২০২৪ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি আউন্স (২৮.৩৪৯৫ গ্রাম) স্বর্ণের বাজারমূল্য ছিলো ২৪০০ ডলার। এক বছরের ব্যবধানে এসে আন্তর্জতিক বাজারে স্বর্ণের বাজারমূল প্রতি আ্উন্স ৩০০০ ডলারের উপরে। বিভিন্ন কারণে বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দামের এ উল্লম্ফন। মূলত ২০০০ সালের পর থেকে স্বর্ণের দাম তরতর করে বাড়তে শুরু করে। কভিডের পরে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে।
সোনার দাম অর্থনীতি কতটা সুস্থ তার একটি ভালো সূচক। যখন সোনার দাম বেশি থাকে, তখন অর্থনীতি সুস্থ থাকে না। কেন? বিনিয়োগকারীরা যখন তাদের বিনিয়োগকে সংকট বা মুদ্রাস্ফীতি থেকে রক্ষা করার জন্য সোনার দিকে ঝুঁকে পড়েন। যখন সোনার দাম কমে যায়, তখন সাধারণত এর অর্থ অর্থনীতি সুস্থ থাকে। কারণ বিনিয়োগকারীরা স্টক, বন্ড বা রিয়েল এস্টেটের মতো অন্যান্য, আরও লাভজনক বিনিয়োগের জন্য সোনা ছেড়ে দিয়ে থাকেন। অর্থনীতি বুঝতে হলে সোনার বাজার বোঝা সহায়ক।
ঐতিহ্যগতভাবে ভারতীয়দের সোনার গহনার প্রতি সবসময়ই একটা আকর্ষণ থাকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত এবং বাংলাদেশ সোনার ব্যবহার (গহনার জন্য কেনা) ধারণা থেকে সোনার বিনিয়োগের দিকে (ভবিষ্যতের সুবিধার জন্য কেনা) এগিয়ে যেতে শুরু করেছে। বলা হয় যে, এখন সোনা বেশি কেনা হয়, কারণ, এটি উচ্চ রিটার্ন প্রদান করে। ভারতের অর্থনীতির তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যাচ্ছে— এপ্রিল ২০০৩ থেকে মার্চ ২০১৩ পর্যন্ত রিটার্ন যদি তুলনা করা হয় তাহলে ১০০০ টাকা বিনিয়োগ করলে সোনায় ৫২৬৭ টাকা এসেছে। ২০১৩ থেকে পরের দশকে এসেছে প্রায় ৭০০০ টাকা। বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি হয়েছে আরো বেশি।

২৫ মার্চ ২০২৫-এ মূল্য দাঁড়িয়েছে ১ লক্ষ ৫৫ হাজার টাকা। ২০০৮ সালে সোনার ভরি ছিলো ২৬,০০০ টাকা। ২০১৮ সালে সোনার ভরি ছিলো ৫১,০০০ টাকা। ছয় বছরে স্বর্ণের দাম তিনগুণ হওয়াটা বাংলাদেশের মতো কালো টাকার অর্থনীতির দেশে বিপদজনক। টাকা স্বর্ণে আটকে গেলে বাজার উৎপাদনশিলতা কমে। বাড়িতে বাক্স বন্দী স্বর্ণ বা স্বর্ণকারের ভল্টে জমা হওয়া স্বর্ণ ব্যাংকে গচ্ছিত টাকার মতো আচরণ করে না। এখান থেকে কেউ বিনিয়োগ সুবিধা পায় না। এটা ক্রয়কৃত জমির মতোও আচরণ করে না, জমি থেকে ফসল হিসেবে বা আবাসভূমি হিসেবে কেউ-না-কেউ যে উপযোগ পায়, স্বর্ণ থেকে তা পাওয়া যায় না। এজন্য স্বর্ণকে বলা যেতে পারে কালো টাকার চৌবাচ্চা।
কেন ২১ শতকে স্বর্ণের দাম লাগামহীনভাবে বাড়ছে তার কয়েকটি প্রধান কারণ নিম্নরূপ:
১.
ঐতিহাসিকভাবে সোনাকে অর্থনৈতিক অস্থিরতা বা মন্দার বিরুদ্ধে একটি স্থিতিশীল হেজ হিসেবে দেখা হয়ে আসছে। এই কারণে, অনেক বিনিয়োগকারী এমনকি দেশগুলি তাদের বিনিয়োগকে বৈচিত্র্যময় করতে এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনের জন্য সোনা ক্রয় করে।
২.
চীন, ভারত এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মতো উদীয়মান বাজারগুলোতে উদীয়মান মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সম্পদ বৃদ্ধির সাথে সাথে সোনার চাহিদা, বিশেষ করে গয়না এবং বিনিয়োগ হিসাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই জনসংখ্যাগত পরিবর্তন বিশ্বব্যাপী সোনার টেকসই চাহিদা এবং মূল্যে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে।

৩.
সোনার গয়নার বিশ্বব্যাপী চাহিদা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার ফলে গয়নার মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, বার্ষিক বিশ্ব বাজারের আকার গড়ে প্রায় $৩০০ বিলিয়ন, এবং এর দাম কমার কোনো লক্ষণ নেই।
৪.
সোনার মূল্য তার প্রশংসিত নান্দনিকতার বাইরেও— সোনা একটি অত্যন্ত অনন্য মূল্যবান ধাতু। সোনা ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না বা বিবর্ণ হয় না এবং এটি একটি নরম উপাদান যা সহজেই সরু তারের মধ্যে টেনে বের করা যায় বা পাতলা আবরণে প্রলেপ দেওয়া যায়। এই গুণাবলী ইলেকট্রনিক্স, সার্কিট বোর্ড, বৈদ্যুতিক যানবাহন, স্বাস্থ্যসেবা সরঞ্জাম এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি খাতে ব্যবহারের জন্য সোনাকে একটি ব্যতিক্রমী পছন্দ করে তোলে।
৫.
সোনা একটি সীমিত সম্পদ, যার সীমিত সরবরাহ আমরা ব্যবহার করে আসছি। সোনা খনন একটি কঠিন প্রক্রিয়া এবং পরিবেশগতভাবে বেশ ক্ষতিকারক, যা উপলব্ধ সোনার ঘাটতিতে অবদান রাখে।
সোনা তার অনন্য বৈশিষ্ট্য এবং মানব জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর সুপ্রতিষ্ঠিত ভূমিকার ফলে তার অন্তর্নিহিত এবং ঐতিহাসিক মূল্য ধরে রেখেছে। প্রাচীন মুদ্রা থেকে শুরু করে আধুনিক প্রযুক্তি পর্যন্ত, সোনা মূল্যবান কারণ এর ব্যবহারিক প্রয়োগ, প্রতীকী তাৎপর্য এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতার বিরুদ্ধে সুরক্ষা হিসেবে কাজ করার ক্ষমতা। প্রযুক্তির উত্থান এবং সমাজে পরিবর্তন সত্ত্বেও, হাজার বছর ধরে সোনার মূল্য কেন ছিলো তার কারণগুলি আজও সত্য এবং সম্ভবত অদূর ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে।
সোনা পরিবারের আস্থা থেকে এখন কালো টাকার রক্ষকে পরিণত হওয়াতেই গোলটা বেধেছে। ব্যাংক একাউন্ট দৃশ্যমান, জমিতে বিনিয়োগ করলে সেটিও দৃশ্যমান। কিন্তু কোথায় কতটুকু স্বর্ণ কে জমিয়ে রাখছে সেটি খুব বেশি দৃশ্যমান নয়। স্বর্ণের বাজার দেখভাল করার দায়িত্ব যাদের, তাদের কাছে প্রশ্ন থেকে যায়— কীভাবে হিসেবটা তারা জনগণকে জানাতে চায়, বা আদৌ জানাতে চায় কিনা।
মাত্র ২২ বছর আগে স্বর্ণের ভরি ছিলো ৬০০০ টাকা, এখন ১ লক্ষ ৫৫ হাজার টাকা। ২২ বছরে স্বর্ণের দাম কোনো দেশে ২৫ গুণ বৃদ্ধি পেলে বিনিয়োগ হিসেবে সেটি হয়তো শুনতে ভালো শোনায়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে একটি দরিদ্র এবং উদিয়মান অর্থনীতির দেশে এটি রীতিমতো হুমকি। কালো টাকা শুধু মানুষ করছে না, মানুষের ভাঙা ঘাড় আরো ভেঙে বছর বছর সেটি ভয়ানকভাবে বাড়িয়েও নিচ্ছে।
স্বর্ণের ব্যবসায়ীরা কী বলছেন?
স্বর্ণের দাম বাড়লে ব্যবসার ওপর কী প্রভাব পড়ে— বিষয়টি বুঝতে ফলোআপ নিউজ কয়েকজন ক্ষুদ্র স্বর্ণ (গয়না) ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলেছে। যেহেতু ক্ষুদ্র জুয়েলার্স ব্যবসায়ীরা বাজারের ওপর নির্ভরশীল এবং স্বর্ণ মজুদ এবং ‘আমদানী বা রপ্তানিতে’ নিয়োজিত নয়, ফলে বাজারদর এবং ভোক্তাদের চাহিদা দ্বারা তারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়।
ভূমিকা জুয়েলার্সের স্বত্বাধিকারী বিশ্বজিৎ সরকার বাপ্পি বলেন, সোনার দাম বাড়লে ব্যবসা কমে। কারণ, সোনা কিনতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। স্বর্ণের সাপ্লাই চেইন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অন্যান্য পণ্যের মতো স্বর্ণের কোনো সাপ্লাই চেইন নেই। আমরা মূলত রিসাইকেল-এর উপর নির্ভরশীল। যদিও জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে এবং সোনার গয়না জমানোর প্রবণতায় বাড়তি স্বর্ণের যোগান সম্পর্কে তিনি কিছু বলতে পারেননি।
সম্পর্কিত সংবাদ