“গণধর্ষণ করে ক্ষান্ত হয়নি মিয়ানমারের সৈন্যরা। আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে অবুঝ দুই সন্তানকে। আর বেঁচে থাকা একমাত্র সন্তানটিকে নিয়ে পালিয়ে আসার সময় মায়ের কোলেই মারা গেল শিশুটি।”
মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে বিশেষ করে মংডুতে যা ঘটছে তা নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত, আদিম সভ্যতায়ও হয়ত বেমানান এরকম ঘটনাগুলো। কিন্তু আমরা কি সত্যি এসবে বিস্মিত হওয়ার কথা এতটা? আমরা কি ভুলে গেছি–১৯৭১ সালে বর্বর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী মুক্তিকামী বাঙালিদের ওপর এরচেয়ে কয়েক গুণ ভয়াবহ নির্যাতন চালিয়েছিল? রোহিঙ্গাদের ওপর নীপিড়নের হেতু আমরা মিয়ানমারকে ঘৃণা করতে শিখেছি, কিন্তু ৩০ লক্ষ বাঙালি নিধন, লক্ষ লক্ষ নারীকে নির্যাতন এবং এক কোটির বেশি মানুষকে বিতাড়িত করার ইতিহাস আমরা কখনো জানতেই আগ্রহী হয়নি, ভয়ানকভাবে এড়িয়ে গেছি, বিস্মৃত হয়েছি! তাই নয় কি?
হাজার হাজার অজানা গণহত্যার ঘটনা রয়েছে বাঙলার মাটিতে। এখনো সহস্র মায়ের ক্রন্দনে সন্ধ্যার বাতাস ভারী হয়, কিন্তু এসব কিছুতেই আমরা কৌতুহলী হয়ে উঠতে পারিনি ’৭১-এর গণহত্যা বিষয়ে, হয়েছি কি? তবু রোহিঙ্গাদের দুর্দশা দেখে যদি আগ্রহ হয় আমাদের গণহত্যা বিষয়ে একটু জানার চেষ্টা করতে পারেন, পৃথিবীর ইতিহাসে বৃহত্তম গণহত্যা এবং জাতিগত নিধনের ঘটনাটি ঘটেছে আপনার নিজ দেশে, কিন্তু আপনি সেটি জানেন না, জানার প্রয়োজন মনে করেন না!
জাতীয় পর্যায়ে এবং সরকারি দলিল দস্তাবেজেও ’৭১-এর জাতিগত নিধন এবং শরণার্থী হওয়ার বিষয়টি আমাদের ইতিহাসে সব সময় অবহেলিত থেকেছে। আমরা সবসময় আলোচনা করি ’৭১-এ আমাদের বিজয়গাঁথা নিয়ে। ধরুণ, আপনি খেলায় জিতলেন কিন্তু দলের দুজন খেলোয়ার বিপক্ষ দলের হামলায় মারা গেল তাহলে পারবেন শুধু বিজয় উল্লাস করতে? প্রতিপক্ষের বিচার না হওয়া পর্যন্ত সে বিজয়োল্লাস কি যুক্তিসঙ্গত এবং মানবিক হয়? খোঁজ নেবেন না আপনি ঐ দুজন খেলোয়াড়ের পরিবারের? খুবই স্থুল উদাহরণ দিলাম শুধু বিষয়টি সহজে বোঝানোর জন্য।
শরণার্থী হয়ে রোহিঙ্গারা এদেশে আসাতে আমরা বুঝতে পারছি, বোঝার একটা সুযোগ পাচ্ছি যে যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং তথ্যপ্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকা এক সময়ে আরো সাত চল্লিশ বছর আগে পূর্বপাকিস্তান থেকে এক কোটির বেশি লোককে কোলকাতায় শরণার্থী হতে হয়েছিল, তাহলে সে কষ্ট এবং দুর্দশার চিত্রটি ঠিক কেমন ছিল!
