করোনাকাল: অন্যের জন্য বাঁচা নিজেকে নিয়ে // এস এম কাইয়ুম

করোনাকাল

“সোশ্যাল ডিস্টেন্স” শব্দটি যেন বিপরীতভাবেই আমাদের সামাজিক জীবনে মাননসই ব্যবহারিক শব্দে পরিণত হয়ে উঠেছে করোনাকালের এই অবরুদ্ধতার সময়ে। সমাজবিজ্ঞানীরা যেখানে যান্ত্রিক যন্ত্রণার এই আধুনিক সমাজে Social Intimacy বা সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার কথা বলে এসেছেন, ভার্চুয়াল জগৎ ছেড়ে রিয়েল লাইফে বাঁচতে বলেছেন। আমরা দেখেছি রেস্টুরেন্টে, খেলার মাঠে, চায়ের আড্ডায় কিংবা ডেটিংয়ে সবাই যে যার মতো মোবাইলে, ভার্চুয়াল জগতে বুদ। ফিজিক্যালি সোশ্যাল গ্যাদারিংয়ে থাকলেও মানসিকভাবে সে বিচরণ করছে ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে। যার কারণে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মাঝে অসামঞ্জস্যতা আর যার ফল আত্মবিশ্বাসের অভাব, হাপিত্যেশ-হতাশা আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে আত্মহত্যা যার মাধ্যমে নিজের থেকে নিজে পালানোর চেষ্টা করছে কিছু কিছু বিপদগামী মানুষ। সেখানে হঠাৎ করেই এই সামাজিক দূরত্ব; সব কিছু ছেড়ে সবার থেকে নিজের নিশ্চল নির্বাসন।
প্রকৃতি মনে হয় পরোক্ষভাবে আমাদের শিক্ষা দিচ্ছে। সামাজিক মিথস্ত্রিয়ার গুরুত্ব— যা আমরা নাগরিক যাপনে বিভিন্ন কারণে ভুলতে বসেছিলাম। “নিজের জন্য বাঁচা নিজেকে নিয়ে”। “আমাকে আমার মতো থাকতে দাও/ আমি নিজেকে নিজের মত গুছিয়ে নিয়েছি” এসব গানে নিজেকে মিলিয়েছি। আসলেই কি মানুষ এভাবে বাঁচতে পারে? সত্যি কি আমরা আমাকে নিয়ে সুখী হতে পারি? মনে হয় না। তাই তো এখন এই করোনাকালে খুব মিস করছি চায়ের আড্ডাটা, টিএসসি’র ভীড়, নিকট বন্ধুর সঙ্গ, কিংবা প্রিয় মানুষের গায়ের পরিচিত ঘ্রাণ, ঠিক দুপুরে তার ছায়ার শীতলতা আর লোকাল বাসে হকারের সেই আর্দ্র কণ্ঠ। করোনার আগে হয়তো এর তেমন একটা তাৎপর্য ছিলো না, না-হয় এভাবে কোনও দিন চিন্তা করার সুযোগ হয়নি বা আমাদের ভাবার সময়ই ছিলো না নাগরিক যাপনে আর না-হয় সেই সময়টুকু কেড়ে নিত সেল ফোনের স্ক্রিন।
আবার সব ঠিক হলে হকারের চোখে তাকাব। তাকে পড়ার চেষ্টা করব। পাশের সিটে বসা অপরিচিত লোকটির সাথে সেধে কথা বলব। পরিচিত হব। অপরিচয়ের সাথে পরিচয়ের পরিচয় করিয়ে দিব। আরও কিছুটা সামাজিক হয়ে উঠব!

১. বাইরে তেমন একটা বেরই হওয়া হয় না। তবে বিশেষ প্রয়োজনে বের হলে মাস্ক পরা সারি সারি মানুষ দেখে মনে হয়: এ শুধু ব্যক্তিগত সুরক্ষার জন্য পরা নয় এ যেন প্রতীকি অর্থে আমরা নিজেদের মুখ দেখাতে লজ্জা পাচ্ছি পৃথিবীর কাছে। দূষণ, দুর্নীতি, অমানবিকতা আর অবিবেচনার চোরাবালিতে ক্রমাগত তলিয়ে গেছি আমরা। এখনই উপলব্ধির সময়! তবে আমাদের জানা নেই, পৃথিবী নামক এই গ্রহবাসীরা কতটুকু সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারব আমাদের পৃথিবীর; আমাদের একমাত্র নিবাসের।

২. সেদিন বারান্দায় বসে আছি আনমনে। আকাশে ঝুলে আছে চাঁদ। টবের ফুটন্ত লাজুক কেয়ার গন্ধ চারপাশটা জুড়ে। তখন হঠাৎই উপলব্ধি হলো: পূর্ণিমা ঠিকই জ্যোৎস্না বিলাচ্ছে, ভোরে জীবনানন্দীয় শালিক ডাকছে নিত্য নিকানো উঠোনে, শান্ত ডানার বাদুর খাবারের সন্ধ্যানে সন্ধ্যায় প্রতিদিনই তো বের হচ্ছে; প্রকৃতির সব কিছুই তার চক্রে স্বাভাবিকভাবে চলছে। শুধু মানুষই বিপর্যস্ত। পৃথিবীটা যে শুধু আমাদের নয়, তার সব উপাদানের সহঅবস্থানই সহজ-সুন্দর রূপ দেয় প্রকৃতির এটাই শিক্ষা দিল করোনা। তারপর এক পরিচিত জনের সাথে এ চ্যাটিং হচ্ছিল সে বলছিলো, “কবে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয় এটাই দেখার বিষয়।” সত্যিই তো তাই! বাসায় সেলফ কোয়ারেন্টিনে থেকে থেকে বোর হয়ে যাচ্ছি। পেশাগত কারণে নির্মাতা হিসেবে কাজ করার কারণে এই করোনাকালের কিছু দিন জমে থাকা টেবিল ওয়ার্ক-টোয়ার্ক করেছি। গল্গ-কবিতা আর স্ত্রিপ্ট লিখে সময়টাকে কাজে লাগানো চেষ্টা করেছি, কিন্তু ইদানিং সেটাও করতে ভালো লাগছে না। সব কিছুতে একটা কিরকম জানি বিরক্তি ধরে গেছে! সবকিছু শুনে সে হেসে বলল, “বেশি দিন এ রকম চলতে থাকলে লেখকের মাথাও ব্লক হয়ে যেতে পারে…!!”
সত্যিই তো! জীবনের স্রোতে না থাকলে দেখার দৃষ্টিতে কোনও কিছু নতুন করে ধরা দেয় না।

আবার সব কিছু স্বাভাবিক হবে। মেঘভাঙা রোদ্দুর উঠবে আমাদের আকাশে। শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, চিন্তশীল মানুষের সুচিন্তিত প্রকাশ দেখতে পাব চিত্রে-চলচ্চিত্রে, গল্প-কবিতায় আর দেখতে পাবো সুস্থ-সুন্দর পৃথিবীর প্রজ্বলিত প্রকাশ। তারই অপেক্ষায় রইলাম…। না। ভুল বললাম! তারই প্রতীক্ষায় রইলাম…!!!


লেখক: কবি ও নির্মাতা

[email protected]