আল ফাসারের হত্যাকাণ্ডঃ সুদানে সংগঠিত ভয়ংকর এক গণহত্যা

গণহত্যা

এখনো মানুষ হত্যার উৎসবে মাতে,

গ্রেনেড-বম্দুক এবং শাস্ত্র হাতে।

সভ্য যারা তারা দূরে,

আমার রুজি তাদের কাছে

চলে যায় ঘুরে ঘুরে।

হায় দারফুর! হায় সুদান!

এখনো তারা জলসাঘরে,

যারা সেজেছে কন্ডোম পরে মহান।


আল ফাসার
হত্যাকারীদের মতাদর্শ হলো আরব জাতি ও ইসলামিক শ্রেষ্ঠত্বের নামে দারফুরে নন-আরব জনগোষ্ঠীকে নিধন, স্থানচ্যুতি ও দমন করা।

তারিখ: ১ নভেম্বর ২০২৫ | সূত্র: আল জাজিরা, দ্য গার্ডিয়ান, জাতিসংঘের প্রতিবেদন এবং উইকিপিডিয়া অবলম্বনে এআই-এর সহযোগিতায় প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।

২০২৩ সালে পুনরায় গণহত্যা শুরুর পর থেকে দেশটিতে এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৫০ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। আর ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ নিজ বাড়ি থেকে পালিয়ে বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়েছেন। জাতিসংঘ সুদানের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিকে বিশেষ সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয় হিসেবে অভিহিত করেছে।

দারফুরে গণহত্যা

আল ফাসারে RSF বাহিনীর হামলায় নিহত দেড় হাজারেরও বেশি মানুষ

খার্তুম, সুদান:
গত কয়েকদিনে সুদানের পশ্চিম দারফুর অঞ্চলের শহর আল ফাসারে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞে অন্তত ১,৫০০-এরও বেশি সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছে। আধাসামরিক বাহিনী Rapid Support Forces (RSF) শহরটির নিয়ন্ত্রণ নিতে গিয়ে গত সপ্তাহে নির্বিচারে বেসামরিক জনগণের ওপর হামলা চালায়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, RSF সদস্যরা শহরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে পুরুষদের গুলি করে হত্যা করে এবং নারী-শিশুদের অপহরণ করে নিয়ে যায়। শহরের হাসপাতাল, বাজার ও আশ্রয়কেন্দ্রগুলো সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে।

জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো একে “গণহত্যা” (genocide)“জাতিগত নির্মূল অভিযান” (ethnic cleansing) হিসেবে অভিহিত করেছে। অভিযোগ উঠেছে, RSF বাহিনী মূলত আফ্রিকান বংশোদ্ভূত সম্প্রদায়গুলোকেই লক্ষ্যবস্তু করেছে।

মানবিক সহায়তা সংস্থাগুলোর মতে, বর্তমানে শহরে খাদ্য, পানি ও ওষুধের মারাত্মক সংকট চলছে। হাজার হাজার মানুষ আশ্রয় হারিয়ে পার্শ্ববর্তী এলাকায় পালিয়ে যাচ্ছে।

জাতিসংঘ, আফ্রিকান ইউনিয়ন ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এই হত্যাযজ্ঞের নিন্দা জানিয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর যুদ্ধবিরতি বা শান্তি প্রক্রিয়া বাস্তবায়িত হয়নি।

দারফুর
আল-ফাসারে একটি হাসপাতালে ঢুকে হত্যা করা হয়েছে ৪০০-এর বেশি মানুষকে। যাদের মধ্যে অনেক নারী ও শিশুও রয়েছে। হত্যাকাণ্ড নির্দিষ্টভাবে বেছে বেছে করা হয়েছে। অর্থাৎ হত্যাকারীরা হাসপাতালেও ঢুকে নন-আরব রোগীদের আলাদা করে শনাক্ত করে হত্যা করেছে। তারা মূলত দারফুরে নন-আরব জনগোষ্ঠীকেই হত্যার জন্য লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে।

সম্প্রতি সুদানের আল-ফাসার হাসপাতালে যে ভয়াবহ গণহত্যা চালানো হয়েছে, সেখানে নন-আরবদের সণাক্ত করা হলো কীভাবে?

যেভাবে আল ফাশারের (El Fasher) হাসপাতাল ও ডারফুরে নন‑আরব জনগোষ্ঠীকে “বেছে‑বেছে” টার্গেট করার রিপোর্ট আসছে, তদন্তকারীরা ও প্রত্যক্ষদর্শীরা একই রকম প্যাটার্ন দেখিয়েছেন।

১. নাম ও পরিচয়পত্র পরীক্ষা: হামলাকারীরা রোগীর/আশেপাশের মানুষের নাম, জাতীয় পরিচয়পত্র বা হসপিটাল রেকর্ড দেখে আরবীয় নয় এমন নাম বা কুল‑/বংশনামের ওপর ভিত্তি করে শনাক্ত করেছে। বহু মানবাধিকার রিপোর্ট এই পদ্ধতির কথা উল্লেখ করে।

২. ভাষা ও উচ্চারণ (accent): যারা ফুরি, মাসালিত বা অন্যান্য নন‑আরব ভাষায় কথা বলে কিংবা আরবি উচ্চারণে ভিন্নতা আছে, তাদের আলাদা করা হয়েছে। কথ্য ভাষা ও আঞ্চলিক উচ্চারণ শনাক্তকরণে কাজ করেছে।

৩. শরীরিক/সামাজিক দৃশ্যমান কারণ: শরীরের বিশেষ চিহ্ন, স্থানীয়ভাবে পরিচিত পোষাক, ঐতিহ্যবাহী দাগ/মার্ক বা কৃষিকাজ‑সংক্রান্ত পোশাক ইত্যাদি ব্যবহার করে দ্রুত নির্ণয় করা হয়েছে। (প্রতিবেদনগুলো জানায়, আধ্যাত্মিক/সামাজিক চিহ্নও লক্ষ্য করা হয়েছে)।

৪ কাউল‑সম্পর্ক ও গোষ্ঠীয় পরিচয় যাচাই: হামলাকারীরা স্থানীয় সুত্র, স্থানীয় নেতাদের, বা জঙ্গি/থানার তালিকা ব্যবহার করে নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠীর সদস্যদের তালিকাভুক্ত করেছে। কখনো কখনো আগে থেকেই তৈরি তালিকা/হোয়াইট‑বুক ব্যবহার করা হয়েছে।

৫. হাসপাতাল রুম/ওয়ার্ড আলাদা করে তোলা এবং নার্স/হেলথওয়ার্কারদের জোরপূর্বক সহায়তা/ধরা— কিছু ঘটনায় হাসপাতালের ভিতরে আলাদা ওয়ার্ডে থাকা রোগীদেরকে আলাদা করে ধরে নিয়েছে; কখনো হেলথওয়ার্কারদের ওপর চাপ বা অপহরণ চালিয়ে রোগীদের অবস্থান জানতে চাওয়া হয়েছে। WHO এবং অনান্য সংস্থা এই ধরনের আক্রমণের কথা নোট করেছে।

৬. চলমান সংঘর্ষ/জোন অনুযায়ী ভৌগোলিক প্রোফাইলিং: নির্দিষ্ট নগরীয় এলাকাগুলো যেখানে নন‑আরব জনগোষ্ঠী বসবাস করে বা IDP শেল্টার ছিলো, সেগুলো থেকে এনকাউন্টারের সময়ই মানুষকে বেছে নিয়ে মারা হয়েছে। হাসপাতাল হিসেবে যারা ওই এলাকায় এসেছিলেন, তারা ঝুঁকিতে পড়েছেন।

7. খোঁজ‑খবর/তথ্য‑সংগ্রহ (phone lists, social media, তত্ত্বাবধান): আধুনিক মোবাইল/অপারেটিভ তথ্যও কাজে লাগতে পারে। প্রত্যক্ষদর্শী সংবাদে দেখা গেছে অপহরণ বা লক্ষ্যের তালিকা তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে এগুলো ভূমিকা রেখেছে।

গণহত্যা
নারকীয় গণহত্যায় সুদানে সৃষ্টি হয়েছে ভয়াবহ মানবিক সংকট।

হত্যাকাণ্ডের শিকার কারা?

সুদানে বিশেষ করে দারফুর অঞ্চলে যাদের ওপর গণহত্যা চালানো হয়েছে, তাদের সাধারণত “নন-আরব” বা আফ্রিকান-শিবির জনগোষ্ঠী বলা হয়। তাদের মতাদর্শ বা জীবনধারা মূলত সাধারণ কৃষক, পশুপালক বা স্থানীয় সম্প্রদায় কেন্দ্রিক। তারা রাজনৈতিক বা ধর্মীয়ভাবে কোনো আগ্রাসী বা সাম্রাজ্যবাদী মতাদর্শের সঙ্গে যুক্ত নয়


দারফুরে গণহত্যার শিকার নন-আরব জনগোষ্ঠী । এরাও মুসলিম জনগোষ্ঠী তবে নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যে তফাৎ রয়েছে।

  •  ফুর (Fur)

  •  জালাং (Zaghawa)

  •  মাসালিত (Masalit)


দারফুরে গণহত্যার শিকার নন-আরব জনগোষ্ঠী তিনটি প্রধান গোষ্ঠী সম্পর্কে:


ফুর (Fur)

  • দারফুর অঞ্চলের সবচেয়ে বড় নন-আরব সম্প্রদায়।

  • প্রধানত কৃষক ও পশুপালক।

  • তাদের জমি উগ্র মিলিশিয়া এবং সরকারি সেনাবাহিনী ধ্বংস করেছে, বহু মানুষ হত্যা বা বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

জালাং (Zaghawa)

  • নন-আরব আফ্রিকান জনগোষ্ঠী, যা মূলত দক্ষিণ ও উত্তর দারফুরে বাস করে।

  • তারা বাণিজ্য ও কৃষিতে দক্ষ।

  • জালাং সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতা কমানোর জন্য।

মাসালিত (Masalit)

  • দক্ষিণ-পশ্চিম দারফুরের একটি নন-আরব সম্প্রদায়।

  • কৃষি ও পশুপালন তাদের প্রধান জীবিকা।

  • তারা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে; গ্রামের গ্রাম ধ্বংস ও নারী ও শিশুর ওপর নির্যাতন হয়েছে।


এই তিনটি নন-আরব জনগোষ্ঠীর মানুষকে “জেনডারমি/জাঞ্জাউইড” মিলিশিয়া লক্ষ্য করে হত্যা, ধ্বংস, এবং বাস্তুচ্যুত করেছে। গণহত্যার ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়েছেন এবং লাখ লাখ শরণার্থী হয়ে পশ্চিম আফ্রিকায় আশ্রয় নিয়েছেন।

Commander of RSF
মুহাম্মদ হামদান দাগালো মুসা (জন্ম ১৯৭৪ বা ১৯৭৫), যাকে সাধারণত হেমেদতি নামে পরিচিত, একজন সুদানী সামরিক কর্মকর্তা এবং যুদ্ধবাজ, যিনি আধাসামরিক র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (RSF) এর বর্তমান প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

⚔ কারা হামলা চালিয়েছে

মূলত দুই প্রধান গোষ্ঠী এই গণহত্যা ও সহিংসতার সঙ্গে যুক্ত:

Janajaweed মিলিশিয়া: আরব যোদ্ধাদের দল, যারা ২০০০-এর দশকে সরকার-সমর্থিত বাহিনী হিসেবে কাজ করেছিল।

Rapid Support Forces (RSF): পরবর্তীতে একই গোষ্ঠীর আধুনিক রূপ, এখন তারা সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত, কিন্তু পশ্চিম দারফুরে এখনো নন-আরবদের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে।

এই দুই বাহিনীর নেতৃত্বে আছেন মোহাম্মদ হামদান দাগালো (হেমেতি)— RSF প্রধান, যিনি নিজেও জানজাউইদের সাবেক কমান্ডার।

(ক) আরব শ্রেষ্ঠত্ববাদ (Arab Supremacism)

জানজাউইদ ও RSF সদস্যরা মূলত আরব বেদুইন গোত্রভুক্ত (Arabized tribes)— যেমন রিজেইগাত, মাহারিয়া ইত্যাদি।

তাদের বিশ্বাস, দারফুরের নন-আরব আফ্রিকান গোষ্ঠী (যেমন, Masalit, Fur, Zaghawa) “নিম্ন জাতি” এবং শাসনের অধিকার তাদের নয়।

এই মতাদর্শটি ১৯৮০-৯০ দশকে খার্তুমের শাসকগোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে আরব জাতীয়তাবাদী প্রচারণা দিয়ে লালন করেছিলো।

সরকার তাদের বলেছিলো: “তোমরা দারফুরে ইসলাম ও আরব জাতির রক্ষক।”

ফলাফল: তারা নন-আরব গ্রামগুলোতে হামলা চালিয়ে “অঞ্চল পরিষ্কার” করতে চেয়েছিল — যাকে বলা হয় ethnic cleansing।

(খ) ধর্মীয় মুখোশ: ইসলামিক জিহাদবাদী রেটরিক

তারা নিজের কর্মকাণ্ডকে মাঝে মাঝে “ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদ” বলে প্রচার করেছে, যদিও ভুক্তভোগীরাও মুসলমান।

এর মাধ্যমে তারা হত্যাকাণ্ডকে ধর্মীয় নৈতিকতার ছায়ায় বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেছে।

প্রকৃতপক্ষে এটি ধর্মীয় নয়, বরং জাতিগত ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি।

(গ) রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থ

দারফুরে সোনা, গবাদিপশু ও কৃষিজমি বিপুল সম্পদের উৎস।

RSF এই সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়, এবং এজন্য স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করছে।

“গণহত্যা” এখানে শুধু জাতিগত নয়, বরং রিসোর্স-ওয়ার (resource war)-এ রূপ নিয়েছে।

সুদানে গণহত্যাকারীরা আরবীয় বংশোদ্ভূত, আরব থেকে গিয়েছে, নাকি আরবের মতাদর্শে বিশ্বাসী?

সুদানের দারফুরে গণহত্যার প্রধান হত্যাকারীরা শুধু আরব বংশোদ্ভূত বলে নয়, বরং মূলত “আরব জাতীয়তাবাদী ও ইসলামিক শ্রেষ্ঠত্বের মতাদর্শে বিশ্বাসী”।

বিস্তারিতভাবে বললে জাতিগত পরিচয়ে দারফুরের হত্যাকারী মিলিশিয়া (যেমন: জাঞ্জাউইদ) অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় আরব “বদুয়া” বা পাস্তোরালিস্ট সম্প্রদায়ের মানুষ। এরা বহু প্রজন্ম ধরে সুদানে বসবাস করছে। অর্থাৎ সরাসরি আরব দেশ থেকে সম্প্রতি আসা নয়।

তাদের মতাদর্শিক মূল চালিকা শক্তি হলো আরব-জাতি ও ইসলামিক শ্রেষ্ঠত্ব। তারা দারফুরের নন-আরব কৃষক জনগোষ্ঠীকে নিম্নমানের মনে করে। এই মতাদর্শের কারণে তারা নন-আরব জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস ও উচ্ছেদ করতে শুরু করে।

“কীভাবে পশ্চিমারা গণহত্যার পরও সুদান নীতিতে দ্বিধায় ভোগে?” অর্থাৎ, তারা কেনো একদিকে মানবাধিকার বলে, আবার অন্যদিকে কার্যকর ব্যবস্থা নেয় নাঃ

Africa
২০১১ সালের ৯ জুলাই দক্ষিণ সুদান একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে সুদানের কাছ থেকে আলাদা হয়ে যায়। এই বিভাজন দীর্ঘদিনের সংঘাতের ফল, যা দক্ষিণ সুদানের স্বাধীনতার মাধ্যমে শেষ হয়। গণভোট: ২০১১ সালের ৯ জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত এক গণভোটের পর দক্ষিণ সুদান সুদানের কাছ থেকে পৃথক হয়। স্বাধীনতা: এই গণভোটের ফলাফলের উপর ভিত্তি করে, দক্ষিণ সুদান জাতিসংঘের ১৯৩ তম সদস্য হিসেবে স্বাধীনতা লাভ করে। পৃথক রাষ্ট্র: এখন আর কোনো “একত্রিত সুদান” নেই, বরং দুটি পৃথক দেশ বিদ্যমান – সুদান এবং দক্ষিণ সুদান। দক্ষিণ সুদানে খ্রিস্টান জনগোষ্ঠীর সংখ্যাধিক্য রয়েছে, যা এই পৃথকীকরণের অন্যতম প্রধান কারণ ছিলো। সুদান থেকে বিভক্তির আগে, দক্ষিণ সুদানের বেশিরভাগ অধিবাসীই ছিল খ্রিস্টান এবং ঐতিহ্যবাহী ধর্মাবলম্বী, যেখানে উত্তরের বেশিরভাগ মানুষ ছিলো মুসলিম। তবে দক্ষিণ সুদানেও সংঘাত এবং সহিংসতা বিদ্যমান রয়েছে। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: ১৯৯৩ সালে সুদানের সরকার যখন উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যে শরিয়া আইন চালু করার চেষ্টা করে, তখন খ্রিস্টান ও ঐতিহ্যবাহী ধর্মাবলম্বী দক্ষিণাঞ্চলীয়রা এর বিরোধিতা করে। এই ধর্মীয় ও জাতিগত পার্থক্যই দক্ষিণ সুদানের স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘ যুদ্ধের একটি মূল কারণ ছিল।

কীভাবে পশ্চিমারা গণহত্যার পরও সুদান নীতিতে দ্বিধায় ভোগে

১. স্বার্থ বনাম নীতি

পশ্চিমা দেশগুলো (বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন) প্রকাশ্যে “মানবাধিকার” ও “গণতন্ত্র”-এর পক্ষে কথা বলে, কিন্তু বাস্তবে তাদের সিদ্ধান্ত নির্ভর করে তেল, খনিজ, বাণিজ্যিক পথ, এবং নিরাপত্তা স্বার্থের ওপর। সুদানে যেমন দারফুর, করতুম, এবং দক্ষিণাঞ্চলে চীন ও রাশিয়ার বিনিয়োগ রয়েছে। পশ্চিমারা সরাসরি পদক্ষেপ নিলে তারা সেই অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব হারানোর আশঙ্কা করে।

২. ভূরাজনৈতিক ভারসাম্য

সুদান আফ্রিকার “সংযোগ কেন্দ্র”। উত্তরে মিশর ও আরব বিশ্ব, দক্ষিণে সাব-সাহারান আফ্রিকা, পূর্বে লোহিত সাগর (Red Sea)। এই অবস্থানটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষত চীনের Belt and Road ও রাশিয়ার Red Sea naval base পরিকল্পনার জন্য। পশ্চিমারা তাই দ্বিধায় পড়ে যায়: শক্ত অবস্থান নিলে আফ্রিকা ও আরব উভয় দিকেই প্রভাব হারাতে পারে।

৩. ‘War on Terror’ এর ছায়া

২০০০-এর দশকে পশ্চিমারা সুদানের ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলিকে নজরদারিতে রাখতে শুরু করে। তবে একই সময়ে তারা আল-বুরহান বা হামিদতি’র মতো সামরিক নেতাদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখে। কারণ, তারা “সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগী” হিসেবে বিবেচিত।ফলে, গণহত্যাকারীদের বিরুদ্ধে সরাসরি ব্যবস্থা নেওয়া “রাজনৈতিকভাবে অসুবিধাজনক” হয়ে পড়ে।

৪. মানবিক সংকটের ‘ডিপ্লোম্যাটিক ক্লান্তি’

দারফুর, সিরিয়া, ইয়েমেন, ইউক্রেন— একটির পর একটি মানবিক বিপর্যয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর জনমত এবং রাজনৈতিক ইচ্ছা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ফলে সুদান নিয়ে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার মতো “নৈতিক শক্তি” আর দেখা যায় না।

৫. জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক আইনগত সীমাবদ্ধতা

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে চীন ও রাশিয়া প্রভাবশালী সদস্য। তারা প্রায়ই সুদানের বিরুদ্ধে প্রস্তাব ভেটো করে, ফলে পশ্চিমারা একতরফাভাবে বড় ধরনের সামরিক বা অর্থনৈতিক হস্তক্ষেপ করতে পারে না।

সুদানের বৃহত্তম একক দাতা দেশ হলো যুক্তরাষ্ট্র।

২০০৫ সাল থেকে সুদান এবং পূর্ব চাদে ৫ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি সহায়তা প্রদান করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

সুদান এবং পূর্ব চাদে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির খাদ্য সহায়তার ৮০% এরও বেশি অর্থায়ন করে যুক্তরাষ্ট্র,

যা সমগ্র অঞ্চলের প্রায় ৬.৫ মিলিয়ন মানুষের কাছে পৌঁছে।

ফলাফল

পশ্চিমারা তাই “দ্বৈত অবস্থান” নেয়— মুখে মানবাধিকার, নিষেধাজ্ঞা, নিন্দা; কিন্তু বাস্তবে অর্থনৈতিক, কৌশলগত ও নিরাপত্তা স্বার্থে নীরব সহনশীলতা।