চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং করোনার টিকা নিয়ে ‘অসাবধানতাবশত’ ভুল ব্যাখ্যা করেছেন বলে দাবি করেছেন পশ্চিমা কিটো ডায়েটের পরামর্শদাতা আলোচিত-সমালোচিত ডা: জাহাঙ্গীর কবির। ৩ আগস্ট (২০২১) নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক পোস্টের মাধ্যমে এই ক্ষমা প্রার্থনা করেন তিনি।
২ আগস্ট (২০২১) ডা: জাহাঙ্গীর কবিরের চিকিৎসাকে অপচিকিৎসা হিসেবে আখ্যা দিয়ে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুশিয়ারি দেয় চিকিৎসকদের সংগঠন ‘ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি রাইটস অ্যান্ড রেসপন্সিবিটিলিস (এফডিএসআর)’।
ডা: জাহাঙ্গীর কবিরের ঠিকানায় কুরিয়ার সার্ভিসে পাঠানো এই চিঠিতে তার কর্মকাণ্ডকে অবৈজ্ঞানিক, অসত্য, দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করে সংগঠনটি।
ফেসবুক পোস্টে জাহাঙ্গীর কবির বলেন, ইদানিংকালে আমার একটি ভিডিও এবং দুইটি পোস্ট নিয়ে আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। প্রথমত সুস্থ থাকার জন্য রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে আমি একটি ভিডিও পোস্ট করেছিলাম সেখানে করোনার ভ্যাক্সিন বিষয়ে কিছু তথ্য সহজভাবে বোঝাতে গিয়ে আমার অসাবধানতা বশত ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছিলাম। এ নিয়ে সমালোচনার সৃষ্টি হলে আমি অত্যন্ত দ্রুততার সাথে ভিডিওতে যে তথ্যগুলো ভুল ছিল এবং যে কথাগুলো জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে সেসব বিষয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য দিয়ে পূর্বের ভিডিওটি অনলাইন থেকে সরিয়ে নিয়েছি। একইসাথে সকলকে ভ্যাক্সিন দেওয়ার জন্য পরামর্শ এবং উৎসাহ দিয়েছি।
তিনি বলেন, এরপরেও কয়েকজন সম্মানিত ডাক্তার আমাকে ভুল বুঝে সরাসরি আমার নাম উল্লেখ করে নানান রকম পোস্ট করেন। তন্মধ্যে একটি পোস্টের স্ক্রিনশট আমি আমার পেইজে শেয়ার করেছিলাম। এছাড়া অন্য একটি জনসচেতনতামূলক পোস্টে উদাহরন স্বরুপ একটি প্রেসক্রিপশন শেয়ার করেছিলাম। ঐ প্রেস্ক্রিপশনটি যিনি লিখেছিলেন তার প্রতি সম্মান প্রদর্শনপূর্বক আমি তার নাম ও রেজিস্ট্রেশন নাম্বারটি প্রকাশ করিনি। তথাপি এই পোস্টটি নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হলে তৎক্ষণাৎ দুটি পোস্টই ডিলিট করে দেই। আমি বিশ্বাস করি আমাদের ডাক্তার সমাজের প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে জনসেবা করে যাচ্ছেন, মানবিক কাজ করে যাচ্ছেন, এজন্য প্রত্যেক ডাক্তারই আমার কাছে অত্যন্ত সম্মানিত ও শ্রদ্ধাভাজন। একজন ডাক্তার হিসেবে আমি কখনোই কাউকে অসম্মান করতে পারি না এবং আমি তা করতে চাইও না। তবুও আমার অন্বিচ্ছায় তা হয়ে থাকলে তার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী।
ডা. জাহাঙ্গীর কবিরের ৭টি অপরাধ (লিঙ্ক)
এক
তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানকে ধর্মগ্রন্থের সাথে মিলিয়ে প্রচারণা দিচ্ছেন। এতে ধর্মান্ধ অন্ধ-অনুসারীরা তার কথাকেই বেদবাক্য মনে করে তা পালন করছেন। তারা প্রচারণা চালাচ্ছেন যে উপকার পেয়েছেন। কিছু কমন কথা যা ডাক্তারিবিদ্যা সমর্থন করে ও সকল ডাক্তারই বলেন তা মেনে চললে উপকার হবেই। তিনি সেইসব কথার সাথে অপবিজ্ঞান মিলিয়ে ধর্মের সাথে গুলিয়ে অপ-চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রচারণা চালিয়ে বিপুলভাবে ক্ষতি করেছেন মানুষকে। চিকিৎসা-বিজ্ঞানকে ধর্মের সাথে মিলিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা অযৌক্তিক ও অনৈতিক।
দুই
মানুষকে আকৃষ্ট করতে তিনি বিভিন্ন ডিগ্রি ব্যবহার করেছেন যা বিএমডিসির অনুমোদন নেই। তার ডিগ্রির বহর দেখে মানুষ সহজেই বিভ্রান্ত হয়ে তাকে বহু ডিগ্রিওয়ালা বড় ডাক্তার ভেবে বসেছেন। তিনি শুধুমাত্র এমবিবিএস ডাক্তার। একটি উপজেলা পর্যায়ে কিছুদিন একটি বেসরকারি হাসপাতালে কাজ করে ঢাকায় চেম্বার দিয়ে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। তার ডিগ্রিগুলো নিছকই স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্স বা কর্মশালায় অংশগ্রহণ। এগুলো কোন ডিগ্রি নয়। অথচ তিনি এগুলোকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যাতে মনে হবে বিশাল বড় মহা ডাক্তার।
তিন
চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ইয়োশিনোরি ওহশোমি দেখান জীবদেহ কেমন করে ত্রুটিপূর্ণ কোষ ধ্বংস করে নিজের সুরক্ষা করে এবং কোষ কীভাবে নিজের আবর্জনা প্রক্রিয়াজান করে সুস্থ থাকে, সেই রহস্য বের করেন। এই প্রক্রিয়াকে বলে অটোফেসি। ডা. জাহাঙ্গীর এটাকে সিয়ামের সাথে তুলনা করেন। এছাড়া খৃস্টান মৌলবাদীরা একে ফাস্টিং ও হিন্দু মৌলবাদীরা একে উপোস থাকার সাথে তুলনা করেন। অটোফেসি প্রক্রিয়া শুরু হয় খাওয়া বন্ধ করার ১৩ থেকে ১৮ ঘণ্টা পর থেকে। এ সময় শুধু পানি পান করতে হবে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এটা এখনো প্রয়োগ হয়নি। সিয়ামের সাথে এর কোন মিল নেই বা মিল করার সুযোগও নেই। শুধু প্রতারণা করার জন্যই তিনি অনেক তথ্য গোপন করে অটোফেসিকে সিয়াম বলে ঘোষণা দেন।
চার
করোনাভাইরাস টিকা নিয়ে তিনি বলেছেন, কোভিড ভ্যাকসিনের মাধ্যমে শরীরে অ্যান্টিবডি প্রবেশ করানো হয় এবং ভাইরাসের বিভিন্ন স্ট্রেইনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ভ্যাকসিন দরকার ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো ছাড়া আমাদের উপায় নেই। তিনি নিজে করোনা ভ্যাকসিন নেননি এবং তার এই বক্তব্য মানুষকে ভ্যাকসিন নিতে নিরুৎসাহিত করবে। তার এমন ভুল তথ্য সম্বলিত ভিডিও পোস্ট মানুষকে বিভ্রান্ত করবে। সমালোচনা শুরু হলে তিনি এ পোস্টটি সরিয়ে নেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দেয়া হলে তিনি ক্ষমা চান। কিন্তু লক্ষ লক্ষ মানুষকে যে বিভ্রান্ত করলেন তার দায় কে নিবে? এসব ভুল অসাবধানতাবশত নয়, পরিকল্পিতভাবেই দেশের টিকা কার্যক্রমকে ব্যহত করা বলেই মনে হয়।
পাঁচ
তিনি প্রায়ই বলেন, জীবনধারা বদলালে ওষুধ লাগে না, আর জীবনধারা ভালো না হলে ওষুধ কাজ করে না। এই বক্তব্যর মানে কি? স্পষ্টই বলা যে, ওষুধ খাওয়ার দরকার নেই, শুধু জীবনধারা বদলান তার নির্দেশিত পথ অনুযায়ী। কি ভয়ানক প্রচারণা। তার কথায় একজন ইনসুলিন নেয়া রোগী ইনসুলিন নেয়া ছেড়ে দিলে কি হবে? ওই রোগী মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবেন দ্রুত। এমন বহু মানুষই তার পরামর্শে ওষুধ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। হঠাৎ করে এর অপকারিতা না বুঝা গেলেও কদিন পরেই তারা এমন এক অবস্থায় পৌঁছে যেতে পারেন যে, সেখান থেকে আর ফিরে আসা সম্ভব নাও হতে পারে।
