যুগের হাল: বলদ হলে আত্মবিশ্বাসের সাথে আমাকে বলদামি ব্রান্ডে পরিণত করতে হবে

ডয়েচেভেলের একটি খবরে একদিন দেখলাম, কোকাকোলা পান করা খুব খারাপ —এ ধরনের একটি খবর। খারাপ তো বটেই, কিন্তু ফানটা তাহলে কি? ফানটা তো জার্মানির আবিষ্কার, বাজারজাত করে কোকাকোলা কোম্পানি, ওখান থেকে জার্মান রয়েলিটিও পায়। ডয়েচেভেলে (জার্মান মিডিয়া) ফানটা নিয়ে কিছু বলবে না?

হরলিকস নিয়ে অনেকদিন আগে লিখেছিলাম যে, এক কৌটা দুধমিশ্রিত ভুট্টার গুড়া কীভাবে বিশ্বের বাজার দখল করে নিল! আমরা হরলিক্স নিয়ে কাউকে দেখতে যাওয়াটাকে স্টাটাস বানিয়ে ফেললাম!!

সেরিলাকের কথাই ভাবুন, নেসলে এটি বাজারজাত করে, সুইস কোম্পানির নেসলে, দুধ আছে বলেই দুগ্ধজাত পণ্য ওদের ব্রান্ড। কত রকমের সেরিলাক! ভাল তোমার লাগতেই হবে। চালের, ফলের, ভুট্টার, একটা না একটা তো কিনবাই। তিনশো গ্রামের ভুট্টার বা গমের গুড়ার একটি প্যাকেটের দাম চারশো টাকা! ভাবা যায়? কিন্তু আমরা কিনছি তো, কেন কিনছি? আমরা কি নিজ দেশে এরকম একটি মিশ্রণ বানিয়ে নিতে পারি না? পারি, তবে কিনতে বাধ্য হচ্ছি ব্রান্ডিং-এর কারণে। এগুলো শুধু প্রয়োজন না, এগুলোকে আমরা স্টাটাস বানিয়ে ফেলেছি।

কফি সুইজারল্যান্ডে হয় না, কিন্তু কফি আমদানি করে দুধ মিশিয়ে চড়া দামে ওরা বিক্রী করে ঠিকই। এবং মজার বিষয় হচ্ছে— কফির উৎপাদনকারী দেশ ব্রাজিলের চেয়ে কফির প্রসেসকারী দেশ সুইজারল্যান্ড বেশি উপার্জন করে।

Kit Cat (বর্তমান নাম Kit Kat ) ছিল ইংল্যান্ডের স্থানীয় একটি কনফেকশনারির দোকানের আবিষ্কৃত একটি চকলেট। ঠিক চকলেটও না, দুধমিশ্রিত ময়দা ওয়েফারে রূপ দিয়ে তার উপর চকলেট কোট করা। স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় হওয়ার সাথে সাথে ওদের মাথায় আসল এটিকে আন্তর্জাতিক ব্রান্ডে পরিণত করার কথা। করেও ফেলল!

Mars, Cadbury ইত্যাদি চকলেটগুলো সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়। ভাবা যায়, একটি কলা পাঁচ টাকা দিয়ে কিনে খেতে আমাদের কষ্ট হয়, সেই আমরা এসব দুই পয়শার জিনিস কিনে খাই বা কিনে দিই বিশ-পঁচিশ-পঞ্চাশ টাকা দিয়ে!

কারণ? কারণ হচ্ছে— বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে এগুলো প্রেস্টিজিয়াস ব্রান্ডে পরিণত হয়েছে, এবং এগুলো কাউকে কিনে দেওয়া মানে নিজের প্রেস্টিজ বাড়ানো। এটাও সত্য যে, স্থানীয় চকলেটের চেয়ে এগুলো সুস্বাদু। বিশাল কোম্পানি, দামও বিস্তর, স্বাদ তো একটু ভালো হবেই।

মূল কথা হচ্ছে— একটা চকলেট, এক কৌটা দুধ মিশ্রিত ভুট্টা বা হরলিক্স, নানান পদের শস্যদানার গুড়া (সেরিলাক), কার্বনেটেড ড্রিংকস যে বিশ্বব্যাপি ব্রান্ড হতে পারে তা আমাদের মাথায় কেন আসে না? নাকি মাথায় আসলেও আমরা পেরে উঠি না? নাকি আমরা পারতে চাই না? যাদের মাথায় আসে তাদের মেধাবী বলার পাশাপাশি সম্রাজ্যবিস্তারকারীও কেন বলা হবে না, শুধু ব্যবসায়ী কেন বলা হবে না? এই মেধা কি আসলে মেধা, নাকি চালাকি?

