ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের নতুন বাস্তবতায় ভারতে বসবাসরত অবৈধ বাংলাদেশীরা কতটা বিপদে আছে?

কোলকাতা

২০২০ সালের শুরুতে ভারতের তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জি কিষান রেড্ডি দাবি করেছিলেন— ভারত যদি সবাইকে সেদেশে অবৈধভাবে ঢোকার এবং নাগরিকত্ব নেবার সুযোগ দেয় তাহলে বাংলাদেশ অর্ধেক খালি হয়ে যাবে।

জি কিষাণ রেড্ডি
এই দাবির সাথে দ্বিমত পোষণ করলেও তথ্যের ভিত্তিতেই একথা বলা যায় যে, বৈচিত্র্যময় এবং বড় দেশ হওয়ায় ভারতে বসবাসের আগ্রহ বাংলাদেশের শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে নয়, মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রচুর মানুষও ভারতে গিয়ে আর ফিরে আসে না। বিশেষ করে শ্রমিক সম্প্রদায়ের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি।

 

 

 

 

 

 

জবাবে বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রন্ত্রী বলেছিলেন, বাংলাদেশ যখন তার প্রতিবেশি দেশ ভারতের থেকে অর্থনৈতিকভাবে ভালো অবস্থানে রয়েছে, তখন বাংলাদেশ থেকে কেন কেউ ভারতে যেতে চাইবে।

জনাব কামালের এ বক্তব্য ভারত অস্বস্তিতে পড়লেও তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ভারত সমর্থিত সরকার হওয়ায় ভারত তখন আর বেশি জল ঘোলা করতে চায়নি বলে কূটনীতিক মহলের ধারণা।

 

 

 

 

এর আগে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনও এ বিষয়ে কড়া বক্তব্য দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ভারতে যদি অবৈধভাবে কোন বাংলাদেশি ব্যক্তি থাকে, তাহলে ভারত সরকারের কাছে তারা তাদের নাম ঠিকানা জানতে চাইবেন। এরপর যাচাই-বাছাই করে বাংলাদেশি হলে তাদের ফিরিয়ে নেয়া হবে। তখন পর্যন্ত বিষয়টি কথা চালাচালির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো।

কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এমন এক জায়গায় অবস্থান করছে, তাতে ভারত তার দীর্ঘদিনের ‘অবৈধ বাংলাদেশী’ তত্ত্বটি আবার সামনে নিয়ে আসতে চাইছে বলে সবাই মনে করছে।

“বাংলাদেশে ২৬ লক্ষ ভারতীয় চাকরি করছে” এ ধরনের একটি গুজব প্রচারে এদিক থেকে ভারতের লাভ হয়েছে। তারা এখন ‘অবৈধ বাংলাদেশী’ তত্ত্বটিকে গুজবের বিপরীতে তথ্যনির্ভর প্রতিক্রিয়া হিসেবেই দেখাতে চাইছে ভারত।

প্রকৃতপক্ষে কত বাংলাদেশি ভারতে অবৈধভাবে রয়েছে?

ঠিক কত সংখ্যক বাংলাদেশি ভারতে অবৈধভাবে ঢুকেছে, তা নিয়ে বিতর্ক এবং বিভ্রান্তি উভয়ই রয়েছে।

২০০৪ সালে ভারতের তদানীন্তন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শ্রীপ্রকাশ জয়সওয়াল সংসদে বলেছিলেন ভারতে ১ কোটি ২০ লক্ষ বাংলাদেশি রয়েছে।

তবে পরে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের রাজ্য সরকারের তোপের মুখে তিনি তার মন্তব্য প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। কারণ, তিনি বলেছিলেন বেশিরভাগ অবৈধ অভিবাসী বাস করছে পশ্চিমবঙ্গ এবং আসামে।

প্রকৃতপক্ষে ‘অবৈধ বাংলাদেশী’ পুরো ভারতবর্ষেই ছড়িয়ে রয়েছে, যদিও সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।

তবে, তিনি এই পরিসংখ্যানের সূত্র জানাননি। এবং এরপর থেকে ভারত সরকার স্বীকার করে নিয়েছিলো যে, ভারতে বাংলাদেশিদের অবৈধ অভিবাসন নিয়ে তাদের কাছে কোনো সঠিক তথ্য নেই।

