বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যার মূলে ভারতবর্ষের হিন্দু মুসলিম সংকট কতটা কাজ করে? সমাধান আসলে কোথায়?

হিন্দু-মুসলিম ঐক্য

হিন্দুদের একটি বড় অভিযোগ হচ্ছে— এ অঞ্চলে মুসলিমরা বহিরাগত এবং বিভিন্ন সময়ে তারা হিন্দুদের ওপর নির্যাতন করেছে। একথা সত্য যে, মুসলিমরা বাইরে থেকে এসেছে, মুসলিমরা না বলে বলতে হবে ধর্ম হিসেবে ইসলাম এ অঞ্চলের নয়। আমাদের ভৌগলিক সীমানা থেকে ইসলামের রীতিনীতিগুলো গৃহীত হয়নি। এটাও সত্য যে, বিভিন্ন যুদ্ধের পরিস্থিতিতে মুসলিমরা হিন্দুদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন চালিয়েছে, গণহত্যাও সংগঠিত করেছে। তবে এর চেয়ে বড় একটা সত্য আছে। ভারতবর্ষের ঐতিহাসিক বাস্তবতায় যে সত্যটা সবসময় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। হিন্দুরা হিন্দুদের ওপর, ভারতবর্ষের একটা শ্রেণি আভিজাত্য এবং বংশ মর্যাদার অজুহাতে আরেকটা শ্রেণির ওপর লাগাতারভাবে নির্যাতন চালিয়েছে। এই সত্যটা আড়াল হয়ে যায় ইসলাম ধর্ম  বাইরে থেকে আসায় এবং অতীতে কিছু ঘটনার প্রেক্ষিতে মুসলিমদের দোষ দেওয়ার সুযোগ তৈরি থাকায়।

মুঘল আমল থেকে এটি (সতীদাহ প্রথা) ইতিহাসে চিহ্নিত থাকলেও প্রাচীনকাল থেকেই ভারতেবর্ষে এই প্রথা বিদ্যমান ছিলো। প্রাচীনকালে পৃথিবীর প্রায় সব অঞ্চলেই অনেক ধরনের বর্বর প্রথা ছিলো, কিন্তু অষ্টাদশ শতক থেকে ঊনবিংশ শতক পর্যন্তও ভারতে এ প্রথা বর্তমান ছিলো, এমনকি নিষিদ্ধ হওয়ার পরেও হাজার খানেক নারীকে পুড়িয়ে মারার ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়। অস্পৃশ্যতা ভারতে এমনই এক চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিলো যে নেহেরুর সময়ে সংবিধানে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে তা নিষিদ্ধ করতে হয়েছিলো। নিষিদ্ধ হলেও এখনো ভারতবর্ষজুড়ে তা আছে। [অস্পৃশ্যতা হচ্ছে নিম্নবর্ণের মানুষের ওপর এক সামাজিক বিভেদ ও নিপীড়নের উপায়। এর প্রধান শিকার যারা ভৃত্য বা নিচু পেশায় নিয়োজিত ছিলো।] বর্ণপ্রথার বর্বরতা শুধু সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রভেদই তৈরি করেনি। হত্যা নির্যাতনের ঘটনাও ঘটতো বেমালুম। ঠগীরা ছিলো এমন এক দস্যুদল, যারা পথিকের গলায় রুমাল বা কাপড় পেছিয়ে হত্যা করতো। এই ঠগিরা কিন্তু কালির পূজারী ছিলো, এবং হত্যাকাণ্ডের জন্য তাদের মধ্যে কোনো অনুশোচনাবোধ থাকতো না। ফলে ধর্মের নামে হত্যাকাণ্ডের দায় শুধু মুসলামানদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ সাহিত্যেই সীমাবদ্ধ, নাকি বাস্তবে ঘটেছিলো বলা কঠিন। তবে ইতিহাস হিসেবে ধরলে এটাই মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ— হতাহত এবং ক্ষয়ক্ষতির বিবেচনায়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময়কাল ছিলো ১৮ দিন। মহাভারতে বর্ণিত এ যুদ্ধকে সাহিত্য হিসেবে ধরে নিয়েও বলা যায় ভারতবর্ষের ইতিহাসে ধর্মের নামে মানুষ হত্যা মুসলমানদের দ্বারা শুরু হয়নি। মুসলমানেরা এক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে বলা যায়।

