এটা কি তাহলে ভারতের প্লান বি?

গণভবনে লুটপাট

সরকারি চাকরিতে রক্তক্ষয়ী কোটা সংস্কার আন্দোলনের এক পর্যায়ে শহীদ মিনারে লাখো জনতার উপস্থিতিতে ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম শেখ হাসিনার পতন চেয়ে এক দফা দাবী ঘোষণা করেন। এর আগে শহীদ মিনারে ছাত্র জনতার সমাবেশে লেখক-কবি-শিল্পী-চলচ্চিত্র নির্মাতা সহ সাংস্কৃতির অঙ্গনের লোকেদের উপস্থিতি এবং শেখ হাসিনার মহা সংকটকালে ভারতপন্থী অনেক বুদ্ধিজীবীদের নিরবতা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিলো— আসলে ভারতের ভূমিকা এক্ষেত্রে কী? এর পরের ঘটনা সবার জানা— সেনাবাহিনীর কারফিউ ভেঙে লাখো ছাত্র জনতা গণভবন ঘেরাউ করে শেখ হাসিনরা পতন নিশ্চিত করে। শেখ হাসিনা এবং বোন রেহানা সেনাবাহিনীর একাংশের সহায়তায় পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় নিয়ে প্রাণে বাঁচেন।

কোটাবিরোধী আন্দোলন
৬ জুলাই, দেশ জুড়ে সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ করে বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি পালন করে শিক্ষার্থীরা। তখন পর্যন্ত আন্দোলন কোটা সংস্কারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। যদিও সন্দেহ রয়েছে কোর্টের রায় থেকে শুরু করে সরকার পতনের দাবী পর্যন্ত সবই পূর্বপরিকল্পিত ছিল কিনা।

বিগত কয়েক বছর ধরে এই আওয়ামী লীগ আমলেই ভারত বিদ্বেষ চরম আকার ধারণ করেছিলো। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরাই এই বিদ্বেষের প্রধান মদদদাতা হয়ে উঠেছিলো। বিভিন্ন পর্যায়ের আওয়ামী নেতৃত্বও চলে গিয়েছিলো সাম্প্রদায়িক অপশক্তি এবং ভারত বিদ্বেষীদের কাছে। অন্যদিকে শেখ হাসিনার সরকারও কোশলী অবস্থান নিয়েছিলো— ভারতের সাথে স্বামী-স্ত্রী মানের সম্পর্কের কথা বললেও কার্যত চীনের সাথে গভীর পরকীয়ায় লিপ্ত হয়ে গিয়েছিলো শেখ হাসিনার সরকার, যেটি কোনোভাবেই ভারতের সহ্য হবার কথা নয়। ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ককে ‘স্বামী-স্ত্রীর মতো’ বলে অভিহিত করেছিলেন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ‘আজকাল’-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে একথা বলেছিলেন তিনি।

রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ চীনের সাথে সম্পর্ক উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করে চলছিলো। চীনের বিনিয়োগ বাড়তেছিলো, একইসাথে চীন থেকে আমদানীও বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। এদিক থেকে চীনকে ঘিরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক মন্দ হতে শুরু করেছিলো। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ চীনে যে পরিমাণ রপ্তানি করে তার প্রায় ২৯ গুণ বেশি আমদানি করে। বাংলাদেশে ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে পোশাক উৎপাদনে মোট এক হাজার ৫৮০ কোটি ডলার মূল্যের বিভিন্ন ধরনের কাঁচামাল আমদানি করা হয়। এর মধ্যে ৬৬১ কোটি ৩৪ লাখ ডলারের আমদানি হয় চীন থেকে। মোট কাঁচামাল আমদানির যা ৪২ শতাংশের মতো। পণ্য আমদানীতে ভারতের অবস্থান চীনের পরে। দেশে গত বছর সব মিলিয়ে ৬ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার পণ্য আমদানি হয়েছে। বিশ্বের ২১৫টি দেশ থেকে আমদানি করা হয় এসব পণ্য। এর মধ্যে ৬৫ শতাংশ বা ৪ লাখ কোটি টাকার পণ্যই এসেছে নয় দেশ থেকে। দেশগুলো হলো চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, মালয়েশিয়া, রাশিয়া, জাপান ও সিঙ্গাপুর। প্রত্যেকটি দেশ এককভাবে সরবরাহ করেছে ২০ হাজার কোটি টাকারও বেশি পণ্য। পাঁচ বছর আগে বাংলাদেশের বাজারে ৬০ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকার মেশিনারিজসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য সরবরাহ করেছিল চীন। ২০২৩ সালে সেখান থেকে এসেছে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার পণ্য। অর্থাৎ পাঁচ বছরের ব্যবধানে দেশের আমদানি পণ্যের বাজারে চীনের অংশীদারত্ব বেড়েছে ৫০ শতাংশেরও বেশি। পাঁচ বছর আগে ভারত থেকে ২৬ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকার ৪৭ লাখ টন পণ্য আমদানি করেছিল। ২০২৩ সালে আমদানি হয়েছে ২ কোটি ৮৭ লাখ টন। যার অর্থমূল্য ৮৯ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা। সে হিসাবে পাঁচ বছরের ব্যবধানে ৭০ শতাংশ অংশীদারত্ব বেড়েছে ভারতের।