“যে শস্য ভারতের দরিদ্রদের কাছে পৌঁছনো উচিৎ তা খাচ্ছে এরা (বাংলাদেশি অভিবাসীরা),” বলেছিলেন ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ্।”

এ বক্তব্য থেকেই বিভিন্নভাবে ভারতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে অভিবাসী হওয়া বাংলাদেশীদের নিয়ে বর্তমান ভারত সরকারের অবস্থান বোঝা যায়।

ভারত সরকার যা-ই বলুক না কেন— টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশীদেরকে আধার কার্ড এবং পাসপোর্ট বানিয়ে দেওয়ার চল ভারতে দীর্ঘদিন ধরেই রয়েছে। এবং এ সুযোগটি বাংলাদেশ থেকে যাওয়া হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষেরাই নিয়েছে।

বারাসাত
কোলকাতার বারাসাতের এই হোমিও দোকানটির মতো অনেক ব্যবসা পরিচালনা করছে অভিবাসী বাংলাদেশীরা, যাদের অভিবাসনের বয়স পঞ্চাশ বছর হতে চলেছে। তাদের দাবী অভিবাসনের মাত্র ২৫ বছর আগেও আমরা ছিলাম ভারতীয়, ফলে ‘অভিবাসন’ বলতে ঠিক যা বুঝানো হচ্ছে, সেটি তার কাছে বোধগম্য নয়। ছবিঃ ফলোআপ নিউজ-এর কোলকাতা প্রতিনিধি।

ভারতে অবস্থানরত ‘অবৈধ বাংলাদেশী’-এর বেশিরভাগই কি হিন্দু?

সাতক্ষীরার মানুষ দিনমজুর সামাদ (ছদ্মনাম) ভোমরা সীমান্ত পার হয়ে সপরিবারে কোলকাতায় প্রবেশ করেছেন বছর পাঁচেক আগে। ওখানে গিয়েও শ্রম দিয়ে টিকে গিয়েছেন। কিন্তু তার কোনো কাগজপত্র নেই। মূলত বাংলাদেশে বিভিন্ন এনজিও-এর কাছে ঋণের দায়ে জর্জরিত হয়ে সামান্য কুঁড়েঘরটুকু ফেলে ভারতে পাড়ি জমিয়েছিলেন। জনাব সামাদ ফলোআপ নিউজ-এর এই প্রতিবেদককে বলেন, কোলকাতায় তিনি ভালো আছেন, এবং ভবিষ্যতে কী হবে, এটা নিয়ে তিনি চিন্তিত নন।

খুলনার মানুষ বিশ্বজিৎ (ছদ্মনাম) বাংলাদেশ থেকে ঋণখেলাপী হয়ে চলে যান কোলকাতায়। বর্তমানে কোলকাতায় তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী। ভারতের নাগরিকত্ব এবং পাসপোর্ট করতে তিনি সমর্থ হয়েছেন, আবার বাংলাদেশী নাগরিকত্বও তার রয়েছে।

যশোরের মানুষ জব্বার (ছদ্মনাম) জামিনে মুক্ত হয়ে চলে যান তামিলনাড়ুর ভেলোর। সেখানে এখন তিনি মানি এক্সচেঞ্জের ব্যবসা করেন।

ফলে ভারতে ‘অবৈধ বাংলাদেশী’ রয়েছে —এই সত্যটি মেনে নিয়েই সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। তবে এক্ষেত্রে ভারতের বর্তমান সরকার শুধুমাত্র মুসলিমদেরকে লক্ষ্যবস্তু করতে চাইছে কিনা, সেটিই এখন বড় প্রশ্ন।

বাংলাদেশে নাম করতে সমর্থ হওয়া এবং দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে সুনামের সাথে চিকিৎসা দেওয়া এই হোমিও চিকিৎসক কোনো অনুমতি ছাড়াই কোলকাতায় চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন, একইসাথে তার নামে একটি ক্লিনিকও চলছে সেখানে। একইসাথে তিনি বাংলাদেশেও চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন, তার নামেই উভয় দেশে চিকিৎসা চলছে। ভারত সরকারের বর্তমান ভিসা নীতির কারণে তিনি বিপাকে পড়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসন বলছে, তিনি চিকিৎসক হিসেবে কতটা ভালো, সেটি আমাদের কাছে বিবেচ্য বিষয় নয়, ভারতে চিকিৎসা দিতে হলে কঠোর নীতিমালা অনুসরণ করতে হয়। ছবিঃ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে সংগৃহীত।

