‘মানুষের বিবর্তন’ একটি স্বতন্ত্র ধাচের বই। এবারের বই মেলায় আনতে চেয়েছিলাম, কিন্তু এবার হবে না। বইটির অনেক জায়গায় সম্পাদনা লাগবে বলে মনে করছি। মোট একশো বিশটি প্যারা রয়েছে বইটিতে। পাঁচটি প্যারা এখানে দিলাম। প্রতি পাঁচটি প্যারা নিয়ে একটি এপিসোড।
১
এদের তুমি বিশ্বাস করো?
করেছিলাম।
এদেরে তুমি ভালোবাস?
ভালোবাসি।
“বিশ্বাস করেছিলে, এবং ভালোবাস”
বুঝলাম না।
ঠিক, এখনো ভালোবাসি,
তবে বিশ্বাস করি না।
ভালোবাসা হৃদয় হতে আসে,
ওটা তুমি ইচ্ছে করলেও
বাদ দিতে পারবে না।
বিশ্বাস যুক্তিতর্কের বিষয়,
বাদ দেওয়া যায়।
২
তুমি কি দ্বিধাগ্রস্থ?
না।
শঙ্কিত?
না।
তাহলে?
চিন্তিত।
বলতে পারো কেন তুমি
এতটা চিন্তিত?
আচ্ছা, তোমাকে একটা প্রশ্ন করি—
সাধারণ মানুষ বলতে কী বুঝায়?
তাদের
যাদের ক্ষমতা নেই, টাকা নেই।
বলতে চাইছ—
এখানে ভালো বা মন্দের কোনো বিষয় নেই?
আমি তাই মনে করি।
সমাজে মূলত বৈষয়িকভাবে
সফল মানুষদের অসাধারণ বলা হয়,
যদিও তা হওয়ার কথা নয়।
খ্যাতিও কি বৈষয়িক?
অবশ্যই।
একজন লেখকও কি সাধারণ মানুষ
যদি তার প্রচার না থাকে?
না।
তোমার যুক্তিতে তো
লেখক সাধারণ মানুষ।
‘না’ বলছ কেন?
লেখক ক্ষমতাহীন নয়।
লেখকদের ক্ষমতাটা দেখা যায় না।
পরোক্ষ প্রভাবকে কি ক্ষমতা বলা যায়?
নিশ্চয়ই।
কোনো লেখক ভবিষ্যতের হলে
বর্তমানে তাকে মূল্য দেবার
দায় কি মানুষ নেবে?
অতটা উচ্চতায় মানুষ পৌঁছায়নি।
দায় তারা নেবে না, নেয় না।
লেখক যদি লেখা বন্ধ করে দেয়
তাহলে কেউ কি এসে
তাকে লিখতে অনুরোধ করবে?
নাও করতে পারে, সম্ভবত করবে না।
তার মানে সমাজ তাকে
প্রয়োজনীয় ভাবছে না?
হয়ত তাই।
শুধু লেখক নয়,
বেশিরভাগ লোকের ক্ষেত্রে এটি সত্য।
প্রত্যক্ষ ক্ষমতার কারণে
পোষ্যরা তাকে কয়েকবার
অনুরোধ করতে পারে মাত্র,
তবে তাতে সে ঠিক
প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে না।
প্রকৃতির কাছে মানুষ প্রয়োজনীয় নয়,
তাই ব্যক্তি মানুষের কাছে
সমষ্টির কোনো প্রয়োজন থাকতে পারে না।
থাকলেও সেটি স্থায়ী হয় না কখনো।
কিন্তু একজন লেখক মানে
শুধু একজন ব্যক্তি নন,
প্রত্যেক লেখক এক একটি প্রতিষ্ঠান।
একজন লেখককে
একটি কার্যকর প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে
পারতে হয়।
সে চেষ্টা করে যাওয়টাই লেখক-জীবন।
৩
তুমি বলতে চাইছ
অসাধারণ হলেও ব্যক্তি মানুষের
আসলে কোনো মূল্য নেই।
না, নেই।
মানুষ প্রকৃতি হতে বিচ্ছিন্ন একটি
সামষ্টিক স্বত্ত্বা, তারা একত্রিত হয়ে
প্রকৃতির সাথে যুজতে চাইছে।
বলতে চাইছি, চাওয়া উচিৎ ছিল,
কিন্তু তারা নির্বুদ্ধিতায়
নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে,
এ সংঘাত প্রধানত মনস্তাত্বিক।
নির্বুদ্ধিতা হলেও মনস্তাত্ত্বিক এই সংঘাতের
মধ্য দিয়েই মানুষের বিবর্তন হচ্ছে,
সে বিবর্তন প্রধানত শারীরিক আর নয়,
মানসিক, কারণ, মানুষের প্রতিযোগিতাটা
এখন মূলত বুদ্ধিবৃত্তিক।
৪
তুমি বললে—
ব্যক্তি মানুষ মূল্যহীন।
তার মানে
সাধারণ হলেও সংখ্যাগরিষ্ট শক্তিশালী?
এটা ঠিক সংখ্যাগরিষ্ট নয়,
এককভাবে মানব প্রজাতি,
যারা প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থান হতে
নিজেদের ছিঁটকে ফেলেছে।
ব্যক্তি মানুষের অসাধারণ গুণগুলো
সমষ্টি প্রাকৃতিক মনে করে,
অবচেতনেও হলেও সাধারণ মানুষ
সঠিক পথটা ধরে ফেলে দ্রুত।
‘ঈশ্বর’ কি এমনিতেই এসেছে?
শুধু স্বর্গ নরকের জন্য ঈশ্বর নয়,
ঈশ্বরের আরো অনেক ভূমিকা আছে।
ঈশ্বর ব্যক্তির অক্ষমতার দায় নেয়,
সে ঈশ্বরের দোহাই দিতে পারে।
সমষ্টি ব্যক্তি মানুষের অসাধরনত্ব
ঈশ্বর প্রদত্ত বলে
এক ঝটকায় তার ব্যক্তিস্বত্ত্বা
অস্বীকার করতে পারে।
ফলে ঈশ্বর প্রতিক্রিয়াশীলদের শিকার হয়েছে
সে সাধারণদের আশ্রয় বলেই।
৫
বিবর্তন কি থেমে গিয়েছে?
বিবর্তন থেমে যেতে পারে না।
প্রকৃতিতে কোনো কিছুই স্থির নয়।
তাহলে মানুষের আরো বিবর্তন হচ্ছে না?
হচ্ছে, তবে ধরণটা পরিবর্তন হয়ে গেছে।
প্রাকৃতির নির্বাচনের ক্ষেত্রে
কোনো প্রাণী বা উদ্ভিদের প্রকৃতির ওপর
হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা থাকে না।
কিন্তু দুটি হাত এবং উন্নত মস্তিষ্কের কারণে
মানুষ প্রকৃতিতে হস্তক্ষেপ করছে,
লড়াইটা তারা করছে প্রধানত নিজেদের মধ্যে
ফলে মানুষের মস্তিষ্কের বিবর্তন হচ্ছে,
শারীরিক বিবর্তন থেমে গিয়েছে।
বলতে চাচ্ছ,
মানুষ থেকে অন্যকিছু হয়ে যাওয়ার
সম্ভাবনা আর নেই?
গঠনগতভাবে নেই,
তবে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে মানুষ আরো অনেক
উচ্চতায় পৌঁছাবে নিশ্চয়ই।
মানুষ কি অমর হতে পারে?
নিশ্চয়ই হবে,
যদি তার আগে পৃথিবী ধ্বংস না হয়ে যায়।