জীবনে ভুল আমরা সবাই করি। তবে সব ভুল সমান নয়, বাজারে গিয়ে কেনাকাটায় ভুল বা বাইরে বেরোনোর সময় মানি ব্যাগ নিতে ভুল, এরকম ভুলে তেমন কিছু যায় আসে না, এতে ক্ষতির পরিমাণ নগণ্য। এসব ভুল মানুষ ভুলে যায়ও দ্রুত। তবে জীবনে কিছু ভুল আছে যা মানুষকে ভোগায় সারা জীবন। এমন পাঁচটি সর্বনেশে ভুল নিয়ে এ লেখা—
১. ক্লাস নাইনে উঠে কোন বিভাগে যাবেন? মানবিক, বাণিজ্য, নাকি বিজ্ঞান নিয়ে পড়বেন? আপাতভাবে বিষয়টিকে নির্বিষ মনে হলেও, পরবর্তী জীবনে এর প্রভাব হয় মারাত্মক, তাই এক্ষেত্রে ভুল করার কোনো সুযোগ নেই। সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব কোনোভাবেই শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের উপর ছেড়ে দেওয়া উচিৎ নয়, অবিভাবকরাও এক্ষেত্রে ভুল করে থাকেন। তা্ই দীর্ঘ আলোচনা সমালোচনা প্রয়োজন রয়েছে। শিক্ষার্থীর সামার্থ, পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা, নানান বিষয় বিবেচনায় নিয়ে তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ।
কেউ যদি ভুল করে সায়েন্স নিয়ে ফেলে, তাহলে সে পড়াশুনায় আগ্রহ হারাবে, রেজাল্ট ভালো হবে না, কাঙ্ক্ষিত জায়গায় সে পৌঁছাতে পারবে না। আবার কেউ যদি ভুল করে সায়েন্স না নেয়, তাহলে চাইলেও সে ইন্টারে গিয়ে সায়েন্স নিতে পারবে না, অর্থাৎ ইচ্ছা এবং সামার্থ থাকলেও কখনো সে আর বিজ্ঞানের কোনো বিষয় নিয়ে পড়তে পারবে না।
অর্থাৎ, বিষয়টিকে উচ্চ শিক্ষার সাথে সম্পর্কিত ভেবে এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
২. ইন্টার পাশ করার পরে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সেটি হল- কোথায় ভর্তি হওয়া যায়। মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং, নাকি বিশ্ববিদ্যালয়? কোথায় ভর্তির জন্য চেষ্টা করবেন, নাকি বিদেশে পাড়ি জমানোর চেষ্টা করবেন? পাবলিকে পড়বেন, নাকি প্রাইভেটে পড়বেন? এরকম গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এক্ষেত্রেও আবেগ তাড়িত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এমনিতে আবেগ থাকা ভালো, কিন্তু এসব সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বাস্তববাদী হতে হবে। পরিবারের অবস্থা মাথায় রাখতে হবে। পড়াশুনা-ই যদি আপনার এবং পরিবারের একমাত্র পাথেয় হয়, তাহলে ভুল করার সুয়োগ আরো কম। স্রোতে গা ভাসানো যাবে না। আলোচনা সমালোচনা করে সিদ্ধান্তে আসতে হবে। রেজাল্ট এবং সামার্থ মাথায় রাখতে হবে। অনেকের মতে প্রাইভেটে না পড়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ভালো, তাতে মা-বাবার টাকা বাঁচবে। অনেক বেশি টাকা খরচ করে পড়লে নিজের উপর চাপ বাড়ে। এক্সট্রা চাপ নেওয়ার কোনো মানে হয় না। তাছাড়া চাকরির ক্ষেত্রে কে কোথায় পড়েছে, সেটি তেমন কোনো গুরুত্ব বহন করে না।
৩. এরপর সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আসে অনার্স পাস করার পর। মাস্টার্স করা না করার সিদ্ধান্ত। যাদের পরিবারে টানা পোড়েন বেশি, তারা মাস্টার্স না করলেও পারেন। প্রায় সকল চাকরিতে অনার্সই যথেষ্ট। সিদ্ধান্ত নিতে হবে চাকরি বাছাইয়ের। কোন চাকরির জন্য আপনি প্রস্তুতি নেবেন, নাকি আরো পড়াশুনার জন্য বিদেশে পাড়ি জমাবেন? যাই করেন মনোযোগ দিতে হবে। মনোযোগ না দিয়ে প্রতিযোগিতার এই বাজারে সফল হওয়া যাবে না। তাই নিজের সামার্থ এবং পরিবারের আর্থিক অবস্থা মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নিন। নিজের বয়সটাও এক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে, কারণ, আমাদের দেশে সরকারি চাকরিতে বয়স বেধে দেওয়া আছে।