এখনো হাজার হাজার অজানা গণহত্যার ঘটনা রয়েছে বাঙলার মাটিতে। এখানা হাজারো মায়ের অস্ফুট ক্রন্দনে সন্ধ্যের বাতাস ভারী হয়, কিন্তু এসব কোনোকিছুই আমাদেরকে কৌতুহলী করতে পারেনি। সবকিছু ওপরে আমরা সাম্প্রদায়িকতাকে স্থান দিয়েছি। অামরা মিয়ানমারের বিচার চাই কিন্তু পাকিস্তানের বিচার চাইতে পারি না। এরকম অসংলগ্ন দাবী বিশ্ববাসীর কাছে যৌক্তিক ঠেকে কি?
উদাহরণ হিসেবে ১৯৭১ সালে সংঘটিত একটি গণহত্যার ঘটনার কথা বলি। খুলনার চুকনগর গণত্যার কথা হয়ত অনেকেরই জানা আছে–যেখানে দশ সহস্রাধিক ভারত গমনেচ্ছু মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, আক্ষরিক অর্থেই রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল ভদ্রা নদীর পানি। এটিই একদিনে সংঘটিত পৃথিবীর ইতিহাসে সবচে বড় গণহত্যার ঘটনা।
এখানে উল্লেখ করতে চাচ্ছি গোলাহাট গণহত্যার কথা। সৈয়দপুরে তখন মাড়োয়াড়ি সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস ছিল, যারা বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা বাণিজ্য করত। ফলে তাদের মধ্যে অনেকেই স্বচ্ছল ছিল। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে তাদের ব্যবসা বাণিজ্য এবং বাড়িঘরে লুটপাট হয়েছে, পাকিস্তানী বাহিনী পুরুষদের ধরে নিয়ে নির্মাণাধীন সৈয়দপুর বিমান বন্দরে কাজে করিয়েছে বিনা বেতনে। এভাবে একসময় মাড়োয়ারিরা ভারত চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং পাকিস্তানী বাহিনী এবং তাদের স্থানীয় সহযোগীরাও মাড়োয়ারীদের নিরাপদে ভারত পৌঁছে দেওয়ার আশ্বাস দেয়।
১৯৭১ সালের ১৩ জুন তারিখে তাদের একটি ট্রেনে তোলা হয় ভারত পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে। ট্রেনটি গোলাহাট নামক স্থানে পৌঁছালে পাকিস্তানী বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসররা সংঘঠিত করে পৃথিবীর ইতিহাসের একটি অন্যতম নৃশংস বর্বরোচিত গণহত্যা। যেখানে ৪৪৭ জন আবালবৃদ্ধবণিতাকে নির্বিচারে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের সহযোগী অবাঙালি বিহারী ও বাঙালি রাজাকার, আলবদর, আল শামস বাহিনী মিলিতভাবে হত্যা করে।
নৃশংসতার সব মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল ’৭১ সালের গণহত্যার ঘটনাগুলো। সেদিন গোলাহাট গণহত্যায় পাকিস্তানী বাহিনী একটি বুলেট খরচ করতেও চায়নি। তলোয়ার দিয়ে কেটে কেটে হত্যা করা হয় নারী, পুরুষ ও শিশুদের। শিশুদের বুটের তলে পিষে ফেলা হয়। শিশুদের উর্ধে নিক্ষেপ করে নিচে তলোয়ার পেতে দেওয়া হয়। নারীদের ট্রেনের কামরায় গণধর্ষণ করে হত্যা করা হয়। বেঁচে যাওয়া কয়েকজনের ভাষ্য থেকে জানা যায় ঐদিনের ঘটনা। এরকম ঘটনা অজস্র। আমরা কি তা জানি, আমরা কি তা মানি, কোনো ব্যথা অনুভব কি করি, দোষীদের বিচারের প্রয়োজনিয়তা বোধ করি?
