রূপভোগের যে বর্ণনা লেখক দিয়েছেন তাতে অভিনবত্ব আছে, ঋষিসুলভও মনে হয় মাঝে মাঝে, ‘মনুষ্যত্বেরও’ খানিক অভাব আছে আসলে। মনুষ্যত্ব বলতে অাবার পাঠক আপনারা কে কী ভাববেন জানি না, মনুষ্যত্ব মানে আমার কাছে মানুষের তত্ত্ব।
দিব্যেন্দু দ্বীপ
বইটি পড়ছি আর ভাবছি, এ বইটিকে এত বিখ্যাত বলার হেতু কী? ভ্রমণ কাহিনী বলে বেশি মনোযোগের সাথে পড়ার প্রয়োজন হচ্ছে না। পড়ছি, পাশাপাশি মজা পাচ্ছি না বলে বিরক্তও হচ্ছি। অতিরিক্ত বিরক্ত হওয়ার আগেই পড়া শেষ, অর্থাৎ বইটি এতটুকুই।
শেষ হইয়াও হইল না শেষ কথাটি কিন্তু এখানে ঠিক ঠিক খাপ খেয়ে যাচ্ছে। এটিকে উপন্যাস না বলে একটি ছোট ভ্রমণ গল্প বলাই বোধহয় বেশি যুক্তিযুক্ত হবে। যাইহোক, বলায় কিছু যায় আসে না, ছোটগল্প হলেই কি বড় গল্প হলেই কি, ভাল লাগাটাই আসল কথা। পড়ার সময় বিরক্ত হচ্ছিলাম পড়া শেষ হচ্ছে না বলে, পড়া শেষ হওয়ার পরে বিরক্ত হচ্ছি পড়া শেষ হয়েছে বলে। শেষে স্মরণ করতে গিয়ে দেখি বইটি পড়ার সময় যতটা না ভাল লেগেছিল পড়ার পরে এখন দিগুণ ভাল লাগছে।
ভ্রমণ করতে গেলে কিন্ত ঠিক এমনই হয়। ভ্রমণ করার সময় হয়ত এমন কিছু ভাল লাগে না, তবে স্মরণ করতে ভাল লাগে। বলতে ভাল লাগে সবচে’ বেশি। বলার সময় শিশুসুলভ অতিকথনও থাকে অনেক। ভ্রমণ করার সময় হয়ত অচেনা জায়গায় ভয়ে বা অবহেলায় অনেক কিছু দেখা হয় না। ক্লান্তি, অর্থাভাব বিভিন্ন কারণে ভ্রমণের পরিপূর্ণ স্বাদ পাওয়া যায় না, ফিরে আসলে কিন্তু চমৎকার। তখন কোনো অভাব নেই, কোনো ঝামেলা নেই। যতটুকু দেখা হয়েছে তা দিয়েই অনেক কিছু আঁচ করা যায়। বলা হয় যা দেখেছি তার দিগুণ, লেখা হয় চারগুণ।
অর্থাৎ ভ্রমণ সম্পূর্ণ হয় তা অন্যকে বলায় এবং যদি কেউ লিখতে পারে তাহলে লেখায়। এক্ষেত্রে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় শতভাগ সফল। কী দেখেছেন তা তিনিই জানেন, তবে বর্ণনা দিয়েছেন খুব সুন্দর, কিন্তু অতিকথন কি কিছু না থেকে পারে? কোল নারীদের যে বর্ণনা তিনি দিয়েছেন তা হয়ত সত্য, কিন্তু যে দৃষ্টি নিয়ে তিনি দেখেছেন বলে বিশ্বাস করতে বলছেন তা পুরোপুরি সত্য না হলেও লেখকের সম্মানহানী হবে না। আর তিনি সত্য হলে বুঝতে হবে কোল নারীদের বর্ণনায় বাহুল্যতা আছে।
