১. সীমান্ত (ডিউর্যান্ড লাইন) ইস্যু
-
ব্রিটিশ আমলে ১৮৯৩ সালে “ডিউর্যান্ড লাইন” নামের একটি সীমান্ত নির্ধারণ করা হয় আফগানিস্তান ও তখনকার ব্রিটিশ ভারতের মধ্যে।
-
আফগানিস্তান এই সীমান্ত কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেনি, কারণ এতে তাদের পাখতুন (Pashtun) জনগোষ্ঠীর অর্ধেক অংশ এখন পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে পড়ে গেছে।
-
ফলে দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের ভূখণ্ডগত বিরোধ আছে।
⚔️ ২. তালেবান ও পাকিস্তানের জটিল সম্পর্ক
-
পাকিস্তান একসময় আফগান তালেবানকে সমর্থন ও আশ্রয় দিয়েছিলো, বিশেষ করে ১৯৯০-এর দশকে।
-
কিন্তু তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর (২০২১ সালে) তারা পাকিস্তানের প্রভাব মানতে রাজি নয়।
-
পাকিস্তান এখন তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (TTP) নামের সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলার শিকার, আর এই TTP-র অনেক নেতা আফগানিস্তানে আশ্রয় পেয়েছে বলে অভিযোগ।
৩. সীমান্তে সংঘর্ষ ও প্রতিশোধ
-
সীমান্তের দুই পাশে নিয়মিত গোলাগুলি, সেনা সংঘর্ষ, এবং হত্যাকাণ্ড ঘটে।
-
পাকিস্তান সীমান্তে বেআইনি অভিবাসী বা জঙ্গি অনুপ্রবেশ রোধে দেয়াল তুলছে, যা আফগানরা বিরোধিতা করছে।
-
এতে আফগান সেনা বা স্থানীয় সশস্ত্র গোষ্ঠী পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ করে। এর প্রতিশোধে পাকিস্তানও হামলা চালায়।
৪. জাতিগত ও অভ্যন্তরীণ ক্ষোভ
-
অনেক আফগান মনে করে পাকিস্তান তাদের দেশে অস্থিতিশীলতা তৈরি করেছে, মার্কিন যুদ্ধে পাকিস্তান “দ্বৈত ভূমিকা” পালন করেছে—একদিকে আমেরিকার বন্ধু, অন্যদিকে তালেবানকে আশ্রয় দিয়েছে।
-
ফলে পাকিস্তানকে তারা “বিশ্বাসঘাতক” মনে করে।
সংক্ষেপে:
আফগানরা পাকিস্তানিদের আক্রমণ করে মূলত
১. পরনো সীমান্ত বিরোধের কারণে,
২. তালেবান ও পাকিস্তান সরকারের মধ্যে প্রভাব ও স্বার্থের সংঘর্ষে,
৩. এবং পাকিস্তানের প্রতি জাতিগত-রাজনৈতিক ক্ষোভ থেকে।
১৯৪৭ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত আফগান–পাকিস্তান সম্পর্কের একটি টাইমলাইনঃ
️ আফগান–পাকিস্তান সম্পর্ক টাইমলাইন (১৯৪৭ – ২০২৫)
১৯৪৭ – ১৯৫০
-
১৯৪৭: পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরই আফগানিস্তান জাতিসংঘে পাকিস্তানের সদস্যপদে “না” ভোট দেওয়া একমাত্র দেশ হয়। কারণ, পশতুনিস্তান ইস্যু (পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের পশতুন অঞ্চল নিয়ে বিরোধ)।
-
১৯৪৯: আফগানিস্তান পাকিস্তানের সীমান্তকে “ডুরান্ড লাইন” হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে। সীমান্তে প্রথমবার সংঘর্ষ ঘটে।
১৯৫০ – ১৯৬০
-
দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক উত্তেজনা বাড়ে; সীমান্ত একাধিকবার বন্ধ হয়।
-
পাকিস্তান পশ্চিমা মিত্রে (CENTO, SEATO) যোগ দেয়; আফগানিস্তান ঘনিষ্ঠ হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে।
১৯৬১ – ১৯৭০
-
১৯৬১: সীমান্ত পুরোপুরি বন্ধ। বাণিজ্য ও কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন।