শুধু ব্যবসার উদ্দেশ্য ছাড়া কোনো মহৎ উদ্দেশ্যে নিশ্চয়ই কার্বনেটেড ড্রিংকস্ বিশ্বব্যাপী বাজারজাত করা হয়নি। হওয়ার কথা কি?হরলিকস

ওদের অর্থনীতি-বিজ্ঞান-ব্যবসা-গণমাধ্যমের মধ্যে চমৎকার একটা সমন্বয় আছে। হাল আমলে ডিসকভারি এবং জিওগ্রাফিতে এসব কোম্পানির মাজেজা তুলে ধরা হয়। নিশ্চয়ই তা আধুনিক এবং পরিচ্ছন্ন— কিন্তু পণ্যগুলো কী, কতটুকু তা প্রয়োজনীয় তাও তো ভেবে দেখতে হবে। যেখানে বিশ্বব্যাপি শতকোটি মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ হয় না, সেক্ষেত্রে এসব আদিখ্যেতা দেখে হা করে থাকার কিছু নেই। আমরা এসবে ঠকছিও তো ভীষণ!

বর্তমান সময়ের একটি চকলেট হচ্ছে ‘কিনডার জয় (Kinder Joy)’। যশোরে গিয়েছিলাম মাসতুত বোনের বাসায় বেড়াতে। দিদির ছেলে বলল, কিনডার জয় কিনবে। জিজ্ঞেস করলাম, কিনডার জয় কী? বলল, চকলেট। চকলেটের কত আর দাম হবে, নিয়ে গেলাম কিনে দিতে।

একটা ‘কিনডার জয়’ নিয়ে একশো টাকার নোট দিলে দোকানদার আমাকে ত্রিশ টাকা ফেরৎ দিল! আমি দাঁড়িয়ে আছি দেখে দোকানদার বিব্রত। বললাম, ভাই আপনি ভুল করেছেন, আমি একশো টাকার নোট দিয়েছি। দোকানদার বলে, ঠিকই তো আছে, আমি আপনাকে ত্রিশ টাকা ফেরৎ দিয়েছি!

বাসায় এসে আমি নেট খুলে কিন্ডার জয় সম্পর্কে পড়লাম। কী ভয়ানক বিষয়! পূঁজিবাদের এই ভয়ানক দিকটা রাষ্ট্র পরিচালনাকারীদের বোঝা খুব জরুরী। কোনোভাবেই তো পারা যাবে না, কোনো মেধা বা চেষ্টা দিয়ে ধনী দেশগুলোর সাথে, দেশীয় বাস্তবতায় ধনীদের সাথে আর পারা যাবে না। বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পন্য তো কোনো বিষয় না। বিষয় হচ্ছে ব্রান্ডে পরিণত করা। শত শত কোটি টাকা বিনিয়েগো করে কিছু একটা ব্রান্ডে পরিণত করতে হবে, বাজারজাত করতে হবে, হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাক করবে।

একদম প্রত্যন্ত দোকানগুলোতেও এই কিন্ডারজয় ছড়িয়ে গেছে। সত্তর টাকা দিয়ে রোজ কেনার দরকার নেই। বাংলাদেশে যদি দশ কোটি কিন্ডার জয় ওরা বিক্রী করতে পারে তাতেই তো কয়েক শো কোটি টাকা উপার্জন করে নিয়ে যাবে। আমার ঐ দিদির ছেলের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, একটা না, অনেক ছেলেমেয়ে এসব কিনতেই থাকে রোজ। তাহলে?