কলিঙ্গ-এর যুদ্ধ কয়েক লক্ষ লোক হত্যা করা হয়েছিলো, যখন ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবই হয়নি। কলিঙ্গ যুদ্ধে হতাহতের ভয়াভহতা দেখে সম্রাট অশোখ বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, এবং পরবর্তীতে তিনি বৈৗদ্ধ ধর্মের প্রসারে কাজ করেছিলেন। ভারতবর্ষে প্রান্তিক এবং নিম্নবর্ণের জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দেওয়ার কাজটি গৌতম বুদ্ধই প্রথম শুরু করেছিলেন। কিন্তু হিন্দুধর্ম যেহেতু ছিলো শাসকদের ধর্ম, ফলে অহিংস মতবাদ দিয়ে বৌদ্ধ ধর্ম খুব একটা হালে পানি পায়নি। হিন্দু ধর্ম এবং ব্রাক্ষ্মণ্যবাদের কাছে তারা টিকতে পারেনি। তবুও রাজা অশোখের সময়কাল থেকে গুপ্ত সম্রাজ্যের পতনের আগ পর্যন্ত ভারতবর্ষে বৌদ্ধ ধর্মের বিশেষ প্রভাব ছিলো।

মূলত রাজা অশোখ (মৌর্য সাম্রাজ্যের শাসক) এবং গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে বৌদ্ধধর্মের চর্চা ভারতে প্রভাব হারিয়ে ফেলে। এরপরে এদিকে না পারলেও রাজা কুষাণ বা কুষাণ সম্রাজ্য আফগানিস্তান এবং পাকিস্তান পর্যন্ত বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার ঘটাতে সমর্থ হয়েছিলো। ফলে আজকে সনাতনীরা বা হিন্দুরা পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান তাদের কাছ থেকে মুসলিমরা কেড়ে নিয়েছিলো বলে যে দাবী করে থাকে সেটি আসলে সত্য নয়। এটি প্রথমত তারা হারিয়েছিলো বৌদ্ধ শাসকদের কাছে। মুসলিমরা বিজয় করে নিয়েছে পরে।

বাংলা এবং বিহারে ৭৩০ থেকে ১১৩০ সময়কালে পাল রাজাদের হাত ধরে বৌদ্ধ ধর্ম বিস্তার লাভ করে। মূলত এ সময়কালে বৌদ্ধরা মুসলিমদের কাছ থেকে আনকূল্য পেতে শুরু করে। ইসলাম ধর্ম প্রচারকেরা তখন ধর্ম প্রচার এবং মৌনভাবে বৌদ্ধদের সমর্থন করার দিকেই মনোযোগী হয়েছিলো, এবং যথেষ্ট সফলভাবে তারা সেটি করতে সমর্থ হয়েছিলো। পাল রাজাদের শাসনামল থেকেই মূলত ভারতবর্ষের নিম্নবর্ণের হিন্দুরা এমনকি অনেক উচ্চ বর্ণের হিন্দুরাও মুসলিম হতে শুরু করে। তখন প্রকৃতপক্ষেই জোরজবরদিস্তর কোনো বিষয় ছিলো না। বহু লোক তখন স্বেচ্ছায় মুসলিম হয়েছিলো।

ধীরে ধীরে সুযোগ বুঝে ইসলাম ধর্ম এ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছিলো। তবে যেকথা বলা হয়— শুধুমাত্র হিন্দুধর্মের বর্ণপ্রথামূলক বিবেদের ফাঁক দিয়ে ইসলাম ধর্ম এ অঞ্চলে প্রবেশ করতে পেরেছিলো, এ কথাটি পুরোপুরি সত্য নয়। হিন্দু এবং বৌদ্ধদের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব এ অঞ্চলে তখন বিদ্যমান ছিলো ইসলাম প্রচারকারীরা এবং শাসকেরা সেটিকেই শুরুতে তারা  সবচেয়ে বেশি কাজে লাগিয়েছিলো।