রূপভোগের যে বর্ণনা লেখক দিয়েছেন তাতে অভিনবত্ব আছে, ঋষিসুলভও মনে হয় মাঝে মাঝে, ‘মনুষ্যত্বেরও’ খানিক অভাব আছে আসলে। মনুষ্যত্ব বলতে অাবার পাঠক আপনারা কে কী ভাববেন জানি না, মনুষ্যত্ব মানে আমার কাছে মানুষের তত্ত্ব।
বইটিতে লেখক বলেছেন, “আমি কখনো কবির চক্ষে রূপ দেখি না, চিরকাল বালকের মত রূপ দেখিয়া থাকি, এই জন্য আমি যাহা দেখি তাহা অন্যকে বুঝাইতে পারি না। রূপ যে কী জিনিস, রূপের আকার কী, শরীরের কোন স্থানে তাহার বাসা, এ সকল বার্তা আমাদের বঙ্গ কবিরা বিশেষ জানেন, এই জন্য তাঁহারা অংগ বাছিয়া বাছিয়া বর্ণনা করিতে পারেন, দূর্ভাগ্যবশত আমি তাহা পারি না।”
পুরুষ মানুষটাকে ঢেকে বেশি করে মানুষ হতে গিয়ে লেখক এখানে শিশুসুলভ কিছুটা ভুল কথা বলে ফেলেছেন। বাঙ্গালি কবিরা অঙ্গ বাছিয়া বাছিয়া বর্ণনা করতে পারেন -একথা কিন্তু আমার কাছে সঠিক মনে হচ্ছে না। মিছেমিছি তিনি বাঙ্গালি কবিদের দোষারোপ করেছেন।
আরেক জায়গায় লেখক বলছেন, “পাত্র দেখিয়া ভুলি না; দেহ দেখিয়ে ভুলি না; ভুলি কেবল রূপে। সে রূপ লতায় থাক আর যুবতীতে থাক, আমার মনের চক্ষে তাহার কোন প্রভেদ দেখি না।” উক্তিটির মধ্যে কোথায় যেন একটু ফাঁকি অনুভব করি। আবার “আমি পাত্র দেখিয়া ভুলি না; ভুলি কেবল রূপে”, এখানে খানিকটা সংশোধনও হয়েছে। তবে বক্তব্যটির মধ্যে ফাঁকির প্রাধান্যই বেশি।
তিনি কেবল রূপে ভোলেন, তা না হয় বোঝা গেল, কিন্তু তিনি রমনীর রূপ হতে দেহকে কী প্রকারে আলাদা করিবেন তাহা আমাদিগের মত আমজনতা কি প্রকারে বুঝিতে পারিবে তাহা সঞ্জীব বাবু বাঁচিয়া থাকিলে আমি একবার জিজ্ঞাস করিয়া লইতাম।
ভ্রমণ কাহিনি তিনি অত্যন্ত সাবলিলভাবে বর্ণনা করেছেন। দার্শনিকসুলভ নয়, আবার বর্ণনার সরলতার মধ্যেই রয়েছে বিশেষ দর্শন।
কোথাও আক্ষেপ প্রকাশ পাইনি বলে বইটিতে পরিপূর্ণতার কিছুটা অভাব হয়ত রয়েছে, তবে তিনি যে প্রেমিক হৃদয়ের পরিচয় দিতে চেয়েছেন সেখানে আক্ষেপ স্থান পাওয়া কঠিন। বইটিতে বিশেষ কোনো সমালোচনা বা পরামর্শ নেই বলেই এটি সত্যিকার অর্থে একটি সার্থক ভ্রমণ কাহিনি হয়ে উঠেছে।
তবে লেখক একজায়গায় বাঙ্গালিদের সজ্জন বলে প্রশংসা করেছেন, আবার বাঙ্গালি শুধুমাত্র সংখ্যায় ভারী -একথা বলে কটাক্ষও করেছেন। অতএব, পুরোপুরি বলা যাচ্ছে না, ইহকালের কালিমা তাকে মোটেই স্পর্শ করে নাই, তবে তিনি তা নিস্বর্গের আড়ালে লুকিয়েছেন চমৎকার।