রোহিঙ্গাদের জন্য আমাদের আর্তনাদ শুধুই যে সাম্প্রদায়িকতা না সেটি বুঝতে হলে আগে আমাদের নিজেদের ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে। আমাদের গণহত্যার ইতিহাস এবং ঘটনাগুলো আমরা জানতে-বুঝতে চাই না মানে প্রকৃতপক্ষে হৃদয়বৃত্তির চেয়ে দলবাজি এবং উগ্রতার দিকেই এখনো আমাদের ঝোঁক। কিন্তু মনে রাখতে হবে ইতিহাস ঘুর্ণায়মান, তাই সময় খুব নিষ্ঠুরভাবে ফিরে ফিরে আসে, আমাদের মুখোমুখি হতে হয় সে সময়ের। সত্যের সাথে অবশেষে আমাদের লড়তেই হয়। তাই সার্বজনিনভাবে মানবিক হওয়াটাই সভ্যতার একমাত্র দাবী এবং ইতিহাসের শিক্ষা হওয়া উচিৎ।
মিয়ানমার সরকার যতটা নিষ্ঠুর হওয়া যায় রোহিঙ্গাদের ওপর তারা হচ্ছে, নিঃসন্দেহে মিয়ানমার এক্ষেত্রে অমানবিক এবং বর্বর আচরণ করছে পিছিয়ে থাকা একগুচ্ছ জনগোষ্ঠীর সাথে। কিন্তু সভ্যতা ভব্যতার ধার না ধেরে আমরা তাদের ওপর মানবিক হতে চাই তারা শুধু মুসলিম বলে। অথচ মিয়ানমার সরকার এবং সেনাপ্রধান বারে বারে স্মরণ করিয়ে দিতে চায় যে রোহিঙ্গারা বাঙালি। প্রশ্ন হচ্ছে, রোহিঙ্গারা বাঙালি সেকথা সত্য হলেই কি তাদের দেশ থেকে নির্যাতন করে বিতাড়িত করা যায়? পৃথিবীর কার কোথায় শিকড় খুঁজতে গেলে তো কোনো দেশই আস্ত থাকবে না আর। আমরা রোহিঙ্গাদের ‘মুসলিম’ বা ‘বাঙালি’ এরকম কোনো পরিচয় কেন খুঁজতে যাব? তারা ভয়াবহভাবে নির্যাতিত হচ্ছে, নীপিড়িত হচ্ছে, তারা এখন ভয়ার্ত, পলায়নপর -এটাই এখন তাদের একমাত্র পরিচয় হওয়া উচিৎ নয় কি?
রোহিঙ্গারা মুসলিম না হলে কি আমরা আশ্রয় দিতাম না? রোহিঙ্গারা বাঙালি না হলে কি আমরা আশ্রয় দিতাম না? রোহিঙ্গারা মুসলিম বলে কি ধনী মুসলিম দেশগুলো তাদের আশ্রয় দিচ্ছে? পাকিস্তান কি দুই জাহাজ রোহিঙ্গা তাদের দেশে নিয়ে গিয়েছে? যায়নি।
রোহিঙ্গাদের নিয়ে একটি খবর এরকম- “গতকাল শনিবার সকালে কক্সবাজারের টেকনাফে মৃত সন্তানটি নিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় খুঁজেও জায়গা মিলে না নূর বেগমের। নূর বেগমের তিন সন্তান ছিল। জাফর আলম (৩), মো. হাসিম (৫) ও জানে আলম (সাড়ে ৫ মাস)। তিনি মংডুর জাম্বুনিয়ায় গ্রামের জামাল হোসেনে স্ত্রী।”
লক্ষ্যনীয়, নুর বেগমের তিন সন্তান, যাদের বয়স যথাক্রমে ৫ বছর, ৩ বছর এবং সাড়ে ৫ মাস। অর্থাৎ ৫ বছরে ৩ সন্তান! রোগ-শোক-জ্বরা-ব্যধি, শিশুস্বাস্থ্য, মাতৃস্বাস্থ্য সার্বিক বিবেচনায় ৫ বছরে তিনটি সন্তান কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। প্রশ্ন হল, বর্তমান সময়ে এসেও এরকম হওয়ার কারণ কী? আমাদের দেশেও দরিদ্র জনগোষ্ঠী আছে, জন্মহার আমাদের দেশেও অনেক বেশি ছিল এক সময়, এখনো অনেকের চার-পাঁচ সন্তান আছে। কিন্তু ৫ বছরের মধ্যে ৩টি সন্তান আমাদের দেশের খুব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যেও এখন বিরল। তাহলে মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা এতটা প্রতিকূলতার মধ্যে থেকেও জন্মহার এত বেশি রাখছে কেন? এটা সত্য যে দরিদ্র এবং অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মাঝেই জন্মহার বেশি থাকে। কিন্তু এর বাইরেও কোনো সত্য থাকতে কি পারে না সেখানে? কথা হচ্ছে, দরিদ্র-অশিক্ষিত রোহিঙ্গাদের নিয়ে মুসলিম বিশ্বের উগ্রবাদী অংশেরও কোনো রাজনীতি রয়েছে কিনা? থাকলে কী সেই রাজনীতি?
আসা যাক রোহিঙ্গাদের প্রতি আমাদের দরদ বিষয়ে। খেয়াল করলে দেখা যাবে রোহিঙ্গাদের প্রতি আমাদের আমাদের দরদের সিংহভাগ মানবিকতা নয়, সাম্প্রদায়িকতা, এবং সেটি খুব পরিষ্কার। ধরুণ, আপনি সন্ধ্যের সময় শাহবাগ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মধ্য দিয়ে হেঁটে আসছেন। তিন নেতার মাজারের সামনে দেখলেন, একটা লোক উল্টে পড়ে কাতরাচ্ছে, আপনি পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় কোনোমতে আপনার দিকে হাত বাড়িয়ে সাহায্য চাইল। আপনি কি তাকে সাহায্য করতে উদ্যোগ নিলেন? নিলেন না, কারণ, তখন আপনি ভেবে নিচ্ছেন, “ঈশ্বর তোমাকে ওভাবে রেখেছে।” ভেবে নিচ্ছেন, “তুমি নেশা করে পড়ে রয়েছে।” অর্থাৎ যেকোনো যুক্তিতে আপনি পাশ কাটাচ্ছেন। আপনার মত প্রায় সবাই এভাবে পাশ কাটাবে, প্রতিদিনই এই ঢাকা শহরে অামরা পাশ কাটাচ্ছি। যাদের পাশ কাটাচ্ছি তারা যে প্রায় সবাই মুসলিম তাতে কি কোনো সন্দেহ আছে?
মিয়ানমারের রাখাইনে যে ধনী রোহিঙ্গা একেবারে নেই তা নিশ্চয়ই নয়, তারাও গিয়ে দেখেন পাশ কাটাচ্ছে, ধনী রাখাইনদের সাথে বসে সান্ধ্য সুরা পান করছে। এটাই বর্তমান বিশ্বের ট্রেন্ড। সাম্প্রদায়িক সমস্যা দৃশ্যমান, কিন্তু মূল সমস্যা ক্ষমতাসীন বনাম ক্ষমতাহীন, ধর্ম সেখানে একটি বড় উপলক্ষ্য ও কারণ।
তারপরেও আমাদের চিৎকার করতে হবে, যেকোনো অপরাধের বিরুদ্ধে কথা বলারও একটা গুরুত্ব আছে, তবে তা কেন উস্কানিমূলক কেন হবে? ফেসবুকে দেখতে পাচ্ছি, বৌদ্ধদের উপর হামলা করার উস্কানি! এটা ভয়ঙ্কর। রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা হচ্ছে বলে বাংলাদেশে আপনি বৌদ্ধদের ওপর হামলা করবেন, পাকিস্তানে খ্রিস্টানদের ওপর হামলা হচ্ছে বলে আমেরিকা মুসলমানদের ওপর হামলা করবে, বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর হামলা হচ্ছে বলে ভারত মুসলামানদের ওপর হামলা করবে -এরকম যদি হয় তাহলে ধর্মের অবস্থান কোথায় গিয়ে ঠেকে একটু ভেবে দেখুন তো! পথের ক্ষুধার্ত কয়েকটি কুকুর যেমন মাংসের একটি টুকরো নিয়ে কাড়াকাড়ি-মারামারি করে, তেমন যদি ধর্মগুলোও কামড়াকামাড়ি করে মরে, তাহলে সেই ধর্ম যারা ছুড়ে ফেলে দিতে চায় তাদের দোষ দেবেন কেন?
দিব্যেন্দু দ্বীপ