ধর্ম হিসেবে ভারতবর্ষে ইসলাম আসার পরেই মূলত বৌদ্ধ ধর্ম হিন্দুদের হামলার হাত হতে রক্ষা পেয়েছিলো, আবার উল্টো করে বললে হিন্দুরা বৌদ্ধদের হামলার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলো। ফলে কৌশলগতভাবে বৌদ্ধ এবং হিন্দু উভয় সম্প্রদায় ইসলাম এ অঞ্চলে সাদরে গ্রহণ করেছিলো। ইসলাম ধর্ম তখন হিন্দু ধর্ম এবং বৌদ্ধ ধর্মের মধ্যে বাফার হিসেবে কাজ করেতে পেরেছিলো। অতএব, একথা মোটেও সত্য নয়— ভারতবর্ষে ইসলাম প্রবেশ করার জন্য শুরুতে কোনো ধরনের জোরজবরদস্তির প্রয়োজন হয়েছিলো। জোর জবরদস্তির প্রয়োজন হয়েছিলো ক্ষমতায় যেতে, সেটি সবক্ষেত্রে সবার জন্যই সত্য। পালবংশকে পরাজিত করে সেন রাজারা ক্ষমতায় আসে। তবে এরইমধ্যে আফগানিস্তানে মুসলিম বিজয় অর্জিত হয়ে যায়। অর্থাৎ, এটা পরিষ্কার যে, ধর্ম প্রচারের পাশাপাশি মুসলিম পরিব্রাজকদের ক্ষমতায় আরোহনের অভিপ্রায় সবময়ই ছিলো, এবং তারা এ অঞ্চলে যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তায় পরিচয় দিয়েছিলো। মূলত বৌদ্ধ ধর্ম দুর্বল হতে থাকলে তারা সুযোগটি লুফে নেয়, এবং তখন থেকেই মূলত হিন্দুদের শত্রু হতে শুরু করে। এর আগে এ অঞ্চলের নব্য মুসলিমরা হিন্দুদের শত্রু ছিলো না।

ক্ষমতা না চাইলে, রাজ্য দখল করতে না চাইলে কে কার শত্রু হয় বলেন? তবে আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানে বৌদ্ধদের প্রভাব বিস্তারের পাশাপাশি অষ্টম শতক থেকেই মুসলিমরা কিছু কিছু জায়গাতে রাজপুতদের হঠিয়ে ছোট ছোট অঞ্চল দখল করতে থাকে। ফলে এটা বলা যায়— ইসলাম ধর্ম ভারতবর্ষে প্রবেশের পর সর্বোচ্চ পঞ্চাশ বছর অহিংস ছিলো, এরপর থেকে তারাও বৌদ্ধ এবং হিন্দুদের মাঝে একটি পক্ষ হিসেবে আবির্ভুত হয়। প্রথম দিকে তারা বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের মাঝে আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীদের পক্ষের মতোই একটি পক্ষ ছিলো। আমাদের দেশের ইউরোপ এবং আমেরিকা মদদপুষ্ট বুদ্ধিজীবীরা যেমন আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি-এর মাঝখান দিয়ে যেকোনো সংকটে একটি বনেদি গোষ্ঠী হিসেবে আবির্ভুত হতে পারে ভারতবর্ষে তখন ইসলাম তেমনই এক বনেদী ঘরানার ধর্ম ছিলো। হিন্দুরা এখন ইসলাম ধর্মকে যেভাবে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে চায় হিন্দুদের চোখেই ইসলাম আসলে তখন তেমনটি ছিলো না, বরং বেশ বনেদী ধর্ম ছিলো। ইসলাম তখন ছিলো পারস্য এবং আরব হতে আসা জ্ঞানী সুফি সাধকদের ধর্ম, ইসলাম এ অঞ্চলে শুরুতে ছিলো মরমীবাদের ধর্ম। তবে দ্রুতই ক্ষমতালিপ্সা পেয়ে বসায় ইসলাম ধর্ম তার অহিংস রূপটি হারিয়ে ফেলে এবং ক্রমান্বয়ে রাজ্য দখলে মনোনিবেশ করে। অন্যথায় এ অঞ্চলে ইসলাম আজকে প্রেম এবং ভালোবাসার ধর্ম হিসেবেই টিকে থাকতো, ক্ষমতার প্রয়োজন হতো না। আরবের ইসলাম আর ভারতবর্ষের ইসলাম শুরুতে একই ছিলো না, সেই ধারাবাহিকতা ঠিক থাকলে আমরা অন্য এক ইসলাম ধর্ম ভারতবর্ষে পেতাম, যে ইসলাম চর্চা করে গিয়েছেন জালাল উদ্দিন রুমির মতো সাধকেরা।

বখতিয়ার খিলজি, মুহাম্মদ ঘুরি, কুতুবুদ্দিন আইবেক —এরা রক্তপাতের মাধ্যমেই ভারতবর্ষে ক্ষমতায় অরোহণ করেছিলো। তবে ইসলামের যে ধারাটি শুরুতে ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচার করেছিলো, এবং পরে এই যারা রক্তপাতের মাধ্যমে ক্ষমতায় আরোহণ করেছিলো তারা আসলে একই বিশ্বাসের মানুষ নয়। প্রথমপক্ষ শান্তিপ্রিয়, আধ্যাত্মিক এবং ধর্মতাত্ত্বিক, দ্বিতীয় পক্ষ ক্ষমতালোভী এবং সম্রাজ্যবাদী। কালের বিবর্তনে ইসলামের মরমীবাদী অংশটি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে ভারতবর্ষে ঘুরি, আইবেক, খিলজির দর্শন টিকে আছে। মূলত এখান থেকেই শুরু হয়েছে এ অঞ্চলে হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব। যে দ্বন্দ্ব চূড়ান্ত রূপ পায় পলাশী যুদ্ধে মুসলিমদের পরাজয়ে, যে যুদ্ধ চূড়ান্ত রূপ পায় ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগে, যে যুদ্ধ চূড়ান্ত রূপ পায় ১৯৭১-এ বাংলাদেশের জন্মের মধ্য দিয়ে।

সাম্প্রতিককালের হিসেবটি ধরলেও পলাশির যুদ্ধ থেকে ১৯৭১ —এগুলো মূলত হিন্দু-মুসলিম সমস্যা সমাধান এবং শোধ-প্রতিশোধের পরম্পরা, শুধু একটি ভূখণ্ডগত স্বাধীনতার বিষয় এটি নয়। ভারত বিভাজনে কত লোক প্রাণ হারিয়েছিলো এবং বাস্তচ্যুত হয়েছিলো, সেটি ইতিহাসের পাতায় স্পষ্ট নয়। তবে মতান্তরে এটি পাঁচ লক্ষ থেকে বিশ লক্ষ হতে পারে। হিন্দু-মুসলিম সবাই সবাইকে মেরেছিলো! কোনো অপরাধ দরকার ছিলো না— হিন্দু বলে মেরেছিলো, মুসলিম বলে মেরেছিলো। ১৯৭১ সালের ঘটনা সবার জানা। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে নির্বিচারে হিন্দু নিধনের ঘটনা ঘটেছে। ফলে ভারতবের্ষে শোধ-প্রতিশোধের ইতিহাস সমাপ্ত হয়নি। কখনই শাসকগোষ্ঠী মানুষের জন্য একটি ঐক্যমত তৈরির চেষ্টা করেনি। ১৯৭১ পরবর্তী বাংলাদেশে রাজনৈতিক যে পালাবদল এবং দোলাচল সেখানে ঐতিহাসিক এ সমস্যাগুলোর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। ভারতের হিন্দুত্ববাদ মুসলিমদের সহ্য করতে চায় না। মুসলিমরা এখনো ভারতবর্ষ দখল করতে চায়।

মুসলিমরা এ অঞ্চলে উড়ে এসে জুড়ে বসেনি। তাদেরকে খাতির করেই আনা হয়েছিলো। কেরালাতে একজন বনেদি এবং উচ্চ বংশীয় হিন্দু ব্যবসায়ী টাকা দিয়ে প্রথম মসজিদটি করে দিয়েছিলো, যেটি এখনো টিকে আছে। চেরামন জুম্মা মসজিদ হলো ভারতের কেরালা প্রদেশের কডুঙগাল্লুর তাল্লুকের মেথেলায় অবস্থিত একটি মসজিদ। চেরামন মসজিদকে বলা হয় ভারতের প্রথম মসজিদ, যেটি ৬২৯ সালে মালিক ইবন দিনার নির্মাণ করেন। তিনি ছিলেন রাজা চেরামন পেরুমলের প্রস্থানের পর ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারের জন্য ভারতে আসা প্রথম পরিচিত মুসলমানদের একজন । মূলত মালাবারের হিন্দু রাজা চেরামন পেরুমলই তাকে মসজিদটি নির্মাণ করতে সহযোগিতা করেছিলেন। চেরামন পেরুমলের কথা ইতিহাসের পাতায় বিভিন্নভাবে বিধৃত রয়েছে। বলা হয়ে থাকে— তিনি মক্কায় গিয়েছিলেন এবং নবী মোহাম্মদের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন।