গত পাঁচ বছরের হিসেবে চীনের চেয়ে ভারত থেকেই আমদানী বরং বেড়েছে, তাই ভারতের অসন্তুষ্টির জায়গাটি এক্ষেত্রে প্রধানত বাণিজ্যিক নয়। ভারত চীন ইস্যুতে অসন্তুষ্ট হয়েছে রাজিনৈতিক কারণে। চীন যে পরিমাণ বিনিয়োগ বাংলাদেশে করতে শুরু করেছিলো, তাতে ভারতের এটা ধারণা হওয়া অসম্ভব নয় যে, তারা মনে করেছিলো আওয়ামী লীগ সরকার মুখে অনেক কিছু বললেও প্রকৃতপক্ষে তারা ভারত বলয় থেকে বের হয়ে যেতে চাইছিলো।

শেখ হাসিনা পতনের আগে চীন সফরে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে তিনি প্রেসিডেন্ট শিং জিন পিং-এর সাথে গুরুত্বপূর্ণ কিছু চুক্তি করেন। এ বিষয়টিকে ভারত অত্যন্ত সন্দেহের চোখে দেখছে বলে কূটনৈতিক মহলের ধারণা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেইজিং সফর বাংলাদেশ ও চীনের সম্পর্ককে গভীর করেছে বলে উল্লেখ করেছে বলে উল্লেখ করে চীনের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম। চীনের প্রায় সকল গুরুত্ব সংবাদ মাধ্যমে শেখ হাসিনার সফরের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে ছাপা হয়। ভারতও শেখ হাসিনার চীন সফরের ওপর গভীরভাবে চোখ রাখছিলো।

শেখ হাসিনা
চীনের প্রিমিয়ার অব দ্য স্টেট কাউন্সিল (প্রধানমন্ত্রী) লি শিয়াংয়ের আমন্ত্রণে ৮ জুলাই (২০২৪) বেইজিং পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

চীনের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ মাধ্যম সিজিটিএনের প্রতিবেদনে বলা হয়, আগামী বছর ‘জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্কের বর্ষকে (ইয়ার অব পিপল-টু-পিপল এক্সচেঞ্জস)’ সামনে রেখে দুই দেশকে সংস্কৃতি, পর্যটন, সংবাদমাধ্যম ও খেলাধুলার মতো খাতে বিনিময় এবং সহযোগিতা বাড়াতে চেষ্টা চালানোর আহ্বান জানিয়েছেন সি। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে এবং জাতিসংঘ ও অন্যান্য বহুপক্ষীয় কাঠামোর মধ্যে সমন্বয় ও সহযোগিতা জোরদার করতে চীন প্রস্তুত বলেও জানান তিনি।

গ্লোবাল টাইমসের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য উদ্ধৃত করে লেখা হয়— ‘বাংলাদেশ এক–চীন নীতি দৃঢ়ভাবে মেনে চলে, তাইওয়ান প্রশ্নে চীনের অবস্থানকে সমর্থন করে, চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপের দৃঢ়ভাবে বিরোধিতা করে এবং চীনের নিজের মূল স্বার্থ রক্ষার কাজকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে।’