-
১৯৬৩: সম্পর্ক পুনঃস্থাপন। আফগান প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ দাউদ খান পদত্যাগের পর উত্তেজনা কিছুটা কমে।
-
১৯৭৩: দাউদ খান রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করেন এবং আবার পশতুনিস্তান ইস্যু তোলেন।
১৯৭৯ – ১৯৮৯: সোভিয়েত আগ্রাসন ও আফগান যুদ্ধ
-
১৯৭৯: সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তানে প্রবেশ করে।
-
পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায়, মুজাহিদিনদের আশ্রয় ও প্রশিক্ষণ দেয়।
-
সীমান্তে লক্ষাধিক আফগান শরণার্থী আশ্রয় নেয়।
-
পাকিস্তান ও আফগান মুজাহিদিন ঘনিষ্ঠ হয়; সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে সহযোগিতা বাড়ে।
১৯৯০ – ২০০০
-
১৯৯২: মুজাহিদিন সরকার কাবুল দখল করে; পাকিস্তান সমর্থন করে।
-
১৯৯৪: তালেবান আন্দোলনের উত্থান – পাকিস্তানের সহায়তায় গঠিত হয়।
-
১৯৯৬: তালেবান কাবুল দখল করে; পাকিস্তান স্বীকৃতি দেয় তিন দেশের এক হিসেবে (সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত সহ)।
-
২০০১: ৯/১১ ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রের আফগান আক্রমণ; পাকিস্তান সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হয়— তালেবানবিরোধী অবস্থান নেয় আনুষ্ঠানিকভাবে।
২০০১ – ২০১৪: সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধকাল
-
পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে তালেবান আশ্রয় দেওয়া–নেওয়া নিয়ে অভিযোগ বিনিময় চলতে থাকে।
-
সীমান্তে ঘনঘন গোলাগুলি ও সংঘর্ষ ঘটে।
-
আফগান সরকার বারবার অভিযোগ করে পাকিস্তান “ডাবল গেম” খেলছে— একদিকে যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা করছে, অন্যদিকে তালেবানকে আশ্রয় দিচ্ছে।
২০১৫ – ২০২০
-
২০১৫: আফগান ও পাকিস্তানি সরকার শান্তি আলোচনা শুরু করে (মুর্রি টকস), কিন্তু সফল হয় না।
-
২০১৭: পাকিস্তান সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ শুরু করে।
-
২০১৯: আফগানিস্তান পাকিস্তানের বাণিজ্যিক পণ্য পরিবহনে সীমাবদ্ধতা আরোপ করে; সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ থাকে।
২০২১ – ২০২৩: তালেবান পুনরায় ক্ষমতায়
-
আগস্ট ২০২১: তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে।
-
পাকিস্তান প্রথমদিকে আশাবাদ দেখালেও শিগগিরই উত্তেজনা শুরু হয়, বিশেষ করে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (TTP)–এর নিরাপদ আশ্রয় আফগানিস্তানে রয়েছে বলে অভিযোগ তোলে।
-
সীমান্তে সংঘর্ষ, বাণিজ্য বাধা, ও কূটনৈতিক বিবাদ বাড়তে থাকে।
২০২৪ – ২০২৫ (বর্তমান সময়)
-
২০২4: পাকিস্তান আফগান শরণার্থী ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়, যা কাবুলের সঙ্গে সম্পর্ককে আরো খারাপ করে।
-
২০২৫: আফগান সীমান্তে একাধিক সংঘর্ষ ও TTP হামলার পর দু’দেশের মধ্যে পরিস্থিতি অত্যন্ত উত্তেজনাপূর্ণ হয়।
-
কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রায় বরফঠাণ্ডা হয়ে পড়ে; উভয় দেশই একে অপরকে সীমান্ত নিরাপত্তাহীনতার জন্য দায়ী করছে।