ভারতবর্ষে এরকম অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে যে, অনেক উচ্চবংশীয় হিন্দুরাও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলো বৈষম্যমুক্ত, শান্তির এবং উদার এক ধর্ম হিসেবে। ফলে এ অঞ্চলে শুধুমাত্র নিম্নবর্ণের অত্যাচারিত হিন্দুরা শুধু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিললো, এ বক্তব্য পুরোপুরি ধোপে টেকে না। উগ্রবাদী ইসলাম এদেশে শেকড় বসাতে পেরেছিলো হিন্দু শাসকদের অত্যাচার, কুসংষ্কার, জাতফাত তথা বর্ণবৈষম্য এবং হিন্দু-বৌদ্ধ দ্বন্দ্বের ফাঁক গলে। অর্থাৎ, শুধু অস্ত্রের মুখে নয়, হিন্দু শাসকেরা তাদের উচ্চবিলাস এবং বৈষম্যবাদের কারণেও পরাজিত হয়েছিলো। ইতিহাস থেকে বোধদয় হলে ভারতবর্ষের উচিৎ ছিলো হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ সবাইকে সাথে নিয়ে একটি ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে সম্মত হওয়া। মুসলিমদের উচিৎ ছিলো ভৌগলিক বাস্তবতা বিবেচনায় অবিকল আরবীয় ইসলামের চর্চা না করে যে প্রতিশ্রুতি নিয়ে ভারতবর্ষে ইসলাম প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলো সেই প্রতিশ্রুতি ঠিক রাখা।

পুরো ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠা এখন প্রশ্নসাপেক্ষ, খুব কঠিন বলেই মনে হয়। নিশ্চয়ই অসম্ভব নয়। তবে বাংলাদেশ যেহেতু একটি সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতির মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয়েছে, ফলে বাংলাদেশে ঐক্যের রাজনীতি এবং সমাজনীতি সম্ভব। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য বাংলাদেশের সুস্পষ্ট সংবিধান রয়েছে, যেটি প্রয়োজনে পরিবর্তন করা যায়। মুক্তিযুদ্ধের সুস্পষ্ট দলিল রয়েছে, যেগুলো রাষ্ট্র চর্চার মূল ভিত্তি ধরা উচিৎ। সামাজিকভাবেই এখানে ইসলাম ধর্মের চর্চা প্রাধান্য পায়, তবে সেই ইসলাম যেন মরমীবাদের ইসলাম হয়, সেই ইসলাম যেন রুমির প্রেমবাদের ইসলাম হয়, সেই ইসলাম যেন ভারতবর্ষের ভৌগলিক বাস্তবতা মেনে নিয়ে সপ্তম শতাব্দিতে যে ইসলামের গোড়াপত্তন ভারতবর্ষে হয়েছিলো সেই ইসলাম হয়। শাসকদের আমদানি করা উগ্রবাদী ইসলাম চর্চা করতে চাইলে, বিপরীতে হিন্দুরা ইসলাম ধর্মকে জোরজবরদস্তিমূলক এবং অস্পৃশ্য ভাবতে চাইলে এ অঞ্চলে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান কখনই হবে না। মরমী ইসলামে নবী-রাসুল, নামাজ, রোজা সবইতো আছে, নেই শুধু আমিত্ব, নেই শুধু অহংকার, নেই শুধু শ্রেষ্ঠত্ব, নেই শুধু সম্রাজ্যবাদ, নেই শুধু পদে পদে বিধিনিষেধের খড়গ । তাহলে সমস্যাটা কোথায়? ভালোটা বাদ দিয়ে মন্দটা চর্চা করতে কেন চাইছেন?

কোনো ধর্মই রাষ্ট্র পরিচালনার অংশ হতে পারবে না। গত দুই হাজার বছর ধরে এ অঞ্চল শেষ হচ্ছে ধর্ম আর রাষ্ট্রকে আলাদা করতে না পারায়। যেকেনো মূল্যে এটি করতেই হবে। রাষ্ট্র চলবে আইনের শাসন দ্বারা। ধর্মীয় অনুশাসন ব্যক্তিগত, বড়জোর তা পারিবারিক। রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক মূল্যবোধ আধুনিক এবং ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকেই এসেছে। সেগুলো চর্চা করতে হলে ধর্মকে ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক পরিমণ্ডলে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। অন্যথায় ঐক্যের জায়গাটি কখনই তৈরি হবে না। থেমে থেমে, কয়েক বছর পরপর এরকম হানাহানি হতেই থাকবে। সকল ধর্ম বাদ দিয়ে মানবিক চর্চায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকলের জন্য একই আধ্যাত্মিক ঈশ্বর কল্পনা করতে পারতে হবে, যিনি ব্যক্তির একান্ত, যে শক্তি ব্যক্তির একান্ত আরাধ্য —এরকমটি হলে ভালো হত, তবে সেরকম কিছু চাওয়ার সুযোগ এখনো বোধহয় আসেনি। আপাতত রাষ্ট্র আর ধর্ম আলাদা হোক। আপাতত উগ্রবাদী হিন্দুত্ববাদ এবং উগ্রবাদী ইসলাম দূর হোক, বিপরীতে মরমী ইসলাম এবং হিন্দুধর্মের বাউলধারা মুক্তি পাক। মানুষ মুক্তি পাক।