বিসিএস, না ব্যাংক –এরকম একটি প্রশ্ন অনেকের মাথার মধ্যে ঘোরে। আমার পরামর্শ হচ্ছে- বিসিএস-এর চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিন। ভাইভায় পাশ করলে চাকরি একটি জুটবে। আর বিসিএস-এর প্রস্তুতি নিলে প্রায় সকল চাকরির প্রস্তুতি হয়ে যায়। ব্যাংকে গণিত একটু কঠিন আসে, তাই যারা অংক ভালো পারেন না, তাদের জন্য ব্যাংকে ভালো চাকরি পাওয়া একটু কঠিনই। তবে চেষ্টা করলে সকল বাধা অতিক্রম করা যায়, এ্টা অবশ্যই সত্যি, কিন্তু ঐ যে বয়সের কথা বললাম, বয়সটা মাথায় রাখতে হবে। ত্রিশের মধ্যেই আনপাকে যা করার করতে হবে এমন নয়, তবে সরকারি চাকরি পেতে হলে এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। চুলচেরা বিশ্লেষণ করে, তারপর সিদ্ধান্ত নিন।
আরেকটা বিষয়- অনেকে হঠাৎ একটি চাকরি পেয়ে যায়, তারপর সমস্যায় পড়ে, সমস্যায় পড়ে কারণ, অন্য অনেক চাকরির হাতছানি থাকায় বর্তমান চাকরিটাতে সে মনোযোগ দিয়ে করতে পারে না। অনেকটা ‘কুল রাখি না শ্যাম রাখি’ অবস্থা হয়। এক্ষেত্রে নিজের সামার্থ এবং আত্মবিশ্বাসের উপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবে এক ঢিলে দুই পাখি মারার সুযোগ এখানে নেই। দুইদিক-ই আপনাকে সামলাতে হবে। বর্তমান চাকরিটাও তালমান রেখে করতে হবে, আবার কাঙ্ক্ষিত চাকরির চেষ্টাও চালাতে হবে। তবে পরিবারের অবস্থা খুব খারাপ হলে অনেক সময় দ্রুত সন্তুষ্ট হতে হয়।
৪. বলছি— প্রেম ভালবাসা বিষয়ে। হুট করে ভালাবাসায় বিপদ নেই, তবে বলে ফেলায় বিপদ আছে। কাউকে বিয়ে করতে ইচ্ছে হওয়ায় বিপদ নেই, তবে কথা দেওয়ায় বিপদ আছে। এক্ষেত্রে সময় নিতে হবে। এবং যথাসম্ভব বিয়ের মানুষটার সাথে কিছু মিল খোঁজার চেষ্টা করতে হবে। বাস্তব জীবন খুব কঠিন হয়, সাধারণ মানুসিকতার মানুষের জন্য কালচারাল মিল বিয়ের ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ। বড় ভুল হয়ে যাবে- হুট করে কাউকে বিয়ে করে ফেললে। সময় নিন। যথাসম্ভব পরিবারের মতামত নিয়ে বিয়েটা করুণ। পরিবারকে বাদ দিতে নেই, কারণ, পৃথিবীতে পরিবারের চেয়ে আপন কেউ হয় না। অপেক্ষা করলে পরিবার এক সময় হয়ত আপনার মতেই মত দিবে। তবে কিছু ব্যতিক্রমী পরিস্থিতি তো থাকেই।
৫. এটি ছাড়াছাড়ি বিষয়ক সিদ্ধান্ত। বর্তমান চাকরিটা ছাড়া যাবে না আরেকটি চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত। চাকরি ছেড়ে ব্যবসা করার চেয়ে চাকরি রেখে ব্যবসা করা ভালো, এবং ব্যবসাটা ভালোমত দাঁড়িয়ে গেলে, তারপর চাকরি ছাড়া যায়।
বিবাহ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একশোবার ভাবুন, আবার সবকিছু সহ্য করে একসাথে থাকারও কোনো মানে হয় না। স্বামী-স্ত্রী’র সম্পর্কও এক ধরনের বিজনেস। পার্টনারশিপ। কম পড়লে পার্টনার সহ্য করবে না। ব্যাপারটা একটু ভদ্রস্থ, এই যা। মুখে কেউ কিছু সহজে বলে না। তবে পাওনা কেউই ছাড়তে রাজি হয় না। তাই প্রতি মুহূর্তে একে অপরকে জিতিয়ে দিতে হয়। সবকিছু করেও যদি দেখা যায়- একসাথে থাকা আর সম্ভব নয়, তখন বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। সবদিক খতিয়ে দেখতে হবে। প্রয়োজনে কিছুদিন আলাদা থেকে দেখতে হবে। আর বিবাহ বিচ্ছেদ মানেই একজন আরেক জনের শত্রু হয়ে যাওয়া নয়। বিচ্ছেদের পরেও বন্ধুত্ব বজায় রাখা যায়। বন্ধুত্ব বজায় রাখা না গেলেও শত্রু ভাবার তো কোনো কারণ নেই।