Kinder Joy খুব বেশি দিনের প্রডাক্ট নয়। ইতালিয়ান কনফেকশনারি কোম্পানি Ferrero এটি তৈরি করে। ২০০১ সালে ইতালিতে তারা এই পণ্যটি বাজারে আনে। ডিমের মত আকৃতির এটি খুলে দুইভাগে ভাগ হয়, একপাশে থাকে ক্রিম চকলেট, আরেক পাশে একটি ছোট্ট খেলনা।

বিস্ময়কর হচ্ছে, ২০১৬ সাল পর্যন্ত এটি ছড়িয়েছে ১২০টি দেশে! আমাদের দেশে জনপ্রিয় হয়েছে গত এক বছরে। এবং জনপ্রিয় করে তোলার কাজটি করছে ইন্ডিয়া। ইন্ডিয়া এ কাজটি করছে ২০১৫ সাল থেকে, তারা কো-ম্যানুফ্যাকচারার হওয়ার পর থেকে।

পশ্চিমাদের বিজনেস পলিসিটা ইন্ডিয়া ধরতে পেরেছে, আমরা পারিনি। ইন্ডিয়াতে কিনডার জয় ঢোকে ২০০৯ সালে। তারা কিন্তু প্রডাকশনে যেতে খুব বেশি সময় নেয়নি। অর্থাৎ তোমার পণ্য আমার দেশে বিক্রী করতে হলে আমার কাঁচামাল ব্যবহার করো, আমার ম্যানপাওয়ার খাটাও, তারপর ব্যবসা করো। খুব বেশি ব্যবসা ইন্ডিয়া থেকে ইতালিয়ান ফেরেরো করে যেতে পারবে না, পারবে বাংলাদেশের বাজার ধরে। অর্থাৎ ইন্ডিয়া বাংলাদেশের ঘাড়ে বন্দুক রেখে এক্ষেত্রে সুবিধা নিচ্ছে।

mastered

পশ্চিমাদের গবেষণা সবসময় বিশ্বাস করার একটা সরল প্রবণতা আমাদের আছে। কিন্তু ধারণা করা যায়, ওদের গবেষণার সাথে ওদের পণ্যকে ব্রান্ডে পরিণত করার সম্পর্ক আছে। গবেষণাগুলো করায়ও তো কোম্পানি। এতদিন আপনি শুনে এসেছেন যে সোয়াবিন তেলে কোলেস্টেরল কম, আবার হঠাৎ শুনলেন, না, সরিষার তেলেই কোলেস্টেরল কম। সোয়াবিন তেল বাজারজাতকরণের প্রয়োজনে ওরা গবেষণা ছেড়ে দিল। আমেরিকার এই গবেষণায় মার খেয়েছিল কানাডা, কারণ, বিপুল সরিষা উৎপাদন হতো কানাডায়। আমাদের সরিষার ফলনের ওপরও কিন্তু তার প্রভাব ঠিকই পড়েছিল।

অর্থনীতির বিদ্যমান বাস্তবতায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দরিদ্র দেশের এবং জাতীয় বাজারে দরিদ্র মানুষের করণীয় কী? একটা করণীয় হচ্ছে— আন্দোলনের মাধ্যমে অর্থনীতির এই ধারাটা বদলে দেয়া, যেটি বাম রাজনীতির আদলে কিছুটা হচ্ছেও, তবে তা কার্যকর নয়।

আরেকটা করণীয় হচ্ছে, চোখের বদলে চোখ (মারামারির কথা বলছি না), অর্থাৎ যা আমার মাথায় আছে তা হাতে আনা এবং ব্রান্ডে পরিণত করা, ছাইছাতা যা হোক ওদের মতো সেটিকে ব্রান্ডে পরিণত করতে হবে, এরপর ধীরে ধীরে পণ্যটিও একদিন সুন্দর (প্রেস্টিজিয়াস) হবে।

কিন্ত তাই কি সম্ভব? হাজার হাজার কোটি টাকা এবং প্রভাবশালী মিডিয়াকে টেক্কা দিয়ে কীভাবে আপনি আপনার বুদ্ধি-মেধা-পণ্য ব্রান্ডে পরিণত করবেন? দস্যুতার এই বাজারে প্রয়োজনীয় জিনিসটাই বা কীভাবে আপনি ব্রান্ডে পরিণত করবেন?

তারপরেও চেষ্টা করে যেতে হবে। বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় আমি কী বা আমার কী আছে সেটি কোনো বিষয় না। আমি বলদ হলে আত্মবিশ্বাসের সাথে বলদামির ব্রান্ডিং করতে হবে। এছাড়া এই ব্যবস্থায় টিকে থাকা কঠিন।


লেখক: দিব্যেন্দু দ্বীপ