১৯৮৭ সালের ভোগ্যপণ্য আইন অনুযায়ী জেলাপ্রশাসকের কার্যালয় থেকে স্বর্ণ ব্যবসার জন্য একটি ডিলিং লাইসেন্স দেওয়া হয়। সেখানে একজন ব্যবসায়ী কি পরিমাণ স্বর্ণ ক্রয়-বিক্রয় ও মজুদ রাখতে পারবে এর পরিমাণ ও বিনিময়ের কথা উল্লেখ রয়েছে। তবে স্বর্ণালঙ্কার বন্ধক রেখে সুদ আদায়ের কোনো নিয়ম নেই বলে জানান (একটি পত্রিকাকে তিনি বলেছিলেন) সিনিয়র সহকারী কমিশনার দেবাশীষ বসাক।
কিন্তু স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা ডিলিং লাইসেন্স নিয়ে সরকারি কোনো নিয়মনীতিও না মেনে চড়া সুদে চালিয়ে যাচ্ছে বন্ধকী সুদ ব্যবসা। চড়া সুদে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করতে গিয়ে প্রতারিত ও সর্বস্বান্ত হচ্ছেন মানুষ। হেলাতলা এলাকায় বাগেরহাট জুয়েলার্স, সাগরিকা জুয়েলার্স, রত্না জুয়েলার্স, শতরূপা জুয়েলার্স, দোলা জুয়েলার্স সহ এ সুদের কারবার নগরীর হেলাতলা মোড় এলাকার অধিকাংশ জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানে চলছে। রয়েছে অনেক ভ্রাম্যমাণ সুদের ব্যবসায়ী। বন্ধকী ব্যবসায় ১০০ টাকায় মাসে তিন থেকে পাঁচ টাকা পর্যন্ত সুদ নেওয়া হয়। সে হিসেবে বছরের সুদের হার দাঁড়ায় ৩৬ থেকে ৬০ শতাংশ। স্বর্ণ নেওয়ার সময় এবং দেওয়ার সময় ওজনের পার্থক্যের মতো কারচুপিও রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
স্বর্ণ বন্ধক রাখা গ্রাহকদের কাছে প্রমাণ হিসেবে তেমন কিছুই দেওয়া হয় না। লিখে রাখা হয় ঋণের পরিমাণ, সুদের হার, এবং কী পরিমাণ স্বর্ণ জমা দেওয়া হয়েছে তার তথ্য। অলিখিত শর্তানুযায়ী কোনো ঋণ গ্রহীতা টানা তিন মাস সুদের টাকা পরিশোধ করতে না পারলে স্বর্ণ গলিয়ে বিক্রয় করার অধিকার থাকে বন্ধকী ব্যবসায়ীদের। পাশাপাশি সুদ ও ঋণের টাকার পরিমাণ বন্ধকী স্বর্ণের দামের সমান বা বেশি হয়ে গেলে স্বর্ণ গলিয়ে ফেলার অদৃশ্য শর্তও জুড়ে দেন ব্যবসায়ীরা।
মূলত স্বর্ণের মায়ায় বা স্মৃতির মায়ায় ব্যবহারকারীরা এ ফাঁদে পড়ে। তাৎক্ষণিক কোনো ধরনের কাগজপত্র ছাড়া টাকা পাওয়ার আর কোনো সহজ পথ নেই। ক্ষুদ্র ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও এক সপ্তাহের আগে টাকা দিতে পারে না। এক্ষেত্রেও কিছু কাগজপত্র লাগে। কিন্তু বন্দকী ব্যবসার প্রাণভোমরা হচ্ছে স্বর্ণ, এনে দিলেই হলো।
তবে বাগেরহাট জুয়েলার্সের স্বত্বাধিকারী অজয় কুমার বকশি বলছেন, তিনি অনুমতি নিয়ে এবং পাকা রশিদ দিয়েই ব্যবসা করেন। তবে এই চর্চায় কিছু ব্যত্যয় আছে বলে তিনি জানান।