বিচার বিভাগের বক্তব্য

 ভারতের বিচার বিভাগ ২০২৩ সালের শেষের দিকে এসে ‘অবৈধ বাংলাদেশী’ সম্পর্কে তথ্য চেয়েছিলো।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারতে কী পরিমাণ অনিবন্ধিত অভিবাসী প্রবেশ করেছে এবং বাংলাদেশসংলগ্ন ভারতীয় রাজ্যগুলোতে এই সমস্যা মোকাবিলায় সরকার কী উদ্যোগ নিয়েছে, সে বিষয়ে জানতে চেয়েছেন দেশটির সুপ্রিম কোর্ট।

কী ভাবছেন ভারতে অবস্থানরত এ ধরনের বাংলাদেশীরা?

বাংলাদেশের বাগেরহাট জেলার মানুষ তাপস (ছদ্মনাম) পরিষ্কারভাবে এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, আমি চায়ের দোকানদার, আমি আইনকানুন বুঝি না, ওদেশেও আমার কিছু নেই, এদেশেও আমার কিছু নেই। আমি আসলে একজন দেশহীন মানুষ।

‘৭১-এর শহীদ সন্তান শিবনাথ (ছদ্মনাম) বলছেন, আমি বাংলাদেশী সংখ্যালঘু হিসেবে ভয়ে এবং ‘৭১-এর বেদনায় ভারতে এসেছি। ওদেশে আমার যা কিছু আছে, সেগুলো বিক্রি করে আমি ভারতে থাকছি, এটা অবৈধ কেন হবে? সারা পৃথিবীতেই অভিবাসন ঘটছে। ভারতের মানুষও অন্য কোনো দেশে যাচ্ছে।

এদিকে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একটি বিজ্ঞাপ্তি জারি করা হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে ভারতে অবস্থানরত ‘অবৈধ বাংলাদেশীদের’ মধ্যে উদ্বেগ আরো বাড়ছে।

অবৈধভাবে বাংলাদেশে থাকা বিদেশি নাগরিকদের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে বৈধতা অর্জনের যে সময় দেয়া হয়েছিলো, তা আবারও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। 

ভারতে এখনো নাগরিক না হতে পারে রহিমা এবং শেফালী (উভয়ই ছদ্মনাম) সুর মিলিয়ে বললেন, দুই দেশের সম্পর্কের ফাটল আমাদেরকে দিনকে দিন আরো অনিরাপদ করে তুলছে।

কোলকাতা
অনেকেরই উভয় দেশে ব্যবসা রয়েছে, এবং দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে। বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখতে চাইলেন অভিবাসন নিয়ে কাজ করেছেন এমন একজন বাংলাদেশী তাত্ত্বিক। তার মতে, দ্বৈত নাগরিকত্বে সুযোগ সুবিধার কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও, এটা অবৈধ কিছু নয়। বিশ্বায়নের এ যুগে রক্ষণশীল নীতিতে ফিরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ছবিঃ ফলোআপ নিউজ-এর কোলকাতা প্রতিনিধি।

সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাবলী

১. কর্ণাটকে হ্রদের কাছ থেকে বাংলাদেশি নারীর মরদেহ উদ্ধার, ধর্ষণের পর হত্যা বলে সন্দেহ

২. ভারতে গ্রেপ্তার হচ্ছে হাজার হাজার বাংলাদেশী, তৈরি হচ্ছে নতুন বন্দীশালা

৩. দিল্লিতে অবৈধ অভিবাসী ধরপাকড়, ৪৬ বাংলাদেশি আটক

৪. অনুপ্রবেশের অভিযোগে ভারতে আটক ১৩ বাংলাদেশি

৫. ভারতে অবৈধ বসবাস, মহারাষ্ট্র থেকে ১৭ বাংলাদেশি গ্রেফতার