ছয়
কিটো ডায়েট নিয়ে ভুল এবং অসত্য তথ্য দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি এই ডায়েটের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে কোনো লিখিত বা মৌখিক কাউন্সেলিং করেন না। বরং ডায়াবেটিস, কিডনিসহ বিভিন্ন রোগীদের ব্যাপকভাবে কিটো ডায়েটের পরামর্শ দিয়ে ক্ষতি করছেন। নায়ক আমির খানের জন্য এটি জরুরী। তাঁকে মাঝে মধ্যেই স্বল্প সময়ের মধ্যে শ্লিম হতে হয় তখন এটা কাজে লাগে। কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য ঢালাওভাবে এমন পরামর্শ ভয়ানক হতে পারে। এতে চর্বির পরিমাণ বেশি থাকায় ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, কিডনিতে পাথর, হৃদরোগ, পিত্তথলিতে পাথর, থায়রয়েডের সমস্যা, চুল পড়ে যাওয়া, হজম ক্ষমতা কমে যাওয়া, ত্বকের ক্ষতি, উজ্জ্বলতা হ্রাস, শারীরিক দুর্বলতা ইত্যাদি হতে পারে। অথচ কিছু মাথামোটা লোক তাদের পেট কমাতে তার পরামর্শ ঢালাওভাবে ব্যবহার করছে। তিনি এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন।
সাত
তিনি বিভিন্ন চিকিৎসকের দেওয়া প্রেসক্রিপশনকে হেয় করে মন্তব্য করেছেন। নিজে একজন সাধারণ এমবিবিএস ডাক্তার হয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশন নিয়ে ভিডিও প্রকাশ করে তিনি গুরুতর অপরাধ করেছেন। এতে মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের হেয় করে ওনার স্মরণাপন্ন হয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হবেন। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার না দেখালে অনেক ক্ষেত্রে জটিল ও গুরুতর বিষয়ে ভুল চিকিৎসা হতে পারে। একজন লোক সংশ্লিষ্ট বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে ভুল করেছেন আর তা ধরছেন একজন সাধারণ এমবিবিএস যিনি একটি ভাল চাকরিও পান নি আবার ভাল ডিগ্রিও অর্জন করতে পারেননি। তিনি কোন বিষয়ে গবেষণা করেও নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে পারেন নি। এরা শুধু মানুষকে বিভ্রান্ত করতেই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের বিরুদ্ধে তাদের প্রেসক্রিপশন নিয়ে তামাশা ও বিষোদগার করার সাহস দেখান।
আরো অনেকগুলো অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। কিছু অর্বাচিন এখনো তার পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছে। কথিত বিভিন্ন বিজ্ঞানের পেজেও তার পক্ষে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এছাড়া বিক্রমপুরসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পেজেও দেখছি তার পক্ষে প্রচারণা চালাতে। অথচ তিনি একজন ডাক্তার হিসেবে অসংখ্য অপরাধ করেছেন যাতে তার সনদ বাতিল করে শাস্তি প্রদানের দাবি উত্থাপনই যৌক্তিক। এসব অপচিকিৎসকদের গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনা হোক।
সূত্র: statewatch.net/, tbsnews.net, banglanews24.com