একটি পত্রিকার কাছে ২০২০ সালের গোড়ার দিকে নগরীর বসুপাড়া এলাকার মোঃ সাব্বির শেখ জানান, তিনি যখন ঋণ নেন তখন স্বর্ণের ভরি ছিলো ৪৪ হাজার টাকা। কিন্তু বন্ধক রাখতে গেলে দাম ধরা হয় ২৫ হাজার টাকা ভরি। সেই হিসেবে আমার ৫ ভরির দাম আসে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। আমাকে ঋণ দেয় ৬০ হাজার টাকা। প্রতি মাসে সুদ দিতে হয় ৪ হাজার টাকা। ৬ মাসের মধ্যে মাল ছাড়িয়ে নেওয়ার কথা ছিলো, কিন্তু সেই সময়ের ৯ দিন পরে যাওয়ায় মনিলাল মজুমদার আমাকে জানায় মহাজন মাল গালিয়ে ফেলেছে। এখন আর কিছুই করার নেই।
বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির সভাপতি শ্যামা প্রসাদ কর্মকার ফলোআপ নিউজে জানান, বন্ধকী ব্যবসার লাইসেন্স রয়েছে। তবে সেটির পরিমাণ অনেক কম। সেখানে ৩ শতাংশ হারে সুদের কাজ চলে। যাদের বন্ধকী লাইসেন্স নেই তারা বন্ধকী ব্যবসা করলে সেটি অবৈধ।
হেলাতলা এলাকার স্বর্ণ ব্যবসায়ী মিথুন জানান, আমার বন্ধকী ব্যবসার লাইসেন্স রয়েছে। মাসে ৪ শতাংশ লভ্যাংশ নিয়ে টাকা দিয়ে থাকি।
হেলাতলা এলাকায় চিকন গলির মধ্যে কোনো ধরনের সাইনবোর্ড ছাড়াই ব্যবসা করছেন মনিলাল মজুমদার। ছোট্ট এই দোকানে সুদের ব্যবসা করে তিনি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। তিনি জানান, আমার কোনো বন্ধকী লাইসেন্স নেই। তবে মহাজনের বন্ধকী লাইসেন্স রয়েছে। তাছাড়া আমার দাদারও রয়েছে। সে কারণে আমি এ ব্যবসা করি। আমরা প্রতি মাসে হাজারে ৪০ টাকা লাভ নিয়ে থাকি। শুধু আমরা নয় এখানের প্রায় সব জুয়েলারি দোকানদার এ ব্যবসা করে। এছাড়া অনেকে ভ্রাম্যমাণ কিছু ব্যবসায়ীও রয়েছে। তারাও টাকা লাগায়। দোলা জুয়েলার্সের বরুণ জানান, স্বর্ণ বন্ধকী রেখে টাকা দেই। মাসে সুদের হার ৪ শতাংশ। নিয়ম মেনেই সুদের কারবার করি। আমাদের কাছে জেলাপ্রশাসকের দপ্তর থেকে লাইসেন্স রয়েছে।
সম্পর্কিত
বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে আছে দ্বাররক্ষক— মনে হবে সে সোনার দোকান পাহারা দিচ্ছে, আসলে ডাকাত পাহারা দিচ্ছে। থরে থরে সাজানো গয়না— বলা হয়ে থাকে স্বর্ণ হচ্ছে সর্বোৎকৃষ্ট বিনিয়োগ। তা বটে, কিন্তু কীভাবে এটি সর্বোৎকৃষ্ট? দিনশেষে গরীব দেশগুলো এ বিনিয়োগের ধোকায় পড়ে, আর বিশ্বব্যাপী লাভবান হয় গোল্ড ট্রেডার্সরা। খনি শ্রমিক গরিব, ব্যবহারকারী গরিব, দোকানের কর্মচারী গরিব, বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাও গরিব, বিপরীতে বিশ্বব্যাপী আছে কিছু গোল্ড মাফিয়া। স্বর্ণ মানে সম্পদ! এমনই এক সম্পদ, যা ভোগ করা যায় না, অথচ তা সম্পদ! জমিতে ফসল হয়, ঘর করা যায়, কিন্তু সোনায়? তাহলে কীভাবে তা সম্পদ? কিন্তু পৃথিবীর তাবৎ ধনী রাষ্ট্রগুলো দিয়ে রেখেছে এই মহা ধোকা— স্বর্ণ! ঠিক আর কতদিন টিকে থাকবে এই স্বর্ণধোকা?