শেখ হাসিনা বেইজিং সফরকালে এশিয়া ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিন লিকুনের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী তাকে সুদের হার কমাতে অনুরোধ করেছেন। শেখ হাসিনার বেইজিং সফরের আগে চীনের কাছে ৫০০ কোটি ডলার ঋণ চাওয়া হবে বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের ঘোষণার কথাও উল্লেখ করা হয়েছিলো হংকংভিত্তিক গণমাধ্যমটির প্রতিবেদনে।

এসসিএমপি জানায়, বাংলাদেশের এই ঋণের অনুরোধের বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে চীনের কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে বাসসের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং বাংলাদেশকে ১ বিলিয়ন ইউয়ান (আরএমবি) সহায়তার ঘোষণা দিয়েছেন।

ভারতীয় কূটনীতিক মহলের ধারণা ভেতরে ভেতরে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক খারাপ হতে থাকলেও শেখ হাসিনার চীন সফরের এ বিষয়গুলো ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশকে ভয়ানকভাবে উদ্বিগ্ন করেছে। ভারত এ অঞ্চলে বিগত কয়েক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মিত্র হিসেবে কাজ করে, যদিও ভারতের রাজনীতি অত্যন্ত কৌশলী এবং পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মতো প্রতিবেশী ইস্যুতে সন্দেহজনক।

গত কয়েক বছর ধরে ভারত বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ভয়ানকভাবে যে ভারত বিরোধী মনোভাব তৈরি হয়েছিলো সেটির দিকে নজর রাখছিলো ভারত। শেখ হাসিনা লাগাতার ক্ষমতায় থাকায় বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় পাকিস্তানের মতো জঙ্গিবাদ মাথাছাড়া দেওয়ার আশঙ্কা করেছিলো ভারত। এবং তাদের বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে আসে— জামায়াতের চেয়ে আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা এক্ষেত্রে অগ্রগামী।

ফলে আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনাই বাংলাদেশের একমাত্র বন্ধু, এ নীতি থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ হয়ত আগে থেকেই খুঁজছিলো ভারত। চীন সফর থেকে ফেরার পর ভারত সুযোগটি কাজে লাগিয়েছে বলে অনেকের ধারণা। বিষয়টিকে ভারতের ‘প্লানি বি’ বলা চলে। অর্থাৎ, চীনকে থামাতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে লেলিয়ে দেওয়া। ড. ইউনুসকে শেখ হাসিনা বিভিন্নভাবে খেপিয়ে তুলেছিলো, যুক্তরাষ্ট্রকেও, ফলে মাঠ সেভাবে প্রস্তুত ছিলো। অন্যদিকে দেশের মধ্যে হাসিনা বিরোধী মনোভাব পৌঁছেছিলো তুঙ্গে। ফলে ভারত এটি বুঝে গিয়েছিলো যে, শেখ হাসিনাকে হাতে রেখে বাংলাদেশের ওপর আধিপত্য বজায় রাখার দিন শেষ হয়ে গেছে। এর চেয়ে মন্দের ভালো হচ্ছে— যুক্তরাষ্ট্রই ড. ইউনুসকে দিয়ে বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণ করুক। চীনা আধিপত্য রুখে দেওয়ার জন্য এর চেয়ে ভালো বিকল্প ভারতের হাতে এই মহূর্তে কিছু ছিলো না।

সার্বিক বিবেচনায় গত ৫ আগস্ট ভয়ংকর এক গণবিক্ষোভের মুখে শেখ হাসিনার যে পতন হয়, সেখানে ভারত শেখ হাসিনার পক্ষে বিশেষ কোনো ভূমিকা রাখেনি বলেই ধারণা করা যায়। বরং এটাই বেশি সত্য যে, ভারত এই মুহূর্তে এটাই চেয়েছে। ভারত চেয়েছে— বাংলাদেশের গণমানুষের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে যাক। এই যে গণভবন লুট করতে দেওয়া, সকল ভাস্কর্য ভাঙতে দেওয়া, নির্বিচারে লুটপাট করতে দেওয়া —সেনা প্রধানের নির্দেশে এগুলো কি ঠেকানো সম্ভব ছিলো না? এখানেই প্রশ্ন উঠেছে বর্তমান সেনাপ্রধান কি তাহলে ভারতের চাওয়াটাই পূরণ করেছেন, যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য এবং শেখ হাসিনার পতন নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলো?