটি থেকে দশ কোটি।
ইউরোপীয়দের সাথে যোগাযোগ স্থাপন হওয়ার পর আমেরিকা ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকরণের দিকে পরিচালিত হয়, যেখানে ইউরোপ থেকে লক্ষ লক্ষ অভিবাসী অবশেষে আমেরিকাতে বসতি স্থাপন করে। এরপর আমেরিকায় আফ্রিকান এবং ইউরেশীয় জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং আদিবাসী জনসংখ্যা হ্রাস পেয়েছে, এমনকি ধারণা করা হয় অন্তত নব্বই ভাগ আদিবাসী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আজ সেখানে যে কালোদের আমরা দেখি তারাও মূলত অভিবাসী, যদিও আমেরিকা ভূখণ্ডের ইতিহাস মূলত কালোদেরই ইতিহাস হওয়ার কথা।
ঔপনিবেশিকদের দ্বারা শত শত বৎসর ধরে আদিবাসী এবং অভিবাসী কালোরা যুক্তরাষ্ট্রে নির্যাতনের শিকার হয়ে আসলেও যথাযথভাবে গণহত্যার অভিযোগটি উত্থাপিত হয় ১৯৫১ সালে। অর্থাৎ দীর্ঘসময় ধরে ভয়ঙ্কর সামাজিক এবং আইনি বিচারহীনতার মধ্য দিয়ে দাসপ্রথা, বর্ণবাদ এবং গণহত্যার মতো ভয়াবহ অপরাধ পরিচালিত হয়েছে আমেরিকান ভূখণ্ডে।
অনেক ইতিহাসবিদ আমেরিকাতে দাসত্বের সূচনার দিকটিকে ১৬১৯ সাল বলে মনে করেন, এ সময় বেসরকারি কোম্পানি ‘হোয়াইট সিংহ’ ভার্জিনিয়ার জেমসটাউন ব্রিটিশ উপনিবেশে ২০ জন আফ্রিকান ক্রীতদাসকে তীরে নিয়ে এসেছিল। ব্রিটিশ নাবিকেরা পর্তুগিজ ক্রীতদাস জাহাজ সাও জাও বাউটিস্তা থেকে আফ্রিকানদের দাস হিসেবে ধরেছিল। সপ্তদশ শতাব্দী জুড়ে উত্তর আমেরিকাতে ইউরোপীয় বসতি স্থাপনকারীরা স্বস্তা হিসেবে আফ্রিকান দাসদের দিকে ফিরে যায়, দরিদ্র ইউরোপীয়রা তখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক ছিল, তবে দ্রুতই মালিকেরা দাসদের দিয়ে কাজ করানো অধিক উপযোগী বলে মনে করে। (হিসটরি.কম)
গত পাঁচশো বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কালো গণহত্যা অতীত এবং বর্তমান উভয় ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার এবং সাদা অভিবাসী আমেরিকানদের দ্বারা এমনভাবে পরিচালিত হয়ে আসছে যা একটি জাতিগোষ্ঠীকে পরিকল্পিতভাবে সমূলে ধ্বংস করার মতোই। দশকের পর দশক ধরে দীর্ঘকালীন জাতিগত এ বৈষম্যকে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে সিভিল রাইটস কংগ্রেসের পক্ষ থেকে গণহত্যা হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল যেটি ১৯৫১ সালে, যেটি জাতিসংঘে জমা দেওয়া হয়েছিল। ম্যালকম এক্স মার্কিন সরকারকে দীর্ঘমেয়াদী অবিচার, নিষ্ঠুরতা এবং হোয়াইটদের দ্বারা কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে সহিংসতার কথা উল্লেখ করে সাদাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর অভিযোগ এনেছিলেন। ম্যালকম এক্স কে তাই হত্যা করা ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৫।
ঔপনিবেশিক যুগ থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দাসপ্রথা এবং বর্ণবাদ বিদ্যমান তো ছিলই, কিন্তু এরপর যখন সমগ্র আমেরিকা একটি রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে আসার পরও সাদা আমেরিকানদের আইনী বা সামাজিকভাবেও অনুমোদিত সুযোগসুবিধা এবং অধিকার দেওয়া হয়েছিল সেটি ছিল আধুনিক সভ্যতায় পদার্পণ করা বিশ্ববাসীর জন্য একটি লজ্জ্বাজনক অভিজ্ঞতা। এবং এই একই অধিকারগুলি অন্য জাতি ও সংখ্যালঘুদের জন্য, বিশেষত কালোদের জন্য অস্বীকার করা হয়েছিল। ইউরোপীয় আমেরিকানরা, প্রধানত ধনী সাদা অ্যাংলো-স্যাকসন প্রোটেস্ট্যান্টরা আমেরিকান ইতিহাস জুড়ে শিক্ষা, অভিবাসন, ভোটাধিকার, নাগরিকত্ব, জমি অধিগ্রহণ এবং অপরাধমূলক পদ্ধতি বিষয়ে একচেটিয়া সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে এসেছে।
‘রুটসঃ দি সাগা অব অ্যান আমেরিকান ফ্যামিলি’ ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত এ উপন্যাসে নিজের পূর্বপুরুষের জন্ম ইতিহাস বর্ণনার মধ্য দিয়ে আমেরিকান লেখক অ্যালেক্স হ্যালি দাস প্রথার নির্মমতা, দাসদের করুণ এবং অথর্ব জীবনের কথা তুলে এনেছিলেন আমাদের সামনে।
আমেরিকায় বর্ণবৈষম্য দূর করার পেছনে অগ্রদূত হিসেবে কাজ করেছিলেন শান্তিপূর্ণ নাগরিক আন্দোলনের প্রবক্তা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র। তিনি ১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট ওয়াশিংটনের লিঙ্কন মেমোরিয়ালের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে “আমার একটি স্বপ্ন আছে” খ্যাত ঐতিহাসিক ভাষণটি দেন। আজ থেকে ৫৭ বছর আগে প্রায় সাত মিনিটের সে ভাষণে তিনি বলেছিলেন,
আমি স্বপ্ন দেখি এই জাতি একদিন জেগে উঠবে এবং তারা তাদের ধর্মবিশ্বাসের সত্যকে জীবনে কাজে লাগাবে— আমরা এই সত্যগুলোকে প্রমাণিত বলে মানি যে, সব মানুষকে সমান করে সৃষ্টি করা হয়েছে। আমি স্বপ্ন দেখি একদিন জর্জিয়ার লাল পাহাড়ে দাসদের সন্তানরা এবং দাস মালিকদের সন্তানরা ভ্রাতৃত্বের টেবিলে একসাথে বসতে পারবে। আমি স্বপ্ন দেখি, এমনকি মিসিসিপি প্রদেশ যেটা অবিচার এবং নিপীড়নের তীব্র তাপে জর্জরিত, তাও একদিন স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচারের আশ্রয়স্থলে পরিণত হবে। আমি স্বপ্ন দেখি আমার ছোট ছোট চার সন্তান এমন একটি দেশে বাস করবে যেখানে তাদেরকে তাদের গায়ের রং দিয়ে বিচার করা হবে না, বরং তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দিয়ে বিচার করা হবে।
এর পাঁচ বছর পরে ৩ এপ্রিল ১৯৬৮ তারিখে যে বক্তৃতা করেন— তার এই শেষ বক্তৃতাটির জনপ্রিয় নাম হচ্ছে “আই হ্যাভ বিন টু দ্যা মাউনটেইনটপ”। এর ঠিক পরের দিন, অর্থাৎ ৪ এপ্রিল আফ্রিকান-আমেরিকান মানবাধিকার কর্মী, রাজনীতিক, আমেরিকায় নাগরিক ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় অহিংস আন্দোলনের প্রবক্তা, প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নোবেল বিজয়ী মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রকে গুলি করে হত্যা করা হয়। বক্তব্যটি অংশবিশেষ ছিল— আমি প্রতিশ্রুত সে ভূমি দেখেছি। আমি তোমাদের সাথে সেখানে নাও যেতে পারি, তবে আমি তোমাদের আজ রাতে জানাতে চাই যে, আমাদের জনগণ প্রতিশ্রুত সে ভূমিতে স্থান পাবে।
শুধু কৃষ্ণাঙ্গরাই যে তাদের অধিকার আদায়ের লড়াই করেছেন তা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের ষোড়শ প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন আজীবন লড়াই করেছেন দাসপ্রথা এবং বর্ণবাদের বিরুদ্ধে । ‘মুক্তি ঘোষণা বা ঘোষণা ৯৫’ হলো একটি রাষ্ট্রপতি ঘোষণা এবং কার্যনির্বাহী আদেশ, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিংকন ২২ সেপ্টেম্বর ১৮৬২-এ জারি করেছিলেন এবং ১ জানুয়ারি ১৮৬৩-র মধ্যে কার্যকর হয়েছিল। দাসপ্রথা বিলোপ সংক্রান্ত ঘোষণার ২ বছর ৩ মাস পর ওয়াশিংটন ডিসিতে ফোর্ড থিয়েটারে একটি নাটক চলাকালীন সময়ে (১৪ এপ্রিল ১৮৬৫) আব্রাহাম লিঙ্কনকে প্রখ্যাত মঞ্চ অভিনেতা জন উইলকস বুথ হত্যা করে। মূলত দাসপ্রথা আইনীভাবে বিলোপ হওয়ার কারণেই মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র নিপীড়িতদের জন্য, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রে ভয়ঙ্করভাবে নির্যাতিত কালোদের জন্য হৃদয়ের সকল ভালোবাসা বক্তব্য পরিণত করার প্রয়াশ পেয়েছিলেন।
গল্প উপন্যাসের পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে দাসপ্রথা এবং বর্ণবাদের ওপর চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে শতাধিক। আন্দোলনের পথ পরিক্রমাটিও বেশ দীর্ঘ, দীর্ঘ এ আন্দোলনের ইতিহাসে জীবন দিয়েছেন অনেকে। তবু আজও অনেক মানুষের মনের কোণে জমে আছে বর্ণবাদের ঘৃণার আগুন। কখনও কখনও তা নির্মমভাবে প্রকাশিতও হয়, যেমন তা হয়েছে ২৫ মে জর্জ ফ্লয়েডের উপর।
নিউজ: অনলাইন অবলম্বনে।